৬০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৩ জুন, ২০২৩ / ৭ আষাঢ়, ১৪৩০
আদালতে মুখ পুড়িয়েও নির্লজ্জ রাজ্যের সরকার ও নির্বাচন কমিশন
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
“২০১৮ আর ২০২৩ কিন্তু এক নয়। মানুষের সম্মিলিত, ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধেই অবসান হবে এই কালো দিনের।” গত সপ্তাহের লেখাটা যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকেই না হয় শুরু করা যাক। কারণ গত ১৬ থেকে ২২ জুন - ঘটনাবহুল। কলকাতা লাগোয়া ভাঙড়, দক্ষিণের দাসপুর থেকে মধ্যের বড়ঞা অথবা উত্তরের চোপড়া - হিংসা, হুমকি, মারধর যেমন চলেছে, তেমনই চলেছে প্রতিরোধও। পুরুষ পুলিশ মহিলা সিপিআই(এম) প্রার্থীকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে নিয়ে যাচ্ছে আর বাম কর্মীরা সমানে যুঝে যাচ্ছেন। মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্বের শেষ দিন, মঙ্গলবার, ২০ জুলাই বিকেলেই পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের নাড়াজোল গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিআই(এম) প্রার্থী সুষমা সাউ-এর এই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একইসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে বাম কর্মীদের হার না মানা লড়াইয়ের ছবি। শেষ খবর, সুষমা সাউ-এর মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যের সব জেলার জন্য পর্যাপ্ত বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করতে হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু এই নির্দেশ কার্যকর করার পরিবর্তে উলটে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় কমিশন এবং রাজ্য সরকার। যদিও গত ২০ জুন, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টেও বড়ো ধাক্কা খায় রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কমিশনকে ভর্ৎসনাও করে শীর্ষ আদালত।
শুনানি চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে সওয়াল জবাব পর্ব চলাকালীন কমিশন আদালতে জানায়, ৬১,৬৩৬ টি বুথের মধ্যে ১৮৯টি স্পর্শকাতর, এর জন্য অতিরিক্ত বাহিনীর প্রয়োজন আছে। তাই অন্যান্য ৫ রাজ্যের কাছে বাহিনীর জন্য আবেদন জানিয়েছে রাজ্য।
যার উত্তরে বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘প্রথমত নির্বাচন কমিশন হাই কোর্টের রায়কে অমান্য করতে পারে কীভাবে? কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, রাজ্যের কাছে পর্যাপ্ত পুলিশ নেই বলেই তো কমিশন আধ ডজন রাজ্যের কাছে সাহায্য চেয়েছে।’’
বিচারপতির আরও প্রশ্ন, ‘‘আপনাদের বাহিনীর প্রয়োজন, তা কোথা থেকে এলো তাতে আপনাদের কী? রাজ্য থেকে বাহিনী এলো, নাকি পাশের রাজ্য থেকে এলো, নাকি কেন্দ্রীয় বাহিনী এলো, এতে আপনারা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন? ভোটে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হলে সমস্যা কোথায়?’ আপনাদের এই এসএলপি-র (স্পেশাল লিভ পিটিশন) মানে কী?’’
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন করানো মানে হিংসার লাইসেন্স দেওয়া নয়, হিংসা কখনও নির্বাচনের সহযোগী হতে পারে না।
বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। এবারের নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বেও গণ্ডগোল হয়েছে। প্রার্থীরা মনোনয়ন দিতে পারছে না, জমা করলেও হিংসার সম্মুখীন হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনে কলকাতা হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করবে না শীর্ষ আদালত।
এদিন সুপ্রিম কোর্টের কড়া তিরস্কারের পর ২৪ ঘণ্টাও পেরোয় না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে ২২ জেলার জন্য মাত্র ২২ কোম্পানি, অর্থাৎ জেলা পিছু মাত্র এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে পাঠিয়ে ফের কলকাতা হাইকোর্টের তোপে পড়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী নিজের টুইটারে লেখেন, “জেলা পিছু এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী! পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ছ্যাবলামো করছে নির্বাচন কমিশন? মানুষের নিরাপত্তা আর কোর্টের নির্দেশ নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে? এহেন অসভ্যতা করে আইএএস কমিশনার নিজ ক্যাডারের মর্যাদা হানি করছেন। তেমনই নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব এবং নিরপেক্ষতাকে খাটো করছেন।’’ উল্লেখ্য, এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীতে সাধারণত ১০০ থেকে ১২০ জন সদস্য থাকেন। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজে লাগানো হয় মোটামুটি ৮০ জনকে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্তে কলকাতা হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করে বিরোধীরা। সেখানে ফের ভর্ৎসিত হন নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা। ২১ জুন বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম বাহিনী মোতায়েন এবং নির্বাচন পরিচালনার কাজে আদালতের নির্দেশের মান্যতা না দেওয়ায় তাঁর পর্যবেক্ষণে দায়িত্ব সামলাতে না পারলে রাজীব সিনহাকে পদত্যাগ করতে বলেন। তিনি এও বলেন, রাজ্যপাল নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘বলতে বাধ্য হচ্ছি এত কিছুর পরে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, কমিশনারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করতে হচ্ছে। ২০১৩ সালে এই কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। আমরা বুঝতে পারছি না সেই কমিশনের স্বতন্ত্রতার কী হলো?’’
আদালত আরও বলে, ‘‘হাইকোর্টের নির্দেশকে মান্যতা দেওয়া হয়নি। কমিশন সক্রিয় নয়, তাই কোর্টের নির্দেশ মানতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। আমরা কমিশনের উপরেই বাহিনী মূল্যায়নের ভার ছেড়েছিলাম। ১৭০০ না ৮ লক্ষ বাহিনী লাগবে সেটা ঠিক করা কি আদালতের কাজ?’’
প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের বেঞ্চ ২১ জুন স্পষ্ট জানায়, ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে যে সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তার থেকে বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। কারণ এবার একদফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৩ সালে ৫ দফায় ভোট হয়েছিল এবং ৮২৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।
এর আগে, গত ১৩ জুন স্পর্শকাতর ৭ জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। ৪৮ ঘণ্টা পরেও কমিশন স্পর্শকাতর জায়গা চিহ্নিত করতে পারেনি। এরপর ১৫ জুন হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, গোটা রাজ্যে কেন্দ্রীয়বাহিনীর নজরদারিতেই পঞ্চায়েত ভোট করাতে হবে। শুধু তাই নয়, এই নির্দেশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই কেন্দ্রের কাছে বাহিনী চাইতে হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার পরিবর্তে হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় কমিশন। সেখানেও ধাক্কা খায় কমিশন। হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখে শীর্ষ আদালত। এরপরই গোটা রাজ্যের ২২ জেলার জন্য মোট ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর আবেদন জানায় কমিশন।
অন্যদিকে ঘটনাচক্রে ২১ জুন, বুধবার রাতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে রাজীব সিনহার জয়েনিং লেটার ও সেই সম্পর্কিত সমস্ত ফাইল রাজ্য সচিবালয়ের কাছে ফেরত পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। রাজভবন সূত্রে খবর, মনোনয়ন পর্বে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে অশান্তির খবর আসছিল। সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য গত ১৭ জুন, শনিবার রাজীব সিনহাকে রাজভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল। কিন্তু মনোনয়ন পর্বে ব্যস্ত থাকার কারণ দেখিয়ে সেই বৈঠকে উপস্থিত হননি রাজীব সিনহা।
এই কারণেই এদিন রাতে সিনহার জয়েনিং লেটার এবং সংশ্লিষ্ট ফাইল গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, সেগুলিকে রাজ্য সচিবালয়ে ফেরত পাঠান রাজ্যপাল। পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার কমিশন অফিসে ঢোকার সময় এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাজীব সিনহা বলেন, ‘‘রাজ্যপাল জয়েনিং রিপোর্ট গ্রহণ করেননি, এমন কোনো তথ্য আমি পাইনি।’’
রাজ্যপালের এই পদক্ষেপের পর একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্য রাজনীতির অলিগলিতে। এরপর কি কমিশনার পদে থাকতে পারবেন সিনহা? রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে এক জনের নামে অনুমোদন দেওয়ার পরে তাঁর জয়েনিং লেটার কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? যদি সিনহাকে সরিয়ে দেওয়া হয় এই মুহূর্তে, সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েত নির্বাচন কি স্থগিত করা হবে? আগামী ৮ জুলাই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন। ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে রাজীব সিনহার কমিশন। বৃহস্পতিবার, ২২ জুন দুপুরেও কলকাতা হাইকোর্টের পক্ষ থেকে বিচারপতি অমৃতা সিনহা মন্তব্য করেন, তিনি এখনও তাঁর পদে রয়েছেন? বিচারপতির যে মন্তব্যকে অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহল।
এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘রাজীব সিনহা কমিশনার পদে থাকতে পারবেন কি না সে বিষয়ে মতামত দেবেন সংবিধান বিশেষজ্ঞেরা। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে গোড়া থেকেই ব্যর্থ হয়েছেন রাজীব সিনহা। আমরা মনে করি, তিনি আর রাজ্য কমিশনার পদে থাকার যোগ্য নন। কারণ, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজ্যের ৮ জন নিরীহ মানুষ শাসকদলের সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন।’’
এরকম ভেবে নেবার কোনো কারণ নেই যে, পঞ্চায়েত নিয়ে বিতণ্ডার এখানেই শেষ। উলটে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন ঘটনা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে সেই বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তাই তড়িঘড়ি মন্তব্য না করে বরং নজর রাখা যাক পরিস্থিতির ওপর।