৫৮ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ২৩ জুলাই, ২০২১ / ৬ শ্রাবণ, ১৪২৮
জলের আকাল ও উদাসীন সরকার
তপন মিশ্র
গাছ ও আগাছা যমুনাকে ক্রমশ সংকীর্ণ করে দিচ্ছে।
যখন পূর্ব ভারতে মৌসুমী বায়ুর আগমন ঘটেছে, তখন দিল্লিতে জলাভাব। দিল্লি জল বোর্ড জানিয়ে দিয়েছে যে, যমুনা নদীতে অত্যাধিক শ্যাওলা (algae) এবং অ্যামোনিয়ার উপস্থিতির কারণে তিনটি পাম্পিং স্টেশনে জল শোধন করা যাচ্ছে না। যমুনা নদীর জল এমনিতেই অত্যন্ত দূষিত, তার উপর বর্তমানের এই দূষণের বাড়তি চাপ। জল স্থির না’হলে সাধারণভাবে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায় না। যখন যমুনার প্রবহমান জল ধীরে ধীরে স্থির হয়ে আসছে, তখন হরিয়ানা এবং দিল্লির মধ্যে এ'নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা শুরু হয়েছে। একদিকে জলের স্বল্পতা অন্যদিকে দূষিত জল এই বিবাদের কারণ। এখানে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৬০ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটারের মতো। দেশের গড় বৃষ্টিপাত তুলনায় কম হলেও বৃষ্টির জল ধরে রাখার কোনো সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নেই। কেবল দিল্লির কথা নয়, এদেশের বিভিন্ন শহরে যে মানুষরা থাকেন তাদের ৩১ শতাংশের ঘরে জলের জোগান নেই। এঁরা মূলত বস্তিবাসী। আমাদের দেশের জনসংখ্যার ৩৪ ভাগ মানুষ শহরে থাকেন। কেন্দ্রীয় জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ কারিগরি দপ্তর (Central Public Health and Environmental Engineering Organisation)-এর হিসাব অনুযায়ী জনপ্রতি জলের চাহিদা প্রতিদিন ১৩৫ লিটার। এই পরিমাণ জল সরবরাহ তো হচ্ছেই না বরং নীতি আয়োগের কথায় যে জল নলের মাধ্যমে সরবরাহ হচ্ছে তার ৭০ শতাংশই দূষণ মুক্ত নয়।
অপরিকল্পিত পরিকল্পনা
২০১৯ সালের মে মাসে আমাদের দেশে মোদী সরকার জলশক্তি মন্ত্রক স্থাপন করে। এমনটা নয় যে, জলের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য আগে দেশে কোনো মন্ত্রক ছিল না। দীর্ঘ দিন ধরে থাকা দুটি মন্ত্রক যেমন, Ministry of Water Resources, River Development & Ganga Rejuvenation এবং Ministry of Drinking Water and Sanitation-কে একসঙ্গে যুক্ত করে জলশক্তি মন্ত্রক তৈরি হয়। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশে জলের ব্যবহার ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মোদী সরকার গুরুত্ব বৃদ্ধি করল না খর্ব করল তা পাঠকদের বুঝে নিতে হবে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, ২০২৪ সাল নাগাদ সবার ঘরে কলের জল সরবরাহ করা। এর জন্য ‘জল জীবন মিশন’ নামে একটি সংস্থাও তৈরি হয়।২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ মোদী সরকারের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার এক বছরেরও বেশি সময় পর ‘ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ লিখছে যে, দেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় জলের অভাবে রয়েছেন এবং প্রতি বছর কমকরে ২ লক্ষ মানুষ ভালো পানীয় জলের অভাবে মারা যান (Composite Water Management Index: A Tool for Water Management, India, 2018)। করোনার আক্রমণে মানুষ যখন ত্রস্ত, তখন যে তীব্র জলাভাব দেশজুড়ে চলছিল সরকারের তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। ২০১৮ সালে নীতি আয়োগ (National Institution for Transforming India) বলছে যে, দেশে এই সময়কার জলাভাব এদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক। প্লানিং কমিশন ভেঙে নীতি আয়োগ তৈরি করেছে মোদী সরকার। তা সত্ত্বেও নীতি আয়োগের রিপোর্টে সরকারের ভ্রূক্ষেপ নেই। নীতি আয়োগ আরও কয়েকটি ভয়ঙ্কর কথা শুনিয়েছে। রিপোর্ট বলছে, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং হায়দরাবাদসহ দেশের ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ জল প্রায় শেষ (Composite water Management Index, NITI Ayog 2018)। ফলে তীব্র জল সঙ্কটে পড়বেন আরও অন্তত ১০ কোটি ভারতীয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে ৬০ কোটির উপর ভারতীয় কম বেশি জল-সঙ্কটে রয়েছেন। ফলে প্রায় ৭০ কোটি মানুষের জন্য সরকারকে পরিকল্পনা করতে হবে। একথা বলা যায় যে, ভারত এই মুহূর্তে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম জল সঙ্কটের মুখোমুখি। এই জল সঙ্কট সামনের দিনগুলোয় আরও খারাপ আকার ধারণ করতে চলেছে। নীতি আয়োগের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রবল সঙ্কটে পড়বে ৪০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয়।
দেশে সরবরাহ করা জলের গুণমান সম্পর্কে নীতি আয়োগের রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে, দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ জলই দূষিত। জলের গুণমানের সূচক হিসাবে গোটা বিশ্বে ভারতকে ১২২টি দেশের মধ্যে ১২০ তম স্থানে রেখেছে ইউনাইটেড নেশনস্ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (Global Drinking Water Quality Index Development and Sensitivity Analysis Report, UNEP)। একইসঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ধীরে ধীরে দীর্ঘায়িত হচ্ছে গ্রীষ্ম। আমাদের দেশে ২০৩০ সাল নাগাদ যদি আমরা জলের জোগান না বাড়াতে পারি তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি উৎপাদন এবং তার পরেই শিল্প। যে শিল্পগুলির উৎপাদন খুব আঘাত পাবে তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বয়ন, ধাতু, রাসায়নিক, কাগজ এবং চামড়া। এর ফলশ্রুতি হলো, ২০৫০ সাল নাগাদ জিডিপি বর্তমানের তুলনায় (করোনা আবহ যদি না থাকত) ৬ শতাংশ কমে যাবে।
এই বিপদ মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা কী? প্রত্যেক বাড়িতে জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য নল লাগালেও জলের উৎস কোথায়? যে নল এখন লেগে আছে তাতেই জল নেই। এর উপর চাষের জমিতে জল সরবরাহ করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র যে সমাধান আমদের সামনে আছে তা হলো বর্ষার জলের সদ্ব্যবহার। এ'সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনা নেই। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি অটল ভূজল যোজনা হইহই করে তৈরি হয়। দেশের ২৫৬টি জেলায় জল সংরক্ষণে বিশেষ পরিকল্পনার জন্য এই কর্মসুচি নেওয়া হয়। ব্যাস এই পর্যন্ত। এখনো দেশের ভৌম জলের কোনো সামগ্রিক ম্যাপ তৈরি হয়নি, যদিও জলশক্তি মন্ত্রকের এটাই ছিল প্রথম কাজ।
সরকারের অসফলতার একটি বড়ো উদাহরণ হলো চেন্নাই শহর। গত ৪ ফেব্রুয়ারি 'দ্য ইকনমিক টাইমস' লিখছে যে, ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে প্রতিদিন ১ কোটি লিটার জল বাইরের থেকে ট্রাকে এনে চেন্নাইবাসীদের সরবরাহ করতে হয়েছিল। এখন অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। এই শহরে প্রতি বছর গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৮০০ মিলিমিটার অর্থাৎ কলকাতার থেকে বেশি। মূলত নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে এই বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির জল ধরে চেন্নাইতে ১০০০ জলাভূমির শহরে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি এখন অধরা।
শ্যাওলায় ঢেকে গেছে যমুনা।
আমরাও সেই রসাতলে
যদি পশ্চিমবাংলার পশ্চিমের জেলাগুলোর দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, একটু স্বচ্ছল পরিবার হলেই তাকে বাড়িতে একটি গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অথচ রাজ্যের এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ৯০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার। সরকারি বা পুরসভা বা পঞ্চায়েত স্তরের জল সরবরাহ ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকার কারণে ভৌম জলের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না এবং সরকারও নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা নিতে পারছে না। এর উপরে আর্সেনিক এবং ফ্লোরাইডের সমস্যা রয়েছে। বামফ্রন্টের আমলে ভৌম জলের দূষণ নিয়ে যে তোলপাড় হতো আজকে তা শুনতে পাবেন না।
২০০২ সালে অনেক চেষ্টার পর পূর্ব কলকাতা জলাভূমি (EKW) বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি (রামসার সাইট) হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এই উদ্যোগের ১৫ বছর পর, ২০১৭ সালে আইআইটি, খড়গপুর সহ আরও কয়েকটি সংস্থার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভায় উঠে আসে যে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ (সল্টলেক-নিউটাউন অঞ্চলে), প্রমোটারদের অসামাজিক হস্তক্ষেপের ফলে এই জলাভূমির অনেকটাই দখল হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে কাজী নজরুল ইসলাম সরণির দু’ধারে নয়ানজুলি আদালতের রায় অমান্য করে ভরাট হয়ে যাচ্ছে, আর সরকার তা দেখছে। বাস্তবে সরকারের প্রতিনিধিরা এই কাজে মদত দিচ্ছে এবং তাই সরকার নীরব দর্শক।
কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, পঞ্চায়েত এবং পুরসভার যৌথভাবে যা করা দরকার তাহলো, জলের উৎস বৃদ্ধি। গবেষকদের মতে নদী অববাহিকার সংস্কার, জলবিভাজিকা মাফিক পরিকল্পনা, জলাভূমির সংরক্ষণ, বৃষ্টির জলের সংরক্ষণ ইত্যাদি করতে পারলে সমস্যার কিছুটা সুরাহা সম্ভব। এরদ্বারা জল সরবরাহে উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
রাজ্যের গ্রাম শহরে জল সরবরাহ করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে। পশ্চিমবাংলায় ৪১,৩৫৭টি গ্রামে গৃহের সংখ্যা ১.৬৩ কোটি। এর মধ্যে কমবেশি মাত্র ২ লক্ষ ঘরে নলের জল সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। বাকিদের নির্ভর করতে হয় নিজে তৈরি করা কোনো উৎসের উপর। কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার এদের দায়িত্ব নিতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। গত ২১ মার্চ তারিখের 'বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকা মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে কলসিভাঙা গ্রামের জলের হাহাকারের কথা জানাচ্ছে। এই গ্রামের প্রায় ৪০০ কুর্মি-মাহাতো পরিবারকে জলের জন্য অন্য গ্রামে যেতে হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা পশ্চিমবাংলার জলচিত্র অনুধাবন করেছেন একদল বিজ্ঞানী (Acta Geophysica, 2021)। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলাগুলিতে জলাভাব তুঙ্গে। এই জেলাগুলির মধ্যে ভৌম জলের বিচারে পশ্চিম মেদিনীপুর কিছুটা স্বস্তিতে। কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং ভৌম জলের উপর যে চাপ রয়েছে তার বিচারে উত্তর ২৪ পরগনা অদূর ভবিষ্যতে জলসঙ্কটের সম্মুখীন হতে চলেছে। কিন্তু রাজ্য সরকার এই বিপদ মোকাবিলায় কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছে না। যে সরকার নাগরিকদের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে পারে না তাদের মুখে উন্নয়নের কথা মানায় না।