৬০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৩ জুন, ২০২৩ / ৭ আষাঢ়, ১৪৩০
পঞ্চায়েতে মনোনয়ন পর্বেই বেলাগাম সন্ত্রাস
শাসক দুষ্কৃতীদের বোমা গুলিতে প্রাণ হারালেন ৮ জন
শিলিগুড়িতে শহিদ মনসুর আলমকে শেষশ্রদ্ধা পার্টিনেতা অশোক ভট্টাচার্য’র।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসকদলের শীর্ষনেতারা বলে বেড়াচ্ছেন, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপর্ব নাকি অভূতপূর্ব শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়েছে। অতীতে নাকি এমন এত শান্তিতে মনোনয়নপর্ব মেটেনি! উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড় কিন্তু এর ঠিক উলটো চিত্রই তুলে ধরছে। ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার দিন থেকেই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস গতবারের মতোই যে খুন-সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে পঞ্চায়েত দখলের রাস্তায় নেমেছে, তা প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যের মানুষ। মনোনয়নপর্বের শুরুতেই খড়গ্রামে এক কংগ্রেস কর্মীকে খুন করে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর মনোনয়নকে কেন্দ্র করে আরও ৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত-রক্তাক্ত হয়েছেন আরও অনেকেই। এছাড়া শাসকদলের দুর্বৃত্তদের দ্বারা অপহরণ ও তাদের কথায় মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তারের ঘটনাতো আছেই। তবুও মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা ‘নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণ মনোনয়নের’ যে বাগাড়ম্বর করছেন, নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে প্রায় এরই সমর্থন মিলেছে। ভাঙড়ের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি (যা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যবাসী) ছাড়াও চোপড়ায় শাসকদল যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী ও তাঁর দলীয় নেতাদের মুখে ‘শান্তির’ বুলি চূড়ান্ত মিথ্যাচার বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। চোপড়ার ঘটনাবলীই তার সাক্ষ্য দেবে। গত ১৫ জুন চোপড়ায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাবার সময় তৃণমূলী দুর্বৃত্তদের গুলিতে মারাত্মকভাবে জখম হয়ে তরুণ সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড মনসুর আলম (১৯) মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২১ জুন প্রাণ হারান।
৮ জুন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়। পরদিন চোপড়ার বিডিও’র আহ্বানে সর্বদলীয় বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে শাসকদলের হুমকি, শাসানি, টিটকিরি গালিগালাজের মুখে পড়তে হয় সিপিআই(এম) সহ বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের। ১২ জুন পরিস্থিতি বিচার করে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস দলের নেতৃবৃন্দ বিডিও, এসডিও এবং এসপি’র কাছে নিরাপত্তার দাবি করে স্মারকলিপি দেন। ফেরার সময়ে হাতিঘিষা মোড়ে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস দলের নেতৃবৃন্দের গাড়ি শাসকদলের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তৃণমূলের সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা সিপিআই(এম) নেতা বিদ্যুৎ তরফদার, নুর জামাল এবং কংগ্রেসের অশোক রায়, মুশকান বিবি এবং আবু বক্কর সিদ্দিকিকে অপহরণ করে বহু দূরে নিয়ে যায় এবং নানা জায়গায় ঘোরায়। তাঁদের প্রচণ্ড মারধর করে এবং মনোনয়ন দেওয়া যাবে না এবং কোথাও মুখ খোলা যাবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়। এদিকে এই ঘটনা জানাজানি হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও পথ অবরোধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত অবস্থার চাপে দুর্বৃত্তরা সন্ধ্যার সময় অপহৃতদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অপহৃতদের মধ্যে তিনজন গুরুতর আহত হওয়ায় তাঁদের ইসলামপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসককে অনুরোধ করে তাঁরা রাত আড়াইটা নাগাদ চোপড়া থানায় এসে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন। শেষে গভীররাতে পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাঁরা বাড়ি ফিরে আসেন।
এদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেলে আবারও আক্রমণের মুখে পড়তে হতে পারে, এই আশঙ্কা করে ১৩ জুন সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চোপড়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিকের (আইসি) কাছে নিরাপত্তা চেয়ে এবং কোথায় কোথায় দুর্বৃত্তদের হামলা হতে পারে - তা বিস্তারিত জানিয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
সেই অনুযায়ী ১৫ জুন মনোনয়ন জমা দেবার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশাসনকে জানানো হয়। কিন্তু লক্ষ করা যায়, সন্ত্রাস-কবলিত এলাকা বলে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাবার জন্য সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের পক্ষে কোনো গাড়ি ভাড়া না মেলায় দাসপাড়া ও ঘিরনিগাঁ গ্রাম পঞ্চায়েতের সংযোগস্থল লালবাজার এলাকা থেকে সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস দলের কর্মী-সমর্থক এবং প্রার্থীরা সম্মিলিতভাবে মিছিল করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে ১৫ কিলোমিটার দূরে বিডিও অফিস অভিমুখে যেতে থাকেন।
প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা পেরোনোর পর তৃণমূলের স্থানীয় বিধায়ক হামিদুল রহমানের বাড়ি কাঁঠালবাড়িতে মিছিল পৌঁছানোর সাথে সাথেই শাসকদলের দুর্বৃত্তরা বোমা-গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে চারজন গুলিবিদ্ধ হন এবং আহত হন প্রায় ৩০ জন। এঁদের মধ্যে সিপিআই(এম) কর্মী মনসুর আলমের মাথায় গুলি লাগায় তিনি শিলিগুড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান। অনেকেই শারীরিক আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন। এছাড়াও সেদিন গুলিতে জখম হন সিপিআই(এম) কর্মী মোস্তাফা কামাল, নৈমুল হক এবং কংগ্রেস কর্মী জাকির হোসেন। এছাড়া মহিলা প্রার্থী মোমেনা খাতুনেরও পায়ে গুলি লাগে। এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা প্রাণভয়ে পালাতে থাকেন। এমনই একটি মুহূর্তে পুলিশ অতি-সক্রিয় হয়ে মিছিল থেকে ফেরার পথে বাম ও কংগ্রেস কর্মীদের উপর লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। তাতেও অনেকে আহত হন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো - পুলিশকে আগাম জানানো সত্ত্বেও সেদিন সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস দলের কর্মী ও প্রার্থীদের জন্য কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি পুলিশ। অথচ দেখা গেছে, ‘মহাপ্রতাপশালী’ বিধায়ক ও তাঁর বাড়ির নিরাপত্তা দিতে অসংখ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল! এই সমস্ত ঘটনার বিবরণ তথ্য সহ স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। অথচ কোনো সুরাহা মেলেনি। এভাবেই শাসকদল পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে চোপড়ায় গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে। এমন ঘটনা রাজ্যের আরও অনেক জায়গায় ঘটেছে। এসবই মুখ্যমন্ত্রী, শাসকদল এবং নির্বাচন কমিশনের চোখে ‘শান্তিপূর্ণ’ মনোনয়ন! জবাব দেবেন মানুষ।