৫৮ বর্ষ ১১শ সংখ্যা / ২৩ অক্টোবর ২০২০ / ৬ কার্ত্তিক ১৪২৭
দিল্লির বায়ুদূষণের সমস্ত দায়বদ্ধতা কি কৃষকের?
তপন মিশ্র
মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট গত ৬ অক্টোবর পরিবেশরক্ষায় কৃষকদের দায়িত্ব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মতপ্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে যে, দিল্লির চারপাশে থাকা রাজ্যগুলি যেমন হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে কোনো কৃষক যদি মাঠে ফসলের অবশিষ্টাংশ অর্থাৎ ন্যাড়া পোড়ান তাহলে তাঁর ফসলের ন্যূনতম মূল্য (মিনিমাম সার্পোট প্রাইস-এমএসপি) দেওয়া আটকে রাখার বাপারে আদালত ভাববে। ফসলের ন্যূনতম মূল্য সরকারের দেওয়ার কথা। যদি কৃষক ফসলের ন্যূনতম মূল্য না পায় তাহলে হয় তাকে বাজারে বিক্রি করতে হবে বা তার ফসল বিক্রি হবেনা। এভাবেই কৃষককে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি আদালত ভাববেন। আদালতে দিল্লি এনসিআর অঞ্চলে (ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন) বায়ুদূষণ সম্পর্কিত একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানির সময়ে আদালত এই মত প্রকাশ করে। আদালত নিশ্চয়ই ঝড়ের গতিতে পার্লামেন্টে পাস হয়ে যাওয়া তিনটি কৃষিবিলের কথা জানেন। মান্ডি যদি বাজারের হাতে যায় তাহলে সরকারের ফসলের ন্যূনতম মূল্য ঘোষণা করা না করা সমান হয়ে যাবে। আমরা দূষণের দায়বদ্ধতার মধ্যেই আবদ্ধ থাকি।
এটি একটি প্রচলিত ইতিবাচক মত যে, দূষকদের দূষণ হ্রাসের দায়িত্ব নিতে হবে (Polluters Pay)। আপনি যদি রাস্তায় বা সর্বজনীন স্থানে ময়লা ফেলেন তার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু আপনার শহরে যে সরকারি বা বেসরকারি নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে তার দূষণের ভার কার? রাস্তা তৈরি বা সারাইয়ের সময়ে যে কালো ধোঁয়া গল গল করে বের হয় তার দায়িত্ব কার? দীপাবলিতে কিছু উন্মত্ত মানুষের নিষিদ্ধ বাজি পোড়ানো রোধের দায়িত্ব কার? Polluters Pay নীতি যদি সবার পালনীয় হয় তাহলে আরও কয়েকটি এফএকিউ (Frequently Asked Questions)-এর জবাব আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। যেমন -
১) সমস্ত দূষকরাই কী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই মতামতের আওতায় আসবেন? যেমন, দেশের বড়ো বড়ো উদ্যোগপতি বা কর্পোরেট এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান যারা খনি বা কলকারখানা তৈরির সময় দূষণমাত্রার তোয়াক্কা করেন না তাদের কি হবে?
২) কৃষিক্ষেত্রে কেবল ন্যাড়া পোড়ানোর মধ্য দিয়ে দূষণ হয়না, কীটনাশক বা অত্যধিক সারের ব্যবহারেও দূষণ হয়। যদি ন্যাড়া পোড়ানোর জন্য এখন দূষণের দায়ে কৃষক দুষ্ট হয় তাহলে পরবর্তী সময়ে কীটনাশক ব্যবহারের কারণেও জনস্বার্থ মামলা হতে পারে?
৩) একটি খনি বা কারখানা বা রাস্তা তৈরির জন্য জঙ্গল কেটে দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিকারের জন্য ইআইএ এবং ইএমপি-র মতো ব্যবস্থা আছে, তা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান দূষণ ও উষ্ণায়নে আমরা জর্জরিত। ইদানিংকালে কর্পোরেটদের দূষণের দায় থেকে মুক্ত করতে যে জরিমানা হয় সেই জরিমানা ছাড় দেওয়ার সরকারি প্রবণতা প্রায়শই দেখা যায় কেন?
৪) কৃষকের মাঠে ন্যাড়াতে কে আগুন দেবে বা পাশের মাঠ থেকে সেই আগুন ছড়াবে কিনা তার নজরদারি কে করবে?
৫) সরকারকেও জবাব দিতে হবে যে, গরিব কৃষকের ন্যাড়ার বোঝা যদি তাকেই বইতে হয় তাহলে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনক্ষেত্রে সরকারের দায়বদ্ধতা কতটুকু?
সঙ্গে কয়েকটি তথ্য যুক্ত করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। দিল্লির মধ্যেই বায়ুদূষণের অনেক উৎস আছে। যেমন বেশ কিছু বেআইনি কলকারখানা দূষণ ছড়াচ্ছে কিন্তু কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার নির্বিকার। দিল্লির মধ্যে সরকারি যানবাহন কম থাকায়, করোনা থেকে বাঁচার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। দিল্লির উপকণ্ঠে ময়লা পোড়ানো এবং অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ দূষণ বৃদ্ধির বড়ো উৎস। কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী বলছেন যে, দিল্লির দূষণের মাত্র ৪-৫ শতাংশ আসে ন্যাড়া পোড়ানো থেকে। এই তথ্যের সুত্র নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ টন ন্যাড়া এখানে পোড়াতে হয়। গত বছর মাত্র ২ লক্ষ টনের ব্যবহার হতে পেরেছিল। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এলে সরকারের এই সমস্যা সমাধানের কথা মাথায় আসে। দিল্লিতে নাকি এক ছত্রাকের ক্যাপসুল তৈরি করে মাঠেই ন্যাড়া পচানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু তার জন্য প্রায় এক মাস সময় চাই। কৃষকের কাছে সময় থাকে মাত্র ১৫-২০ দিন। মাঠ থেকে যে ন্যাড়া তোলার মেসিনের কথা বলা হচ্ছে সেগুলি চাষিদের ট্রাক্টরের উপযুক্ত নয়। এই সমস্ত বিষয় বিচার করলে বোঝা যাবে যে, কোনো সরকারই এই বিষয়ের সমাধান খুঁজতে নারাজ।
যদি কৃষক দায়বদ্ধ হয় তবে কর্পোরেটরা নয় কেন?
আর একটা কথা কিন্তু ভাবতেই হবে। ন্যাড়া পোড়ানো বা বায়ুদূষণের বিষয়টি কেবল দিল্লির নয়, এটি পুরোদেশের সমস্যা এবং কলকাতার বায়ুদূষণ দিল্লির তুলনায় বেশি বই কম নয়। এফএকিউ-র বোঝা না বাড়িয়ে এবার আসুন বৃহত্তর সমস্যাটা কী তার উপর চোখ বোলাই। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
১। গুজরাটের কচ্ছ এলাকায় আদানির মুন্দ্রা-ওয়াটারফ্রন্ট বন্দর প্রকল্পে (এসইজেড-সেজ)-র জন্য ২০০৯ সালে যে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া হয় তার থেকে অনেক বেশি নির্মাণ কাজের মধ্য দিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করার ঘটনা সামনে আসে। কচ্ছ এলাকা পরিবেশের দিক দিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ’কারণে ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের MOEFCC পরিবেশের ক্ষতিপূরণের জন্য ২০০ কোটি টাকা (প্রকল্পের মোট খরচের ১ শতাংশ) জরিমানা করে। কিন্তু ২০১৫ সালে সরকার পরিবর্তন হলে এই জরিমানা মকুব হয়ে যায়। অর্থাৎ আদানির দূষণের দায়িত্ব সমাজকে বহন করতে হয়। বিজেপি সরকারের যারা ঢোল পেটান তাদের যুক্তি হলো, প্রকল্পে যেহেতু কর্মসংস্থান হবে তাই এই ক্ষতি মেনে নিতে হবে। এনসিআর অঞ্চলের চারিপাশে যে কৃষিকাজ হয় তাতে বোধ হয় কর্মসংস্থান হয়না কিংবা জিডিপি’র জন্য এই উৎপাদনের কোনো ভুমিকা নেই?
২। ওডিশার রায়গড়া জেলার নিয়ামগিরিতে বেদান্ত নামে একটি বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থা খনি থেকে বক্সাইট উৎপাদন এবং অ্যালুমিনা তৈরির কারখানার জন্য ডোঙ্গরিয়া-কন্ধ নামে এক আদিম উপজাতির ব্যবহার করা বনভূমি বলপূর্বক দখল করে। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই অরণ্য ধ্বংস হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট ডোঙ্গরিয়া-কন্ধদের পক্ষে রায়দান করেন এবং বেদান্তের সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেন। পরে অবশ্য কোনো এক জাদুবলে বেদান্ত দু’টি বক্সাইট খনি পেয়ে যায়। ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা সম্পর্কিত নতুন ইআইএ নোটিফিকেশন সহ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন তৈরি করে। এটি হলো সংক্ষেপে অরণ্যের অধিকার রক্ষা আইন (Forest Right Act)। এই আইনের মাধ্যমে বনবাসী-আদিবাসী, ডোঙ্গরিয়া-কন্ধদের অরণ্য সম্পদের যেমন রক্ষা হয় তেমনই পরিবেশের ক্ষতিও রোধ করা সম্ভব হয়।
৩। উত্তরাখণ্ডে হিমালয়ের বুক চিরে ৯০০ কিলোমিটার “চারধাম মহামার্গ” তৈরির জন্য ইআইএ এবং জনশুনানি এড়িয়ে একটি গোটা রাস্তাকে ৫৩টি ভাগে ভাগ করে আইনের ফাঁক দিয়ে (স্বল্প দৈর্ঘ্য রৈখিক প্রকল্প) সরকার হিমালয়ের পরিবেশ রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করে। এই কাজ এখনও চলছে। বর্তমানে যে আইন আছে তাতে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য-যুক্ত এই ধরনের যেকোনো প্রকল্পে ইআইএ এবং ইএমপি জরুরি (২০১৫ আগস্ট মাসে তৈরি আইন অনুযায়ী)। ২০২৫-র আগে দৈর্ঘ্যের এই সীমা অনেক কম ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, সরকারের পরিবেশ রক্ষার তাগিদ এবং দায়বদ্ধতা কত তীব্র।
এবার আসি পূর্বাপরের কথায়। গত বছর একই ধরনের আর একটি মামলা হয়। গতবছরও দিল্লির বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। গতবছরের মামলায় আদালত সরকারকে কিছূ গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশ দেয়। আদালত বলে যে - পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ এই তিন রাজ্যের কৃষকদের কাছ থেকে ফসলের পরিত্যক্ত অংশ বা ন্যাড়া কিনে নেওয়ার এক পরিকল্পনা করতে হবে। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কৃষকদের থেকে ১০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল-দরে সরকার ন্যাড়া (বাসমতী নয় কেবল এমন ফসলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) কিনে নেবে। এবং ন্যাড়া পোড়ানোর জন্য যে দূষণ হয় তার দায়িত্ব এই রাজ্য সরকারগুলির।
ন্যাড়া একটি জৈব পদার্থ। এখান থেকে শক্তি উৎপাদন, কাগজ শিল্পে ব্যবহার, গ্রাস কার্ডবোর্ড তৈরি করে প্যাকেজিংয়ের জন্য প্লাস্টিক বা থার্মোকলের পরিবর্তে ব্যবহারে উৎসাহিত করা বা নিদেনপক্ষে জৈব সার উৎপাদন করা যায়। এর যেকোনো একটি পরিকল্পনার জন্য সরকারের বিনিয়োগ চাই কারণ কৃষকের সেই ক্ষমতা নেই। ন্যাড়া কৃষক মাঠে ফেলে রাখতে পারবে না কারণ পরের ফসলের জন্য মাঠ তৈরি করতে হবে। ১৫ বছর আগের তুলনায় কেবল পাঞ্জাবে এখন প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি শস্য উৎপাদিত হয়। একটি মত হলো, এই বাড়তি উৎপাদন নিঃসন্দেহে দেশের জন্য ভালো, কিন্তু দিল্লির জন্য খুব খারাপ। কারণ বাড়তি ফসল মানেই মাটির নিচ থেকে বেশি জল তোলা এবং বেশি ন্যাড়া পোড়ানো। এই দ্বন্দ্বে সরকারই পারে টেকসই সমাধান (sustainable solution)-এর রাস্তা বের করতে। এই কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের করা উচিত কারণ পরিবেশ রক্ষা, মাটির নিচের জলসম্পদ সংরক্ষণ গোটা দেশের বিষয়। এখানে দিল্লি বা কলকাতার বায়ুদূষণ, দিল্লি বা চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুর মাটির নিচের জলাভাব সমস্তটাই একই প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁধা। দুঃখের বিষয়, এখানে সরকারের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। জানিনা এই মামলা কতদূর এগোবে। কিন্তু নাগরিক সমাজের এই সংক্রান্ত প্রশ্ন করার অধিকার যেন চলে না যায়। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষিবিলের পর পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের উপর আরেক বড়ো আঘাত নেমে আসবে।