৬০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৩ জুন, ২০২৩ / ৭ আষাঢ়, ১৪৩০
২০ জুন... ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ ভাবার কোনো কারণ নেই
সুদিন চট্টোপাধ্যায়
কলকাতার ‘রাজভবন’ থেকে বিবৃতি প্রকাশ করে ২০ জুন, ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার নাকি ভারতের সব রাজ্যেই, সে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এমন এক একটি বিশেষ দিন বাছাই করে পালন করার কথা বলেছে।
‘রাজভবন’ কোনোদিন সাধারণ মানুষের আবেগ ও ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করেনি, আজও করে না। ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকারবাহী এই ভবন থেকে চিরকালই ক্ষমতার ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের জন্যে ‘কানুন’ জারি হয়েছে; সাহিত্য, সংস্কৃতি বা ইতিহাস-ঐতিহ্যের গৌরব মুহূর্ত নির্ধারণের কোনো তাগিদ বা ব্যাকুলতার সঙ্গে ‘রাজভবন’ কোনোদিন জড়িত ছিল এমন উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই।
কেন্দ্রের বর্তমান সরকার বা তাদের অনুগত রাজভবন, ভারতের মানুষকে এক ও ঐক্যবদ্ধ দেশবাসী হিসেবেই ভাবে না। ধর্মের, জাতের, ভাষার, ভাবনার ভিন্নতার কথাই তারা বারবার মনে করিয়ে দেয়। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের যে সাধনা ভারতের আত্ম-আবিষ্কারের পরম্পরায় নিহিত তাকে অগ্ৰাহ্য করা বা অনুমোদন না করাই এদের প্রধান কর্মসূচি। ২০শে জুন পালনের ডাক তারই অঙ্গ।
এদের বক্তব্যঃ ২০ জুন ১৯৪৭, অখণ্ড বাংলার ব্যবস্থাপক সভা ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে পুবে ও পশ্চিমে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাই আমরা পেয়েছি আজকের এই ‘পশ্চিমবঙ্গ’। সেই জন্য ২০ জুনই ‘পশ্চিমবাংলা দিবস’ হিসেবে পালনীয় ও স্মরণীয়। এই দিনটি নাকি এই রাজ্যের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আসলে এই সমূহ ঘটনার পেছনে যে মানুষটির ছায়া, সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে বকলমে স্মরণ করার এ এক নতুন কৌশল। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাঙালির হৃদয়ে সে আসন পাননি, যে আসনে তাঁকে আরএসএস কিংবা বিজেপি দেখতে চায়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, দুর্ভিক্ষের দিনে বাংলার খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন, নেহরু মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ বাঙালির অন্তরে কোনোদিন ছিলেন না। তাঁর অনুগামী ছিলেন হিন্দু মহাসভাপন্থী, ধর্মীয় মেরুকরণে বিশ্বাসী মুষ্টিমেয় বাঙালি।
আমাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার - যে যুক্তিতে ২০ জুন পালনীয় বলে তাঁরা বলছেন, ওই একই যুক্তিতে তারিখটি বেদনার ও কলঙ্কের দিন। এর সঙ্গে এমন কিছু আনন্দ বা গৌরব জড়িয়ে নেই যে ঢাক ঢোল পিটিয়ে এই দিনটিকে আমরা আলাদা করে স্মরণ করব। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার বিভাজন সর্বঅংশের ‘বাঙালি’ চায়নি, চেয়েছে হাতে গোনা কিছু স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দ। তাই বাঙালির যত দুর্ভাগ্য, অবক্ষয় ও আর্তনাদ তার ইঙ্গিত ও সূত্রপাত বিশ জুনের গায়ে জড়িয়ে আছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক এবং বিয়োগান্তক অধ্যায় দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজন। এই পরিণতির কথা বলতে গিয়ে গান্ধীজি সেই হৃদয় বিদারক মন্তব্যটি করেছিলেনঃ “What an inglorious end of a glorious struggle” - রক্ত, ঘাম আর অশ্রুর আলপনায় আঁকা প্রায় দুশো বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের এ কী অন্যায়, অগৌরবজনক পরিসমাপ্তি। তাই ২০ জুনের সঙ্গে বাঙালির কষ্টের, অনুশোচনার এবং গভীর অপরিতৃপ্তির ইতিহাস জড়িয়ে, যেমন জড়িয়েছিল ১৯০৫-এর ‘বঙ্গভঙ্গ’ দিনটির সঙ্গে।
ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে একটু পেছনের দিকে তাকাতে বলি... ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখেই আন্দাজ করা গিয়েছিল কী হতে চলেছে... এই দিনটিতে তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, ১৯৪৮-এর ৩০ জুনের মধ্যে ভারতের শাসনভার ভারতের হাতেই ছেড়ে দিয়ে ইংরেজরা ভারত ত্যাগ করে চলে আসবে ,‘‘The British Government would quit India by 30 June 1948 at the latest’’। তিনি আরও যোগ করেছিলেন - হিন্দু মুসলমানের স্বার্থের দ্বন্দ্ব মিটিয়েই তাঁরা ভারত ছাড়বেন।
হিন্দু-মুসলমান স্বার্থ দ্বন্দ্ব কীভাবে মিটবে তা পরিষ্কার হয়ে গেলো ১৯৪৭ সালের ২ জুন দিল্লিতে ‘‘মাউন্টব্যাটন মিশন’’-এর সভায়। ক্ষমতা হস্তান্তর এবং দেশ বিভাজনের যে খসড়া বড়োলাট মাউন্টব্যাটনের নির্দেশে ভি. পি. মেনন তৈরি করেন তাকেই বলা হয় ‘‘মাউন্টব্যাটন মিশন’’।
২ জুন তার পূর্ণ সমীক্ষা ও বিচার বিশ্লেষণের জন্যে বড়োলাটের সঙ্গে এক টেবিলে আলোচনায় বসেন কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল এবং আচার্য কৃপালিনি; মুসলিম লীগের পক্ষে মহম্মদ আলি জিন্না, আবদুর রব নিশতার এবং লিয়াকত্ আলি খান আর শিখ সম্প্রদায়ের পক্ষে বলদেব সিং। ভাবতে অবাক লাগলেও এটি ইতিহাসের সত্য যে কোটি কোটি মানুষের এই দেশ, বিচিত্র ও বিস্ময়কর সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বাসভূমির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করলেন ৭ জন ক্ষমতাকাঙ্খী রাজনীতিক এবং তা হলো ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দেশ ভাঙার সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে।
মর্মান্তিক এই সিদ্ধান্তের ওপর অনুমোদনের সিলমোহর পড়ে গেল ৩ জুন ১৯৪৭ তারিখে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি’র ‘3rd June Plan’ ঘোষণা হলো এই দিনটিতে। সন্ধ্যায় দিল্লি বেতারে ভারতবাসীকে মাউন্টব্যাটন অবহিত করলেন যে, ভারত হবে দ্বিখণ্ডিত, পাঞ্জাব এবং বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ ঘটবে। অতএব ধর্মের দোহাই পেড়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্বে ও পশ্চিমে বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণের সিদ্ধান্ত ১৯৪৭-এর জুন মাসের ৩ তারিখেই পাকা হয়ে গিয়েছিল, ২০ জুনের ব্যবস্থাপক সভার সিদ্ধান্ত লোকদেখানো নিয়মরক্ষা মাত্র।
৩ জুন-এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি’র ঘোষণা শুনে বিষাদমগ্ন হয় গোটা দেশ, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাব এবং বাংলার বিভিন্ন এলাকায়, হুড়োহুড়ি পড়ে যায় দেশত্যাগের। ঘরদোর, ভিটেমাটি, নিজের আস্তানা ও আকাশ ছেড়ে ছিন্নমূল মানুষের অসহায় কলরব ও কান্নায় ভিজে ওঠে দুপারের মাটি, উৎপাটিত হয় মানবতার মর্যাদা আর মনুষ্যত্বের মৌল আদর্শ। এই তারিখের সঙ্গে বাংলার ও বাঙালির কোনো গৌরবগাথা সম্পৃক্ত হয়ে নেই যে আমরা তাকে স্বতন্ত্র মহিমায় স্মরণ করব?
এই দিনটিকে যদি স্মরণ করতেই হয় তো স্মরণ করব ১৭৫৬ সালের ২০ জুনকে... যেদিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। স্মরণ করব ১৭৮৯ সালের ২০ জুন, যেদিন বিশ্ববিবেক আলোড়িত করে ফ্রান্সে উদ্ধত স্বৈরাচারী বুরবোঁ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, মানুষের ইতিহাসে যার সগৌরব পদধ্বনি বার বার শোনা গেছে। ২০ জুনকে স্মরণ করব ‘বিশ্ব ছিন্নমূল দিবস’ হিসেবে... কারণ রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে এই দিনটি জন্ম মৃত্তিকা থেকে উচ্ছিন্ন মানুষের হত্যা ও হাহাকারের স্মরণে নতমস্তক ব্যথায় পালিত হয়ে আসছে। ২০ জুনকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসেবে পালন করার অবশ্যই কোনো ইতিহাস গ্ৰাহ্য ও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।