৬০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৩ জুন, ২০২৩ / ৭ আষাঢ়, ১৪৩০
বামফ্রন্ট পরিচালিত পঞ্চায়েতের বিকল্প কর্মসূচি
পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের আবেদন প্রকাশ করছেন বিমান বসু, সূর্য মিশ্র, মহম্মদ সেলিম, স্বপন ব্যানার্জি, তপন হোড় সহ বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ।
১) পঞ্চায়েত হবে জনগণের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান
● গ্রাম সংসদগুলি হবে তৃণমূল স্তরে মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার চূড়ান্ত স্থান। অবশ্যই গ্রামীণ জনগণকে যুক্ত করে স্থানীয় এলাকা উন্নয়নের মতামত গ্রহণ করে তা কার্যকর করা হবে। নিয়মিত গ্রাম সংসদ বসিয়ে মানুষের প্রকৃত স্বশাসনে পরিণত করা হবে।
● পঞ্চায়েত এলাকায় এবং পঞ্চায়েতের আওতাভুক্ত যে কোনো প্রস্তাবিত প্রকল্প বিশেষকরে জমি অধিগ্রহণ বা গ্রামীণ জমিতে অকৃষিজনিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৮০ শতাংশ মানুষের সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবার ধারা কঠোরভাবে রূপায়িত হবে। গ্রামীণ জমি প্রত্যক্ষভাবে প্রোমোটারকে দিয়ে কিনে নেবার জমি মাফিয়াকরণের বিরুদ্ধে পরিবর্তিত পঞ্চায়েত লড়বে।
● গ্রামবাংলার নারী ও প্রবীণ নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সহায়ক প্রকল্প গ্রহণ করা ও তাকে কার্যকরীভাবে রূপায়িত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
● এসডিও-বিডিও কর্তৃক আমলা-নির্ভর পঞ্চায়েত পরিচালনার রেওয়াজে বদল ঘটানো হবে।
২) শিক্ষাব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন
● স্কুলের পরিবেশ, পঠন-পাঠন, মিড-ডে-মিল সম্পর্কে গঠনমূলক পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রাম শিক্ষা কমিটি গঠনের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হবে।
● স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। শিশু শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু রাখা হবে।
● সমাজে আর্থিকভাবে দুর্বল ও অনগ্রসর অংশের শিশু ও কিশোরদের মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সমস্ত দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে। এলাকার শিক্ষিত নাগরিকদের সাম্মানিক প্রদান করে এই অংশের পড়ুয়াদের জন্য ফ্রি কোচিং-এর ব্যবস্থা করা হবে।
● গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় ৫ বছরের বেশি বয়সের সকল ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করা হবে এবং স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা হবে।
● আদিবাসী ও তপশিলি জাতির ছাত্রদের স্কুলের হোস্টেল পুনরায় চালু করা হবে।
● গ্রামের গ্রন্থাগারগুলিকে পুনরুজ্জীবন করে সেখানে ছাত্র-যুবদের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
৩) জনস্বাস্থ্য ও পঞ্চায়েত
● জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবেশের কাজ আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, স্কুলে মিড-ডে-মিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং পঞ্চায়েত সদস্যদের সমন্বিত করে করা হবে। মা ও শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, নির্মল পরিবেশ, রোগ-জীবাণু থেকে সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
● সহায়-সম্বলহীন বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য রান্না করা খাবার বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করবে পঞ্চায়েত।
● প্রতিটি গ্রামে নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে। শৌচালয় নির্মাণ ও ব্যবহারযোগ্য করতে পঞ্চায়েত উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
● হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব পূরণ করে উন্নত ও জরুরি পরিষেবা নিশ্চিত করা হবে।
৪) কৃষিকাজ ও কৃষক কল্যাণ
● কৃষকের স্বার্থে সমবায় সমিতিগুলির গণতান্ত্রিক পরিচালনা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সমবায় থেকে চাষিদের দাদন, বিমার সুযোগ, ন্যায্য মূল্যে সার ও কৃষি উপকরণ পাওয়ার সুবিধা দেওয়া হবে।
● কৃষিকে উৎসাহিত করতে পঞ্চায়েতের ব্যবস্থাপনায় নাবার্ড-এর সাহায্যে গ্রামে গ্রামে খামার পাঠশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
● কৃষকের ফসল সহায়ক মূল্যে বিক্রির জন্য ফুড কর্পোরেশনের ক্রয়কেন্দ্র বাড়াতে, বিপণন সমবায়গুলিকে ফসল কেনার কাজে যুক্ত করতে পঞ্চায়েত কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
● বর্তমানে মৌখিক চুক্তিতে গ্রামের খেতমজুর এবং গরিব চাষি জমি চাষ করেন। তাদের সরকারি অনুদান বা বিমার সুযোগ পেতে বৈধ নথিপত্রের ব্যবস্থা করা হবে।
● পাট্টা বাতিল করে কেড়ে নেওয়া জমি ফেরতের ব্যবস্থা করা হবে। সমস্ত পাট্টা প্রাপকের জমি চিহ্নিত করে মালিকানা স্বত্ব দেওয়া হবে।
● বনভূমিতে চাষ ও বসবাসকারী আদিবাসীদের সংশ্লিষ্ট জমিকে চিহ্নিত করে পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
● জল, জঙ্গল, জমির অধিকার আইনকে কার্যকরী করতে সুনিশ্চিত করবে।
৫) গ্রামীণ কর্মসংস্থান
● খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প এবং বন, পাহাড়, জঙ্গলভিত্তিক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার কাজে পঞ্চায়েত অগ্রাধিকার দেবে।
● জমি-জল সহ গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত সদ্ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। মাছ, ডিম, মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য উন্নত প্রজাতির প্রাণী পালনের ব্যবস্থা করা হবে। স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা হবে। শাক, সবজি, ফল-ফুল সংরক্ষণের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
● জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে বছরে ১০০ দিনের পরিবর্তে ২০০ দিন কাজ ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি প্রদানের লড়াই চালিয়ে যাবে। রেগার কাজে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একইভাবে আবাস যোজনার কাজ রাজ্যে পুনরায় চালু করা হবে।
● গ্রামের বেকার ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বহুমুখী পরিষেবা প্রদানের জন্য গ্রামীণ সার্ভিস সেন্টার গড়ে তোলা হবে। প্রয়োজনে বেকার যুবক-যুবতীদের কৃষিপণ্যে বিপণনের ব্যবসায়ে সহায়ক প্রকল্প চালু করা হবে।
● ভূমিহীন কৃষক/খেতমজুরদের জন্য বাম আমলের প্রভিডেন্ট ফান্ড (প্রফলাল) প্রকল্প পুনরায় চালু করা হবে।
● বামফ্রন্ট সরকার ‘চাষ ও বসবাসের ভূমিদান প্রকল্পে’ খেতমজুর, গ্রামীণ কারিগর ও মৎস্যজীবীদের বিনামূল্যে ৫ কাঠা করে জমি দিয়েছে। প্রায় দু’লক্ষ পরিবার এই প্রকল্পে উপকৃত হয়েছেন। দায়িত্ব পেলে এই প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সরকারের হাতে থাকা জমি ভূমিহীন, বাস্তুহীনদের বঞ্চিত করে বৃহৎ ব্যবসায়ী, কোম্পানি বা কর্পোরেটকে মালিকানা স্বত্ব দেওয়ার আইন বাতিল করা হবে।
● পঞ্চায়েত গ্রামীণ সম্পদকে বিকশিত করে নতুন আয়ের পথ দেখাবে - প্রশিক্ষণ দেবে - বেকার যুবকদের স্বনির্ভর দল - সমবায় তৈরি করবে। ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে বীজ, মূলধনের ব্যবস্থা করবে।
● গ্রামভিত্তিক পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা, কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা ও ফোন নং জেলা পরিষদ দপ্তরে রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
৬) সামাজিক সুরক্ষা
● কন্যাশ্রী বা ২ টাকা কেজি চাল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের প্রকল্প। ১০০ দিনের কাজ বা জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন বামপন্থীদের লড়াইয়ের ফসল। সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষের জন্য চালু জনকল্যাণমুখী প্রকল্প অব্যাহত থাকবে এবং সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প হবে প্রয়োজন ভিত্তিক এবং রূপায়ণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।
● স্ব-সহায়ক গ্রুপগুলো স্ব-নির্ভরতা অর্জনের পরিবর্তে মাইক্রোফাইন্যান্সের চড়া সুদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। মাইক্রোফাইন্যান্সের চড়া সুদের লুট বন্ধ করা হবে। মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কার্যকরী পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিটি গোষ্ঠীকে অর্থকরী কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
● দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েপড়া মানুষের জন্য বাম আমলের ‘আমার বাড়ি’ প্রকল্প সময়োপযোগী করে গৃহহীন মানুষের প্রত্যেক পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে।
৭) গ্রামীণ পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ
● সামাজিক বনসৃজন পুনরায় চালু করা হবে। বনাঞ্চল এবং রাস্তার দু’পাশের গাছ লুটপাট বন্ধ করা হবে। বনাঞ্চল সন্নিহিত গ্রামের মানুষজনদের নিয়ে পুনরায় বনরক্ষা কমিটি গঠন করা হবে। সাপের কামড়ে, বজ্রপাতে, হিংস্র জন্তুর আক্রমণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে চালু ক্ষতিপূরণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হবে। হাতির আক্রমণে ফসলের ক্ষতি এবং বাড়িঘরের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হবে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যাঁদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় যেমন - মধু সংগ্রহ, খাদানের কাজ, বহুতল নির্মাণের কাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বিমার ব্যবস্থা করা হবে।
● গ্রামে মদ-নেশার ঢালাও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। উৎকট শব্দ সৃষ্টিকারী মাইকের/ডিজের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের সাহায্য নেওয়া হবে।
● গ্রামের জলনিকাশের ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা, রোগ-জীবাণুর বাহক মশা-মাছির উপদ্রব নির্মূল করতে স্বাস্থ্যদপ্তর ও গ্রামবাসীদের সহায়তায় যৌথ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। জলের অপচয় বন্ধ করা হবে।
● গ্রামীণ অসাম্প্রদায়িক - লোকায়ত সংস্কৃতিকে উৎসাহ ও তার প্রসারে সাহায্য করবে পঞ্চায়েত। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে খেলাধূলায় উৎসাহ দেবে পঞ্চায়েত।
৮) যোগাযোগ ব্যবস্থা
● অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রাম্য রাস্তা যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত করা হবে।
● জনপথ পরিবহণে বেহিসাবি ভাড়া বেড়েছে। পঞ্চায়েত ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজ্য সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করবে।
৯) পরিযায়ী শ্রমিক
● পরিযায়ী শ্রমিকরা দ্বিমুখী (দালাল ও মালিক) শোষণের শিকার। নিরাপত্তাহীন অবস্থায় কাজ করতে হয়। নিয়মিত মজুরি পাচ্ছেন না। আগামীদিনে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে বিমার ব্যবস্থা করা হবে। কর্মস্থলে যে কোনো সমস্যায় পঞ্চায়েত পাশে থাকবে। যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা হবে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি পোর্টাল চালু করা হবে।