৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮
দানবীয় ইউএপিএ আইন - গণতন্ত্রের লজ্জা
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
গত ২৯ মে ২০২১-এর ঘটনা। কাশ্মীরের কুপওয়াড়া জেলার বুমহামা গ্রামের বছর পনেরোর কিশোর জাহাব। দ্রাগমুল্লা পুলিশের নির্দেশে জাহাবের সাথে গ্রামেরই আরও তিনজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে সেদিন ফাঁড়িতে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় সরপঞ্চ। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে চারজনকেই ইউএপিএ আইনের ১৩ নম্বর ধারায় গ্রেফতার করা হলো। অভিযোগ, তারা নাকি দেশবিরোধী কাজে যুক্ত। ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ২৮ মে রাত ন’টা নাগাদ মোহাম্মদ আমিন দার নামে এক গ্রামবাসী গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়ে হাসপাতালে যাবার পথে মারা যান। আমিনের শেষকৃত্যে অংশ নেন কয়েকশো গ্রামবাসী, আত্মীয়-স্বজন। সে সময়েই প্রথা অনুযায়ী ধর্মীয় স্লোগানের মাঝে কেউ একজন ‘হাম কেয়া চাহাতা হ্যায়’ স্লোগান তুললে কিছু যুবক ‘আজাদি’ শব্দে প্রত্যুত্তর করেন। এই ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয় এবং দ্রাগমুল্লার পুলিশ পোস্ট হতে গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান নাজির আহমেদ দারকে গ্রামেরই আটজনকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নাজিরের বক্তব্য অনুযায়ী তার সাথে যাওয়া চারজনের তিনজন এমনকি শেষকৃত্যের সময় সেখানে উপস্থিতও ছিল না। ১৫ বছরের নাবালক সন্তান, জাহাবের বাবা কাইফ লাগাতার ৫ দিন কুপওয়াড়া থানার বাবুদের হাতে-পায়ে ধরে বারে বারে বোঝাতে চেয়েছেন, তার ছেলে জাহাব সবেমাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র। জন্মের শংসাপত্র হতে স্কুলের প্রমাণ দেখিয়েও কোনো লাভ হয় না। জাহাবকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দি করে শ্রীনগরে চালান করা হয়। কাইফ একজন গরিব শ্রমিক, তার কোনো ধারণাই নেই কোন্ রাক্ষুসে আইনে তার বাচ্চা ছেলেটা আজ জেলবন্দি। শুধু জাহাবই নয়, আরও যাদের শুধুমাত্র ‘আজাদি’ শব্দ উচ্চারণের জন্য দেশবিরোধী সাজিয়ে সন্ত্রাসবাদী তকমায় ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই অতি দরিদ্র, সাধারণ, শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেবার পর যে তথাকথিত ‘শশ্মানের শান্তি’ আজ সেখানে বিরাজমান তার নেপথ্যে এই মারণ ইউএপিএ আইনকে যত্রতত্র প্রয়োগের একের পর এক দৃষ্টান্ত আজ নিতান্তই সুলভ। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট (পিএসএ), ১৯৭৮ নামক ভয়ঙ্কর আইনের সাথেই ইউএপিএ-কে জুড়ে দিয়ে কার্যত জামিন পাওয়ার অধিকারকেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আবার যেহেতু পিএসএ আইনের বহুল ব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিকস্তরে ভারতকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাই বর্তমানে শুধু ইউএপিএ-ও যখন-তখন ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ইউএপিএ আইনের অধীনে ২৫৫টি মামলায় ২২৭ জন জম্মু-কাশ্মীরে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
শুধুমাত্র জম্মু-কাশ্মীরেই নয়, কার্যত গোটা দেশেই আজ গণতান্ত্রিক পরিসরগুলো ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। ন্যূনতম প্রতিবাদের অধিকার, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা কেড়ে নেবার বন্দোবস্ত চলেছে প্রতি মুহূর্তে। গত ৫ জুলাই ইউএপিএ আইনে বন্দি অবস্থায় অশীতিপর ৮৪ বছরের স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু আজ চর্চার বিষয় রূপে উঠে এলেও এ সম্পর্কে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই যে এমনতর নানা ঘটনা আজ আর কোনো বিচ্ছিন্ন, ব্যতিক্রমী উদাহরণ নয়। প্রশাসন হতে আদালত - প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারছে না সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা। এমনতর ঘটনাবলিকেই আজ স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত করার ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় আয়োজন চলছে। আর এভাবেই চলেছে ‘নয়া ভারত নির্মাণ’।
বস্তুত, ২০১৯ সালের ২ আগস্ট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ইউএপিএ আইনকে যে রূপে বর্তমান শাসক কর্তৃক সংশোধিত করা হয়েছে তার মধ্যেই এক ভয়ানক প্রবণতার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ছিল। ১৯৬৭ সালের আন-লফুল অ্যাক্টিভিটিস প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ) দ্বারা কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী রূপে চিহ্নিত করা সম্ভবপর ছিল। কিন্তু ইউএপিএ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯-এর ৩৫ নং ধারা সংশোধনের মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র কোনো সংগঠন নয়, একজন ব্যক্তি মানুষকেও আজ যেকোনো মুহূর্তে সন্ত্রাসবাদী রূপে চিহ্নিত করা সম্ভব, যদি রাষ্ট্র তা মনে করে। ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে মনে পড়ে, পরাধীন ভারতে ঠিক একইরূপে ব্যক্তি মানুষকে সন্ত্রাসী চিহ্নিত করার উদ্দেশে ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রবর্তিত হয়। আর এ আইন লাগুর প্রতিবাদেই ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহ ঘটনায় ১৯৬৭ সালে এই আইন প্রথম তৈরি হলেও ইতিপূর্বে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১২ সালেও তা সংশোধন করা হয়। এর আগে কখনো যে এ আইনের অপপ্রয়োগ হয়নি তা নয়, কিন্তু ২০১৯ সালের আনা সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে কার্যত আইনটি অপপ্রয়োগেরও ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। বর্তমান রূপে এমন আইনের প্রয়োগই আমাদের সংবিধান নির্দেশিত গণতান্ত্রিক নৈতিকতা ও মৌলিক দর্শনের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুডিশিয়াল স্ক্রুটিনি ছাড়া এবং কোনোরকম ট্রায়াল শুরুর আগেই স্বাধীন দেশের কোনো নাগরিককে এভাবে সন্ত্রাসবাদী তকমায় চিহ্নিত করে বিচার করা আমাদের সংবিধানের সমতার অধিকার (১৪ নং ধারা), কথা বলার স্বাধীনতা (১৯ নং ধারা) এবং সসম্মানে বাঁচার অধিকার (২১ নং ধারা)-কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়। এ আইনে আটক হওয়া যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে ১৮০ দিনের আগে জামিন পাওয়া কার্যত অসম্ভব। প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)-কে। ডাইরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ ছাড়াও এনআইএ-কে সরাসরি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০১৫ হতে ২০১৯ - এই ৫ বছরে দেশজুড়ে ৭৮৪০ জন মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে এই দানবীয় আইনকে ব্যবহার করে। অথচ তার মধ্যে মাত্র ১৫৫ জন অর্থাৎ ১.৯৮ শতাংশ আদালতে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। এ পরিসংখ্যান হতেই স্পষ্ট যখন-তখন, যত্রতত্র যেকোনো নাগরিককে রাষ্ট্রের চোখে বিপজ্জনক মনে হলেই তাকে ইউএপিএ ব্যবহার করে গ্রেফতার করার এক ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত আজকের শাসককুল। ২০১৯-এ আইন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই প্রবণতাই যে আরও স্পষ্ট হয়েছে তার প্রমাণও পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তারি বেড়েছে প্রায় ৭২ শতাংশ। শুধু ২০১৯ সালেই এই আইনে ১২২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৪৯৮ জন, যার মধ্যে সবথেকে বেশি যোগীর উত্তর প্রদেশে ৪৯৮ জন, তারপর মণিপুরে (৩৮৬) ও তামিলনাডুতে ৩০৮ জন।
করোনা মহামারীর আতঙ্কে যখন সারা দেশের মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত, সে সময়কালেও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে বরং বিপন্ন এ সময়কে ব্যবহার করেই নানান অজুহাতে ইউএপিএ আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে একের পর এক প্রতিবাদী ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক সমাজ পরিবর্তন ও মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তিত্বকে। নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী বিক্ষোভে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে সার্জিল ইমাম, ইসরাত জাহান। আবার দিল্লি দাঙ্গায় অভিযুক্ত করে উমর খালিদ, মীরাম হায়দার, সাফুয়া জায়গার, আনন্দ দেলতুম্বে সহ সাতজন ছাত্র, গবেষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাসকের স্বরূপ উন্মোচনে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ায় নানা অজুহাতে আসিফ সুলতান, সিদ্দিক কাপ্পান, মাসরাত জাহারা, গৌহার গিলানী সহ একাধিক সাংবাদিককে এ সময়কালেই ইউএপিএ-তে আটক করা হয়েছে। ২০২০ সালের আগস্টে পূর্ব ব্যাঙ্গালোরের কংগ্রেসী বিধায়ক আর অখণ্ডশ্রীনিবাসের ভাইপো পি নভীনের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত দাঙ্গায় একসাথে ১১৫ জনকে ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করা হয়। একটা ঘটনায় একসঙ্গে এত মানুষের গ্রেপ্তারিতে ইউএপিএ প্রয়োগের এটাই সবথেকে বড়ো উদাহরণ। শুধুমাত্র সদ্যপ্রয়াত স্ট্যান স্বামীই নন, ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার হয়ে এখনও জেলবন্দি রয়েছেন সমাজের একাধিক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত কবি ভারভারা রাও বহু টানাপোড়েনের পর কয়েকমাস আগে গুরুতর অসুস্থতার কারণে জামিন পেলেও সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নভলখা, ভার্সন গঞ্জালভেস, অরুণ ফেরিরা, সুধীর ধাওয়ালে, মহেশ রঞ্জিত, শোভা সেন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসন সহ ১৫ জন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব আজও জেলবন্দি। গত ৬ জুলাই প্রখ্যাত মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ পেয়েছে, কিভাবে এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত সুরেন্দ্র গ্যাডলিং-এর ব্যক্তিগত কম্পিউটারে পেশাদার হ্যাকারদের সাহায্য নিয়ে তাঁর মাওবাদী যোগ সংক্রান্ত নথি অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। ইতিপূর্বে এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আর এক অভিযুক্ত রোনা উইলসনের ল্যাপটপ হ্যাক করে ৩০টির বেশি ফাইল ও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রমূলক এক ভয়ানক চিঠি কিভাবে তার ল্যাপটপে প্রবেশ করানো হয়েছিল তাও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনেই প্রথম উঠে এসেছিল। অর্থাৎ এমন মানুষগুলো আজ কোন্ স্তরের রাষ্ট্রীয় নিলর্জ্জতা ও ষড়যন্ত্রের শিকার তা এমন ঘটনাপ্রবাহেই পরিস্ফুট । স্ট্যান স্বামীকে গ্রেপ্তার করার সময় তাঁর চশমা বা তরল খাদ্য গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত স্ট্র পর্যন্ত সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি। ভাবা যায়, একজন ৮৪ বছরের পারকিনসন রোগাক্রান্ত অসুস্থ বৃদ্ধকে তাঁর বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রীতিমতো রাষ্ট্রের সাথে আদালতে লড়েই আদায় করতে হয়েছিল! বন্দি অবস্থাতে বেঁচে থাকার ন্যূনতম নাগরিক অধিকারকে কোনো স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কী এভাবে কেড়ে নেওয়ার দুঃসাহস অর্জন করতে পারে? রাষ্ট্রীয় সৌজন্যে স্ট্যান স্বামীর এ হত্যা যেন পরাধীন ভারতের শাসকের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ধরনের গ্রেপ্তারি ও ঘটনাবলি থেকে পরিষ্কার যেনতেন প্রকারেণ এমন ব্যক্তিত্বদের জেলবন্দি করে যতদিন পারা যায় আটকে রেখে নির্যাতনই আজ এ রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য, তাতে মৃত্যু হলেও ‘কুছ পরোয়া নেহি’। আসলে প্রতিমুহূর্তে ভীত, সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র এমন উদাহরণকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। শাসকের বিরোধিতায় কী হাল হতে পারে ক্ষণে ক্ষণে নাগরিকদের সেই সবকই যেন শিখিয়ে দিতে চাইছে আজকের রাষ্ট্র।
সম্প্রতি দিল্লি দাঙ্গায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ইউএপিএ আইনে ধৃত নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা ও আসিফ ইকবাল তানহা’র জামিনের রায় ঘোষণাকালে দিল্লির উচ্চ আদালতের বিচারপতি যখন-তখন, কারণে-অকারণে রাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতাকেই দেশদ্রোহিতা বা সন্ত্রাসবাদী তকমায় ভূষিত করার সাম্প্রতিককালের এমন ভয়াবহ প্রবণতার বিরূদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। আমাদের সংবিধানের গণতান্ত্রিক নৈতিকতা ও আদর্শের পরিপন্থী এই ঝোঁক সম্পর্কে রাষ্ট্রকে সংযত হতেই উপদেশ প্রদান করেছেন মাননীয় বিচারপতি। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে বিশেষত বিগত কয়েক বছরে যেভাবে সংখ্যাগুরুর ধর্মকেন্দ্রিক উগ্র জাতীয়তাবাদের আবহে গড়ে তোলা হয়েছে তা আমাদের সমাজের অন্তরে লালিত দীর্ঘকালীন নানা শুভবোধকেও আজ আঘাত করছে। দেশজুড়ে বামপন্থী, প্রগতিশীল শক্তির রাজনৈতিক প্রভাব দুর্বল হয়ে যাওয়া এই প্রবণতাকে নিশ্চিতভাবেই আরও শক্তিশালী করেছে। ফলে শুধুমাত্র কেন্দ্রের শাসকরাই নন, নানা রাজ্যের শাসকশক্তির মধ্যেই গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার বাসনা তীব্র হচ্ছে। ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনের বহুল ব্যবহারে তারাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আমাদের রাজ্যেও গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরার একের পর এক দৃষ্টান্ত আজ অতি সহজে দৃশ্যমান। সাংবিধানিকভাবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন নানান সংস্থা, যেমন-নারী কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মর্যাদাকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে না। এটা ঘটনা যে, শাসকের সংস্কৃতিই তাৎক্ষণিকভাবে হলেও সমাজকে সবথেকে বেশি প্রভাবান্বিত করে। ফলে দেশ-রাজ্যের শাসকশক্তির অগণতান্ত্রিকতা ও স্বৈরাচারী মনোভাব আজ সমাজের বিবিধ প্রতিষ্ঠানে, এমনকি একটু প্রভাবশালী ব্যক্তি-মানুষের আচার-আচরণের মধ্যেও পরিস্ফুট হচ্ছে।
বৃহত্তর জনপরিসরে প্রকৃতঅর্থেই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক এ রাষ্ট্রের গণতন্ত্র আজ যেন শুধু খাতা-কলমেই সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এ রাষ্ট্র তাই এত সহজে ইউএপিএ-র মতো ভয়াবহ আইন বানিয়ে স্ট্যান স্বামীর ন্যায় ব্যক্তিত্বদের নিঃসংকোচে খুন করে ফেলতে পারে! গণ-প্রতিবাদ, গণ-প্রতিরোধের সেই তীব্র বহ্নিশিখার উদগীরণ ঘটানো সম্ভবপর হচ্ছে না বলেই যে আজ এ দুঃসাহস অর্জনে রাষ্ট্র সক্ষম হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।