৫৮ বর্ষ ১১শ সংখ্যা / ২৩ অক্টোবর ২০২০ / ৬ কার্ত্তিক ১৪২৭
গান্ধী হত্যা এবং সাভারকর
গৌতম রায়
আদালতে গান্ধী হত্যায় অভিযুক্ত নাথুরাম, সাভারকর (পিছনের সারিতে চশমা ও টুপি পরে), আপ্তে সহ অন্যান্যরা।
মহাত্মা গান্ধী হত্যা বিষয়ক প্রথম অভিযোগটি দিল্লির তুঘলক রোড থানায় জমা করেন নন্দলাল মেহতা। তিনি সেদিন (১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি) উপাসনা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। সেই বিবরণ ছিল উর্দুতে লেখা। গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে সাভারকরের সম্পর্ক ঘিরে কোনো চাপানউতোর ছিল না। গান্ধী হত্যাকারী গডসের ভাই গোপাল গডসে, এই ঘনিষ্ঠতার কথা ১৯৬৯ সালের ১৩ মে ওয়ান্টর অ্যান্ডারসনকে পর্যন্ত বলেছিল (ইকোনমিক পলিটিক্যাল উইকলি - ২৫\০৪\১৯৭২, পৃষ্ঠা-৬৮১)। এই পরিচয় ১৯২৯ সাল থেকে ছিল। ১৯৪৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, তদানীন্তন বম্বে প্রভিন্সের জননিরাপত্তা রক্ষা আইন (’৪৭) অনুযায়ী গান্ধী হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাভারকরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার অব্যবহিত পরেই (২২\০২\১৯৪৮) মুক্তি ভিক্ষা করে ব্রিটিশের মতোই স্বাধীন দেশের সরকারের কাছে একটি মুচলেকা দিলেন তথাকথিত ‘বীর’ সাভারকর। সেই মুচলেকায় সাভারকর বললেনঃ সরকার যদি তাঁকে মুক্তি দেন, তাহলে তার শর্ত যদি হয়, সরকারের ইচ্ছা যতদিন হবে, ততদিন সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে কোনোরকমভাবেই সংযুক্ত থাকবেন না।
সাভারকর নিজেই স্বাধীনতার পর স্বীকার করে নিলেন যে, তিনি সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই স্বীকারোক্তি সাভারকরের কিসের কৌশল ছিল, সে সম্পর্কে কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতারা এখনো পর্যন্ত নতুন করে কোনো তত্ত্বের অবতারণা করেন নি। তবে পরবর্তী জীবনে রাজনীতি বা সাম্প্রদায়িকতা - কোনো কিছু থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেন নি সাভারকর।
গান্ধী হত্যার অব্যবহিত পরেই বম্বে প্রভিন্সের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার জে এস ভারুচা দেখা করেছিলেন সাভারকরের সঙ্গে। সেই সাক্ষাতে গান্ধী হত্যার সঙ্গে নিজের বিন্দুমাত্র সংযোগের কথা সাভারকর স্বীকার করেন নি। তবে সাভারকরের সেদিনের ভূমিকা যে তাঁর কাছে প্রবল সন্দেহজনক ঠেকেছিল সেকথা গান্ধী হত্যা সংক্রান্ত বিচারবিভাগীয় যে কমিশন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জীবনলাল কাপুরের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল, সেই কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জে এস ভারুচা খুব স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন।
কাপুর কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, মহাত্মা গান্ধী হত্যার অব্যবহিত পরে জে এস ভারুচার সঙ্গে সাভারকরের যে সাক্ষাৎ, সেইখানেই সাভারকরের গান্ধী হত্যা সম্পর্কিত কথাবার্তাগুলি ভারুচার কাছে চরম অপরিচ্ছন্ন, গোলমেলে এবং পরস্পর-বিরোধী বলে মনে হয়েছিল।বম্বে প্রভিন্সের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে সেইকথা ভারুচা তৎক্ষণাতই জানিয়েছিলেন (পাঠক মনে রাখবেন, এই মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন জনসঙ্ঘের যে বাজপেয়ী, আডবানি সেই মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে সেলুলার জেলের যে কক্ষে সাভারকর ছিলেন, সেই কক্ষে গিয়ে অনেক আবেগমাখা কথা বললেও, সেলুলার জেলে গিয়ে সেই কক্ষে একটিবারের জন্যেও যান নি প্রধানমন্ত্রী দেশাই)। খুব স্পষ্টভাবেই ভারুচা দেশাইকে বলেছিলেনঃ তাঁর গভীর অনুমান গান্ধীহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সাভারকর।
সাভারকরকে কেন গ্রেপ্তার করেন নি ভারুচা, সেই প্রশ্ন সরাসরি তাঁকে দেশাই করেছিলেন বলে কাপুর কমিশনে ভারুচা বলেন। ভারুচা যখন সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেন, সেইসময়ে যাতে গান্ধীহত্যার কারণে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার না করে, সেজন্যে অসুস্থতার অভিনয় করেছিলেন সাভারকর।জামশেদ ডি নাগরওয়ালার (ইনি বম্বে পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ছিলেন) কাপুর কমিশনে দেওয়া সাক্ষ্য থেকে সাভারকরের এই অসুস্থতাজনিত অভিনয়ের বিষয়টি জানা যায়। ভারুচার মতো দক্ষ পুলিশ অফিসারও সাভারকরের গ্রেপ্তারি আটকাতে অসুস্থতার অভিনয়ের বিষয়টি ঠিক মতো ধরতে পারেন নি। তবে প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তর থেকে যে সাভারকরের বাড়ির উপর নজরদারি করা হচ্ছিল, সেটি কাপুর কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় (কাপুর কমিশনের প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠা-৪৪ থেকে ৪৭)।
মদনলাল পাহওয়াল নামক পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা এক শরণার্থীর সাক্ষ্য থেকে গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে গোলওয়ালকরের ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যগুলি যে সমসাময়িককালে মোরারজি দেশাইয়ের মতো রাজনীতির বরিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং জামশেদ ডি নাগরওয়ালার মতো পুলিশ প্রশাসনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও যে এই তথ্যগুলি জানতেন, পরবর্তীকালে তার নিশ্চিত তথ্য মিলেছে (আই কুড নট সেভ বাপু - জগদীশ চন্দ্র জৈন, প্রকাশক-জাগরণ সাহিত্য মন্দির, কামাচা, বারাণসী, ১৯৪৯)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পপরেই হিন্দুত্ববাদীরা গান্ধীজিকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ’৪৮ সালের ২০ জানুয়ারিতে বিড়লা ভবনেই। এই কাণ্ডের সঙ্গে নাথুরাম গডসে, নারায়ণ ডি আপ্তে, বিষ্ণু কারকারে, দিগম্বর আর ব্যাজ, ব্যাজের পরিচারক শঙ্কর কিস্তাইয়া যুক্ত ছিল। মোরারজি দেশাই এবং বম্বে প্রভিন্সের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (তখনও রাজ্যের শাসক প্রধানকে প্রিমিয়ার বা প্রধানমন্ত্রী বলা হতো) বি জি খের’কে জগদীশ চন্দ্র জৈন বিষয়টি জানান (জৈনের গ্রন্থের পৃষ্ঠা-৪২)। বম্বে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২১ জানুয়ারিই দিল্লির বিড়লা হাউস, যেখানে গান্ধীজি ছিলেন, সেই বাড়ির পিছনে বিস্ফোরণ ঘিরে বম্বের ডেপুটি কমিশনারকে সাভারকরের বাড়ির উপর নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়, বিষ্ণু কারকারে’কে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ওই বিস্ফোরণকাণ্ডের সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কি না তা খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয় (জৈনের গ্রন্থের পৃষ্ঠা-৮০)। সাভারকরের বাড়িতে নজরদারি ঘিরে যে যথেষ্ট পেশাদারিত্বের পরিচয় রাখা হয় নি, সেকথা নাগরওয়ালা কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গে কাপুর কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে স্বীকার করেছিলেন। দিল্লি পুলিশের সঙ্গে বম্বে পুলিশের সমন্বয়ের অভাবের যে প্রসঙ্গটি বিচারপতি কাপুর তাঁর প্রতিবেদনে বলেছিলেন, সেটির রাজনৈতিক মাত্রা কী উড়িয়ে দেওয়া যায়? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, গান্ধী হত্যায় দেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা ঘিরে জয়প্রকাশ নারায়ণ সেদিন তদন্ত দাবি করেছিলেন। বাংলার তদানীন্তন প্রিমিয়ার ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষও একই দাবি জানিয়েছিলেন।
গান্ধী হত্যা সংক্রান্ত মামলায় উকিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সাভারকরের ভূমিকা ঘিরে অবশ্য ঘোরতর নেতিবাচক মানসিকতা সর্দার প্যাটেল দেখিয়েছিলেন। মামলাতে সওয়াল করার কালে গান্ধী হত্যায় সাভারকরের ভূমিকা, যোগসাজশ এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সাভারকরের ভূমিকা ঘিরে কখনোই সংশয়ী ছিলেন না প্যাটেল। বম্বের প্রাদেশিক আইনসভাতে গান্ধী হত্যায় সাভারকরের ভূমিকা ঘিরে চরম উষ্মাসূচক মন্তব্য করেছিলেন মোরারজি দেশাই ’৪৮ সালের ৩ এপ্রিল।
দ্ব্যর্থহীন ভাষাতে সর্দার প্যাটেল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুকে লিখেছিলেনঃ বাপু হত্যার ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছিল সাভারকর এবং হিন্দু মহাসভার একটি অংশের দ্বারা। এই অংশটিই প্রতিদিন বাপুকে পৃথিবী থেকে সরাবার ষড়যন্ত্রের কাজটি নিজেরা পর্যবেক্ষণ করেছে। বাপুর ভাবধারার যারা বিরোধী ছিল, সেই আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার লোকেরা বাপু শহিদ হওয়ার পর, সেই হত্যাকাণ্ড ঘিরে রীতিমতো আনন্দ করেছে এবং হত্যাকারীদের অভিনন্দিত পর্যন্ত করেছে (কাপুর কমিশনের প্রতিবেদন, প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৪৩)।
বাঙালি হিসেবে আমাদের চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, গান্ধী হত্যাকারী সাভারকরকে বাঁচাতে নানা ধরনের চেষ্টা চলিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৮ সালের ৪মে সর্দার প্যাটেল’কে শ্যামাপ্রসাদ লিখছেনঃ সাভারকরের নামটি উল্লিখিত হয়েছে গান্ধী হত্যা প্রসঙ্গে, একথা জানলাম। যদিও সাভারকরের বিরুদ্ধে কী প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা এখনো আমার জানা নেই। আমার বিশ্বাস, সাভারকরের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ঘিরেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা চলছে না (সর্দার প্যাটেলস করেসপনডেন্স, সম্পাদনা দুর্গা দাস, নবজীবন পাবলিশিং হাউস, আহমেদাবাদ, ১৯৪৫-১৯৫০, ষষ্ঠ খণ্ড। এখানে ১৯৭৩ সালের সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে। পৃষ্ঠা- ৬৩)।
এই চিঠির উত্তরে সর্দার প্যাটেল খুব স্পষ্টভাবেই শ্যামাপ্রসাদকে জানিয়েছিলেন যে, গান্ধীহত্যার সঙ্গে সাভারকরের সংযোগের বিষয়টির ভিতরে এতোটুকু রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই। সাভারকরের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ঘিরে যে আপত্তিকর দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সেই আপত্তির বশবর্তী হয়ে কোনো রাজনৈতিক বা ব্যক্তিবিদ্বেষের দ্বারা তাড়িত হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সাভারকরকে যুক্ত করবার কোনোরকম প্রশ্নই আসছে না। প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে সাভারকরকে কোনো অবস্থাতেই যুক্ত করা হবে না - একথা স্পষ্টভাবে চিঠির জবাবে শ্যামাপ্রসাদকে জানিয়েছিলেন সর্দার প্যাটেল (ঐ, পৃষ্ঠা-৬৫)।
গান্ধীহত্যা ষড়যন্ত্রের বিশেষ সহযোগী দিগম্বর ব্যাজের সাক্ষ্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, গান্ধীহত্যার সঙ্গে যুক্ত নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তে এবং দিগম্বর ব্যাজ ’৪৮ সালের ১৪ এবং ১৭ জানুয়ারি তারিখে বম্বেতে সাভারকরের বাড়িতে গিয়েছিল। ব্যাজ সাক্ষ্যে বলেঃ শেষ যেদিন (১৭ জানুয়ারি, ’৪৮) তারা যখন সাভারকরের বাড়ি থেকে চলে আসছে, তখন সাভারকর তাদের ‘যশস্বী হৌন ইয়া’, অর্থাৎ ‘সফল হয়ে এসো’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। সাক্ষ্যে ব্যাজ আরও বলেন যে, সেদিন সাভারকরের বাড়ি থেকে ফেরার পথে, সাভারকরের এই আশীর্বাণীর রেশ টেনে নারায়ণ আপ্তে বলেছিল, তার এই আশীর্বাদ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, সাভারকরের অনুমান, গান্ধীর যুগ শেষ। আপ্তে আরও বলেছিল, সাভারকরের এই আশীর্বাদ থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, তাদের মিশন সফল হবে।
রবার্ট পেইন তাঁর দীর্ঘ গবেষণায় (দি লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব মহাত্মা গান্ধী, ১৯৬৯) দেখিয়েছেন, আইনের ফাঁক গলে কিভাবে এই গান্ধীহত্যার দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন সাভারকর। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশের তৈরি ফৌজদারি আইনের ফাঁকগুলির কথাই ইতিহাসবিদ থেকে আইনজ্ঞ - সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।
মামলায় আত্মপক্ষসমর্থনের সময়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের কোনো সংযোগ ছিল না, এটা বোঝাতে দীর্ঘক্ষণ নানা অপ্রাসঙ্গিক কথার অবতারণা করেছিলেন সাভারকর। সেই অপ্রাসঙ্গিক কথার ভিতরে হিন্দুরাষ্ট্রের শেয়ার বিক্রি থেকে হায়দরাবাদের নিজাম সরকারের বিরুদ্ধে অসামরিক প্রতিরোধ - এই ধরনের বিষয় যেগুলির সঙ্গে গান্ধীহত্যা সংক্রান্ত মামলার এতটুকু সম্পর্ক নেই। দীর্ঘসময় ধরে সেইসব প্রসঙ্গের অবতারণা করে বিচারকদের মূল বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কেই বিভ্রান্ত করে দিয়েছিলেন সাভারকর। ব্যাজের সাক্ষ্যকে যে ধূর্ততার সঙ্গে অসাড় বলে প্রতিপন্ন করতে চাইলেন সাভারকর এবং সেই চাওয়ার দ্বারা প্রভাবিত হলেন বিচারপতিরা, তা ঘিরে ভিন্নধারার ভাবনার অবকাশ আজও শেষ হয়ে যায় নি। (গান্ধীহত্যা মামলার ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর তারিখের বিস্ফোরণের অনুচ্ছেদ ৭, ৮, ৯-এ এই প্রসঙ্গ বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। জাতীয় মহাফেজখানায় রক্ষিত এই তথ্যগুলি দেখার ক্ষেত্রে নিবন্ধকার প্রয়াত সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের কাছে গভীরভাবে ঋণী)।
নাথুরামের ভাই, গোপাল গডসের মারাঠী ভাষায় লেখা, ‘gandhi hatya, and m’, অর্থাৎ, গান্ধীহত্যা এবং আমি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। গোপাল গডসের এই গ্রন্থ থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, গান্ধীহত্যার যাবতীয় দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আদালতে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলেছিলেন সাভারকর। আত্মপক্ষ সমর্থনে সাভারকরের প্রতিটি বক্তব্য যে মিথ্যে ছিল, তা ঘটনাগুলি সম্পর্কে নাথুরামের ভাই গোপাল গডসের লেখাতেই প্রমাণিত। মজার বিষয় হলো, গোপাল গডসে এই বইটি দীর্ঘদিন ধরে লিখলেও, সাভারকরের জীবিতাবস্থায় কিন্তু বইটি দিনের আলোর মুখ দেখে নি। ১৯২৯ সালে নাথুরামের বাবা পেশাসূত্রে আসেন রত্নগিরিতে। সেই সময় থেকেই যে নাথুরাম এবং গোপাল গডসের সঙ্গে সাভারকরের ঘনিষ্ঠ পরিচয় গড়ে উঠেছিল, সেটি গোপাল গডসের লেখা থেকেই জানতে পারা যায়।এ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নাথুরামের সঙ্গে মামুলিভাবে নিজের পরিচয় হওয়ার যে বিবরণ আদালতকে সাভারকর দিয়েছিলেন, সেটি ছিল মিথ্যে। নাথুরামের ভাই গোপালের সঙ্গে নিজের পরিচয় না থাকার যে তথ্য আদালতকে সাভারকর দিয়েছিলেন, গোপাল গডসের লেখার মাধ্যমেই জানা যায় সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যে তথ্য।
কলিন্স এবং ল্যাপিয়র তাঁদের ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ গ্রন্থে লিখছেনঃ সাভারকরকে সহযোগী এবং অনুকরণযোগ্য হিসেবে নাথুরাম যে’ভাবে পেয়েছিলেন, তেমনটা একনিষ্ঠভাবে ভারতে আর কোনো নেতার ভিতরে পারস্পরিক সংযোগ দেখতে পাওয়া যায় না। ভারতের সর্বত্রই সাভারকরকে অনুসরণ করতেন গডসে (পৃষ্ঠা-৩৬৪)। গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলেন তা বোঝাতে কলিনস এবং ল্যাপিয়র বিড়লা হাউসে গডসের প্রবেশের বিষয় এবং সেই প্রবেশের নীলনকশা তৈরিতে সাভারকরের বুদ্ধি, পরামর্শের কথা বলেছেন (দি স্টোরি অব দি রেডফোর্ড ট্রায়াল, পি এল ইমানদারের [পপুলার পাবলিশিং, বম্বে] গ্রন্থেও এ সম্পর্কে বহু তথ্যপ্রমাণ আছে। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ১৪১ পৃষ্ঠা দেখুন)।