৬০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৩ জুন, ২০২৩ / ৭ আষাঢ়, ১৪৩০
লুটেরাদের হাত থেকে উদ্ধার করে জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তুলুন
মহম্মদ সেলিম
লুটতন্ত্রকে হটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভূমিস্তরে সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্ষমতায়ন আমাদের আজকের চ্যালেঞ্জ। বামপন্থীদের মূল লড়াই মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতি সাধনের জন্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা এবং তার ক্রমাগত সার্বিক উন্নয়ন। সেই পথে এগোনোর অন্যতম লক্ষ্য বিকেন্দ্রীকরণ যার আবশ্যিক শর্ত - গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং তাতে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তা সম্ভব ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে সমাজকেন্দ্রিকতায় উত্তরণের সমষ্টিগত প্রয়াসের মাধ্যমে। কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের হাতে যে ক্ষমতা আছে তার বেশিরভাগটা রাজ্যের হাতে আসুক, রাজ্যের যা ক্ষমতা আছে সেটা জেলা, ব্লক, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে আর গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে প্রধান-উপপ্রধান শুধু নয়, পঞ্চায়েতের সদস্য থেকে গ্রামসভা এবং গ্রাম সংসদের হাতে পৌঁছে দেওয়া। এজন্যই ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হওয়ার পরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যদিয়ে এই বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়। এটাই প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
বিপরীতে, দক্ষিণপন্থার উত্থানের অন্যতম লক্ষ্য হলো, ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ। যেমন রাজা-রাজড়াদের সময় সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল, খুব বেশি হলে রাজার সঙ্গে তার দরবারের হাতে ক্ষমতার যাবতীয় কেন্দ্রীকরণ আর জমিদার হলে তার সঙ্গে কাছারির হাতে। দক্ষিণপন্থীরা স্বনির্ভর মানুষকে সরকার নির্ভর করে তোলার চেষ্টা করে। যেখানে সরকার মানে শুধু তো সরকারি দল নয়, সরকারি গোষ্ঠী এবং আদতে একটি পরিবার নির্ভরতা তৈরি করা। বলা যেতে পারে ‘ওভার কনসেনট্রেশন অব পাওয়ার’ বা ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা। তাই এই লড়াইটা একইসঙ্গে সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, স্বরাজের আন্দোলন, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ‘পঞ্চ’ বা সবার সাধারণ স্বার্থ বা সমস্বার্থের বিষয়গুলি নিয়ে কাজ করার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার।
এই ব্যবস্থায় আমাদের মতো দেশে যা রসদ আছে তা বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোর মাধ্যমে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীলভাবে মানুষের সামাজিক উত্থান ঘটানো যায়। সমাজজীবনে ‘পঞ্চ’ বা পাঁচজনকে ডেকে মীমাংসার মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক উপাদান আছে, বিকল্পের খোঁজ আছে। পঞ্চায়েত মানেই হলো, ‘দশে মিলি করি কাজ/হারি জিতি নাহি লাজ’। মানুষের এই সমাজচেতনায় উত্তরণ এবং উত্থান ঘটানোর একটি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক হাতিয়ার হলো পঞ্চায়েত। কিন্তু শাসকশ্রেণির কাছে এই ক্ষমতায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার এসবের থেকে বেশি মুখ্য হলো দখলদারি। বামপন্থা এবং দক্ষিণপন্থার মধ্যে একটা মূলগত লড়াই এটা। ‘পাওয়ার টু দ্য পিপল অর পাওয়ার টু দ্য হ্যান্ড অফ আ ফিউ’ (‘মানুষের হাতে ক্ষমতা অথবা মুষ্টিমেয়র হাতে’)। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে এই নিরীখে দেখতে হবে।
গত দু’দশক যাবৎ এ দেশে লুটের অধিকার নিরঙ্কুশ কায়েম করতে বামপন্থীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা তীব্রতর করা হয়। এরাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি-আরএসএস, সব ধরনের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক ও উগ্রপন্থী শক্তি সমূহ সমস্বরে বলেছিল, ‘লাল হটাও’। কারণ যদি বামপন্থী ভরকেন্দ্র দুর্বল না হয়, তাহলে দক্ষিণপন্থীরা শক্তিশালী হবে না। এখানে দাঁড়িয়ে এরা সবাই মিলে তাই চেষ্টা করেছিল লাল হটানোর। এর পাশাপাশি ২০১৪ পরবর্তী সময়ে শুরু হয় বিভাজন। শুরু হয় আমাদের দেশের মানুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে বিনষ্ট করতে ধর্মের নামে, জাতপাত, ভাষা, জনগোষ্ঠী, আঞ্চলিকতার নামে মানুষকে লড়িয়ে দেওয়া । কারণ ঐক্যবদ্ধ মানুষই প্রতিরোধ গড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে বলা হলো, বামপন্থীরা আর বিরোধীরা দুর্বল হয়ে গেছে। আসলে মানুষের ঐক্য দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।
বিভাজিত মানুষ হীনবল - এই হিসেব কষেই এরপর দেশে বেলাগাম লুটের রাজত্ব কায়েম হয়। দিল্লিতে বিজেপি’র লুট, এখানে তৃণমূলের লুট। তারই অংশ হিসেবে এখানে মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধের অধিকারকে কেড়ে নিতে শুরু হয় ভোট লুট, বা মুখে ১০ বছর লিউকোপ্লাস্ট আটকে রাখার নিদান হাঁকা, আমাদের পার্টি অফিসগুলোর উপর হামলা, জরিমানা, মিথ্যা মামলা, জেল, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রোধ করা - এইসব। মিডিয়ার বড়ো অংশ বিজ্ঞাপনী লেনদেনের জেরে পোঁ ধরল বিজেপি-তৃণমূলের লড়াইয়ের বাইনারির। কারণ, ওরা চায়নি মানুষ তাঁর কথা বলুক, তাঁর অধিকারে সোচ্চার হোক। কারণ দক্ষিণপন্থার মানে হলো, মানুষের অধিকারকে খর্ব করা। এভাবেই ধাপে ধাপে পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিকে গা সওয়া করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু যখন বিভিন্ন জায়গায় টাকার পাহাড় দেখা গেল, লুটের সেই বিপুল পরিমাণ দেখে বিশ্বাসযোগ্য হলো দুর্নীতির একাধিক দিক। এই দুর্নীতিতন্ত্র, লুটতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চাওয়ার জন্যই প্রান্তিক মানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশীদারিত্ব শূন্য করতে এখানে দুর্নীতি-দুষ্কৃতী যোগ কাজ করছে।
এই লুটতন্ত্রকে বৈধতা দিতে মাঝে মাঝে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য বিবেক অবতারের আবির্ভাব হয়। যেমন ৫৬ ইঞ্চি। এই অবতার বলল, ‘আমি সব ঠিক করে দেবো’। কিন্তু একজন লুটেরা আর একজন লুটেরাকে আটকাতে পারে না কারণ, এই দক্ষিণপন্থীরা কেউই মানুষের অধিকার স্বীকার করে না। ওরা দেশের নদী, খনি, পাহাড়, জল, জঙ্গল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিমা, বন্দর রেলসহ সব সংস্থা লুটের মাল হিসেবে তুলে দিতে চায় আদানি-আম্বানিদের হাতে।
এই অবতারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে দেশের বৈচিত্র্যকে ভাঙতে সামাজিক প্রযুক্তির নানা অস্ত্র ব্যবহার করে বিভাজনপন্থা। এগুলি ব্যবহার করে সামাজিক বিন্যাস এবং সম্প্রীতির পরিবেশকে বানচাল করে দেওয়া হয়। তাই জনগণের একটা অংশের বিরুদ্ধে আর একটা অংশকে ক্ষেপিয়ে তুলে আগুন জ্বালানো হয়েছে। সেই আগুনেই মণিপুর গত দেড় মাস ধরে পুড়ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়া। পুড়ছে মন্ত্রীদের বাড়ি। এভাবে হয়তো সাময়িক কয়েকটা এমপি-এমএলএ-পঞ্চায়েত পাওয়া যায়, কিন্তু ভাগাভাগির স্ফুলিঙ্গটা পরিণত হয় দাবানলে, যা এখন হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১০০ জনেরও বেশি আহত তার ৩ গুণের বেশি। সঙ্ঘর্ষের ঘটনা পেরিয়েছে ৪হাজার। কিন্তু পারস্পরিক বৈচিত্র্যের ধারাকে বজায় রেখেই এই মানুষরা এত বছর পরস্পর প্রতিবেশী ছিলেন।
এর আগে ধীরেন লেটদের মতো মানুষকে যখন রাস্তায় অপমান করা হচ্ছিল তখন তার মধ্যদিয়ে সজ্জন মানুষদের কাছে একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছিল যে - ‘তুমি এই জায়গায় থেকো না, কারণ এটা তোমার জায়গা নয়’। এই ধরনের মানুষেরা তাই ধীরে ধীরে অপসৃয়মান। তৃণমূলের রাজনীতিতে কোনো ‘জীবিত সজ্জন’ নেই। দুর্নীতির মহাজনি কারবার চালাতে লাগে দুর্জন। বোমা বারুদ অস্ত্রে লম্প ঝম্প আসলে এই দুর্জনদের আস্ফালন এই দুর্নীতি তন্ত্রকে সচল রাখার উদ্দেশেই। দুষ্কৃতী সংযোগ ছাড়া দুর্নীতি বেশিদিন টেঁকেনা। তারা মনে করে, ওই দুর্নীতিলব্ধ টাকাতেই আমরা আমজনতাকে কিনে নিতে পারব!
কিন্তু ২০২৩ আর ২০১৮ সাল এক নয়। দুর্নীতি আর লুটের টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা তৃণমূল নেতাদের দেখে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা গ্রাম-শহরে জনরোষ বাড়তে থাকল। বিভিন্ন প্রকল্প থেকে বঞ্চিত মানুষরা চেপে ধরলেন তৃণমূলীদের। শহর-গ্রাম জুড়ে তীব্র জনরোষ তৈরি হলো। আদালত নির্দেশ দিল তদন্ত করার। সেই তদন্ত আটকাতেও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গেল তৃণমূল সরকার। আর অনেকেই বেড়া টপকে কেন্দ্রের শাসকদলের ঝুলিতে চলে এল।
ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ক্ষোভ কমাতে এই অবতারবাজির ভেক ধরে পাঠানো হলো ‘দিদির দূত’। বঞ্চিত মানুষ এইসব দূত নামের ভূতেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে আটকে দিল গ্রামে ঢোকার মুখেই। তাদের ‘আপ্যায়নে’র চোটে সেই ভূতেরা পালিয়ে বাঁচল। মুখ্যমন্ত্রীর ‘দূত’ আর রক্ষাকবচ মডেল ফেল করল, যেমন মোদির দূত রাজ্যপাল ফেল করেছেন এখন।
গত বছরের জুলাই মাসে দুর্নীতির আবহে আমরা বলেছিলাম ‘চোর ধরো, জেল ভরো’। পুলিশ চোর ধরল না। কিন্তু মানুষ পথে নামলেন। তারপর আমরা স্লোগান দিলাম, ‘গ্রাম জাগাও, চোর তাড়াও’। মানুষ সোচ্চার হলেন চোর ধরার দাবিতে। চাপ বাড়ল প্রশাসনের ওপর, কিছুটা সক্রিয় হলো কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলি। এভাবেই লড়াইয়ের পরিবেশও গড়ে তোলা গেছে লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রামে পথে নেমে। ধারাবাহিক সংগ্রাম খুঁজে নেয় নতুন রাজনৈতিক পরিসর। নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, গড়ে ওঠে নতুন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ। নতুন অংশকে যুক্ত করে আন্দোলন করতে গিয়ে সব অংশের যে দাবিদাওয়া, গণতান্ত্রিক অধিকার, তার জীবন-জীবিকার যে লড়াই নতুন পরিসরে সেগুলিকেই আবার আন্দোলন সংগ্রামের রূপ দিতে হয়। আমাদের লড়াই পরিবেশ বাঁচানোর, দেশ বাঁচানোর এবং দেশের মানুষের ঐক্য ও সম্প্রীতিকে বাঁচানোর। এই লড়াইটা দীর্ঘমেয়াদি। তারই সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত পঞ্চায়েতের এই লড়াই।
শ্রমজীবী মানুষ তার ঘামের দাম বুঝে নেবার জন্য শুধু এ রাজ্যে নয় দেশে দেশে সংগঠিত হয়েছে। নির্ণায়ক প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অধিকার বুঝে নিয়েছে। আর যখনই তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাদের ওপর শোষণ আরও চেপে বসেছে। সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ তাঁদের শক্তিকে সংহত করে শামিল হয়েছেন গ্রামীণ পদযাত্রায়। তারপর আমরা বলেছি বিজেপি-তৃণমূল বিরোধী সমস্ত শক্তিকে আমরা এ রাজ্যে একত্রিত করব। এখন তলায় ভূমিস্তরে বুথে বুথে যেতে হবে। জোর গলায় বলতে হবে অধিকার বুঝে নেবার জন্য নিজের ভোট নিজে দেবার কথা। পাড়ায়, মহল্লায় আওয়াজ উঠেছে, ‘গ্রামনগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরি হও’। যত গ্রাম জেগেছে, চোরেদের তত ধুকপুকুনি বেড়েছে। কারণ ‘অধিকার কে কাকে দেয়?/ অধিকার কেড়ে নিতে হয়’।
ওরা বলেছিল ভোট করবেনা। আমরা বলেছি, ‘চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি চ্যালেঞ্জ নাও, নির্বাচনের তারিখ দাও’। ওরা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। মনোনয়নের জন্য যে প্রক্রিয়া করা উচিত তার চেয়ে নাম প্রত্যাহারের জন্য ওরা বেশি ব্যস্ত। তাই বেশি সময় প্রত্যাহারে বরাদ্দ করলো। আর মানুষ নাছোড়বান্দার মতো তার লড়াকু মেজাজ দেখিয়ে ছিনিয়ে নিল তার ভোটে অংশগ্রহণ করার অধিকার। কুর্নিশ জানাই মানুষের এই সংগ্রামী চেতনাকে।
বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকৃত বিরোধী হলে কেন্দ্রীয় সরকারের ২৭ টা দপ্তরের এত প্রকল্প, সেখানে তারা হিসেবে কোথায় গরমিল, কোথায় কে কাটমানি খেয়েছে, কোথায় চুরি হয়েছে এসব সহজেই বের করে তৃণমূলের চোরদের ধরতে পারত। কিন্তু পারলেও ধরছে না। কিন্তু দুর্নীতি বেড়েই চলতে থাকল। গোটা কয়েক চুনোপুঁটি ছাড়া রাঘব বোয়ালদের গ্রেপ্তার করল না সিবিআই-ইডি। ভাইপোর নাম কয়লা দুর্নীতির চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হলো। পর্দার আড়ালে লোকসভা আর বিধানসভা আসনের দর কষাকষি বখরা সবই হলো। উল্টোদিকে বিজেপি-আরএসএস’র কোনো নীতিগত বিষয়ে সংসদে বা বাইরে কোথাও বিরোধিতা করেনি তৃণমূল, বোঝাপড়ার শর্ত বজায় রেখে। আবার এখন জামাই আদর করে বিজেপি প্রার্থীদের নমিনেশন জমা দিতে দেওয়া হলো। কিন্তু তার মধ্যেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজেপি নমিনেশন জমা দিতে পারেনি। আর তৃণমূল বিজেপির মধ্যে যে কোনো ফারাক নেই তা প্রমাণ করে দিল দুবরাজপুরের ঘটনা। দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির ১৭ নম্বর আসনে তৃণমূল প্রার্থীর মনোনয়ন স্ক্রুটিনিতে বাদ পড়ায় লড়াই দাঁড়ায় সিপিআই(এম) এবং বিজেপি’র। কিন্তু তৃণমূলীদের প্রবল হুমকির মুখে সিপিআই(এম) প্রার্থী মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য হন, জয়ী হয় বিজেপি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পর সেই বিজেপি প্রার্থী যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। প্রার্থীর ছেলের দাবি, আমরা বহু বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেসে রয়েছি, মাকে ভুল বুঝিয়ে বিজেপি প্রার্থী করেছিল।
প্রান্তিক মানুষের সরকারি ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ - এই বিকল্পের পথ থেকে সরাতে মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হলো না, প্রার্থী হতে আসা মানুষের ওপর বোমা, বন্দুক নিয়ে হামলা করলো দুষ্কৃতী আর পুলিশ। রক্ত ঝরল, প্রাণ গেল। নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে মানুষকে দূরে রাখতে ভাড়াটে গুন্ডাদের কাজে লাগিয়ে বিডিও অফিস-পঞ্চায়েত অফিস দখল করে বিরোধীদের ঢুকতে দিল না লুম্পেন বাহিনী। গরিব মানুষের ওপর নৃশংস দৈহিক আক্রমণ নামিয়ে এনে চেষ্টা করা হলো সন্ত্রাসের আবহাওয়া কায়েম করার। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ওপর এত আক্রমণ নামিয়ে আনা। প্রশাসনকে ব্যবহার করে, হুমকি দিয়ে বামপন্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের চেষ্টা করা হলো। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারল না ওরা। ওরা অর্থাৎ তৃণমূল-বিজেপি।
এই প্রথম দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার অবাধ নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের থেকে বাহিনী মোতায়েন না করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে ছুটেছে সওয়াল করতে জনগণের করের লাখ লাখ টাকা খরচ করে।
আর মানুষের যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রী তাকে কটাক্ষ করে বলছেন, ‘পাল্টা হবে’। যে কোনো দায়িত্বশীল সরকারের প্রথম কাজ হলো কেন মানুষ প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন তার কারণ খুঁজে বের করা। সরকার যদি সংবেদনশীল নাও হয়, সংবিধানসম্মত হলেও তাদের কাছ থেকে তো এটুকু আশা করা যায়। তার বদলে হুমকি, উস্কানি। আসলে উনি গ্রামের স্বঘোষিত মাতব্বর, দুষ্কৃতী গোষ্ঠী এবং তাদের জল্লাদ বাহিনীকে তাতাতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। কারণ বোঝা যাচ্ছে মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে পড়ায় তাদের গোটা বাহিনীকে চাঙ্গা করতে পারছেন না। অথচ এই চেষ্টাটা শুরু হয়েছিল গত আগস্ট মাসে ‘খেলা হবে দিবস’ থেকে। ঠিক ছিল দূতেরা যাবে রক্ষাকবচ নিয়ে। আসলে মানুষের প্রতিবাদকে শেষ করার উদ্দেশ্যে জল্লাদবাহিনীকে নামানোর চেষ্টা।
অন্যদিকে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে কালিমালিপ্ত, দল আর রাজ্য সরকারের দুর্নীতির মরচে ধরা চেহারা মেজে ঘষে শ্রী ফেরাতে ভেঁপু যাত্রার আয়োজন করতে হলো। কিন্তু কয়লাকে ধুলেও ময়লা যায় না। ঠিক এই সময়ই কিছু সুশীল সাকরেদ গজিয়ে উঠে এই সর্বাঙ্গে দুর্নীতির কালিমাখা শাসককে ‘নতুন সংস্করণ’ বলে বাজারে বেচতে তারা গাল ফুলিয়ে বুকনি ঝাড়তে আরম্ভ করে দিল।
দলদাস পুলিশের দলবাজি আরও বেআবরু হয়ে পড়ছে দিন দিন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় যখন পুলিশ মনোনয়নের সময় ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না সেখানে একই দিনে কে কাকে চোর বলল তার খোঁজে হুলুস্থুল ফেলে দিল।
সমবেত ছিছিক্কার আর নির্বাচনী বিপর্যয় আঁচ করে এখন ওরা বলছে তৃণমূল পঞ্চায়েতে না জিতলে কোনো সামাজিক প্রকল্প থাকবে না। মিথ্যা বলছে। ইতিহাস আমাদের দিকে। দেশের প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকেই আমরা বামপন্থীরা, সামাজিক বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প যা চালু ছিল তা পঞ্চায়েত স্তরে চালু করতে বাধ্য করেছি। দেশের প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে ১০০দিনের কাজের প্রকল্প সহ বহু নতুন প্রকল্প চালু করেছি। আমরাই দাবী তুলেছি বছরে ২০০ দিন কাজ দিতে হবে। আমরা কোনো প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়ছি না, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছি। এইসব প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে ওরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে এই প্রকল্পগুলি আরো মজবুত হবে, আরো বেশি বরাদ্দ হবে। এখন যে যতটা পাচ্ছে তার থেকে বেশি পাবে। আরো বেশি সংখ্যক মানুষ এইসব প্রকল্পের সুবিধা পাবে। সামগ্রিকভাবে সুবিধা প্রাপকের সংখ্যা এবং আর্থিক পরিমাণ বাড়বে, আমরা এই প্রকল্পগুলির ত্রুটি সংশোধন করতে চাই। আর এই মিথ্যাচারটা করা হচ্ছে নিরূপায় হয়ে, কারণ তৃণমূল এই দুর্নীতি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না।
লড়াইয়ের ময়দানে আমরা আছি। যাঁরা শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে তাঁদের আমরা লড়াইয়ে যুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ করছি। সেই প্রয়াস চলবে। আমাদের লক্ষ্য, এই লড়াইয়ে মানুষের ঐক্য যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা যেন আরো দৃঢ় হয়, ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি যেন না হয়। লুটেরাদের হটিয়ে বাংলার মানুষ পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করবে। মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তুলবে।