E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১১শ সংখ্যা / ২৩ অক্টোবর ২০২০ / ৬ কার্ত্তিক ১৪২৭

তিন কৃষিআইন প্রত্যাহারে প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধের পথে দেশের মানুষ

সুপ্রতীপ রায়


দেওয়ালের লিখন কি নরেন্দ্র মোদী পড়তে পারছেন? সম্ভবত না। এই কারণেই কৃষক বিরোধী, কৃষি বিরোধী ও দেশ বিরোধী তিনটি কৃষি আইনের পক্ষে নির্লজ্জ, মিথ্যা, বিকৃত প্রচার বিজেপি করে চলেছে। কিন্তু এতে বিজেপি বিরোধী ক্ষোভ আরও বাড়ছে। গত দু’মাস ধরে গোটা দেশে কৃষক বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন অসংখ্য কৃষক। কৃষকদের আন্দোলনের সংহতিতে অন্যান্য অংশের মানুষও শামিল হয়েছেন। দুই শতাধিক কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছে সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে। ২৬-২৭ নভেম্বর দিল্লি চলো অভিযান। কেবল প্রতিবাদ নয়, গড়ে উঠছে প্রতিরোধ।

অনিশ্চিত অবস্থায় দেশবাসী। লকডাউনে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। মোদী সরকার কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমিক-কৃষকদের যে বিপদে ফেলেছেন তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই সময়ে আয় যেমন কমেছে তেমনি নিয়োগও কমেছে। বেড়েছে কর্মচ্যুতি। কাজের সময় বাড়ছে, কর্মসংকোচন বাড়ছে। বহু ক্ষেত্রে বেতন কমছে। গত সাত মাসে ফসলের অভাবী বিক্রি আরও বেড়েছে।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের মানুষকে বাঁচানোর কোনো দায় নেই। আসলে কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিকে মোদী সরকার উদারবাদ প্রয়োগের একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে দেখতে চাইছেন। সেদিকে লক্ষ রেখেই সে কাজ করে চলেছে। অতিমারী সঙ্কটের নাম করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ঘোষণার আড়ালে মানুষের প্রতিবাদকে গত সাত মাস ধরে স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির কাজের ক্ষেত্রে বাধা এসেছে। মোদী সরকারের নীতির ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রান্তিক অবস্থানের মধ্যে চলে যাবেন। কোভিড-১৯ এর আগেও দেশের অর্থনীতি, কৃষির অবস্থা ভাল ছিল না। কোভিড-১৯-কে এখন ঢাল করার চেষ্টা করছে শাসকশ্রেণি। লকডাউনের আগেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটছিল। কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছিল। ঋণগ্রস্ত কৃষি পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ২০১৪-র নির্বাচনী ইশতিহারে বিজেপি বলেছিল - স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে কৃষকের ফসলের উৎপাদন ব্যয়ের ৫০ শতাংশ লাভ রেখে যে সহায়ক মূল্যের কথা ছিল তা বাস্তবায়িত করবে। বিজেপি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনায় চাষির লাভ হয়নি - লাভ হয়েছে - বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলির। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পকে গত কয়েক বছরে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে।

লকডাউনের মধ্য দিয়ে চাষির যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হবে কী করে? বিজেপি নিরুত্তর। লকডাউনের ঘোষণায় নানা বিধি নিষেধ ছিল। ফলে কৃষকের উপর বাড়তি অর্থনৈতিক বোঝা চেপেছে। গণপরিবহনের অভাবের ফলে চাষির খরচ বেড়েছে। লকডাউনের ফলে চাষি তার উৎপাদিত শস্য, সবজি নামমাত্র মূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করেছেন।

লকডাউনের ফলে অন্নদাতারা চরম সঙ্কটে পড়লেও রাষ্ট্র কৃষকদের জন্য কোনো সহায়তা করেনি। সরকার বিপন্ন কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য কোনো বিনিয়োগ করেনি। কৃষকদের কোনোরকম আর্থিক সহায়তা করেনি। মোদী কর্পোরেটদের রক্ষা করতে শ্রমিক ও কৃষকদের উপর বোঝা চাপিয়েছে। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রামীণ জনগণ ও শ্রমজীবী মানুষকে লুঠ করার অভিযানে নেমেছে বিজেপি সরকার।

কৃষি সংস্কারের নাম করে কৃষি সংহারে নেমেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। আম জনতার প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে স্বৈরাচারী উপায়ে ‘দ্য ফার্মাস প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন)’, ‘দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিয়োরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস’ ও ‘দ্য এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স) ২০২০ এই তিনটি বিলকে আইনে পরিণত করেছে। এই তিনটি আইনের পক্ষে বিজেপি’র দাবি ও বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।

এই তিনটি আইনের পক্ষে বিজেপি’র বক্তব্য কি?
• এক ভারত, এক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নিয়ন্ত্রিত মান্ডির বাইরে কৃষকদের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা, আন্তঃ রাজ্য ও অভ্যন্তরীণ নিষেধাজ্ঞার অবলুপ্তি।
• খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকারী, পাইকারি ও খুচরো খাদ্য ব্যবসায়ী এবং রপ্তানিকারকদের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য পূর্ব নির্ধারিত দামে কৃষকের চুক্তির স্বাধীনতা, কৃষি বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীর বিলোপ সাধন, পণ্য মজুত, সরবরাহ, চলাচল, সরবরাহ ও বণ্টনের স্বাধীনতা, দেশি ও বিদেশি লগ্নিকারীদের কৃষিক্ষেত্রে আকৃষ্ট করা।

বলা বাহুল্য তিনটি আইন আলাদা আলাদাভাবে বলবৎ হলেও তিনটি আইন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এই তিনটি আইনের মধ্য দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা ধ্বংস হবে। শিল্পের বিকাশে কৃষির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষিত হবে না। ফলে শিল্পের বিকাশ হবে না। কৃষিপণ্যের বিক্রি ব্যবস্থার উপর যেটুকু সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল তা থাকবে না। চুক্তিবদ্ধ কৃষিজ উৎপাদন এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) অপসারিত হওয়ার ফলে কৃষি ক্ষেত্র বিপর্যস্ত হবে।

‘দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) বিল আইনে পরিণত হওয়ার ফলে যে কেউ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কৃষিজ পণ্য ক্রয় করতে পারবে। বিজেপি’র দাবি এর ফলে কৃষকরা বাজারে সর্বোচ্চ মূল্য পাবেন। কিন্তু আইনে কোথাও বলা নেই কৃষিজ পণ্যের কারবারিদের বাজারের সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে। এই আইনের ফলে কৃষিজ পণ্য মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে, লাভবান হবেন বৃহৎ ব্যবসায়ীরা। তৈরি হবে খাদ্য সঙ্কট। আর একটা মন্বন্তর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

কৃষি বিপণনের পরিকাঠামোয় আইনি পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের খাদ্য মজুতের সীমা অপসারিত করার জন্য পণ্য আইনের সংশোধন করা হয়েছে। মূল্য নির্ধারণের সমস্ত বিধিনিষেধ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটি লাগামহীন খাদ্য মজুতকেই উৎসাহ দেবে। অর্থাৎ ন্যায্য মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী সরবরাহের দায়বদ্ধতা আর সরকারের থাকছে না। বলা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় পণ্য আইনের অপসারণ কৃষকদের সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের দরকষাকষির ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেবে।

বিজেপি দাবি করছে - “কৃষি পণ্য বাণিজ্য ও বাণিজ্য (প্রসার ও সুবিধার্থ) বিল ২০২০, ‘কৃষকদের (ক্ষমতায়তন ও সুরক্ষা) চুক্তির মূল্য নিশ্চিতকরণ ও খামার পরিষেবাদি বিল, ২০২০’ও ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধন) বিল ২০২০’র মধ্যে দিয়ে কৃষকের স্বাধীনতা এসেছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম চাষিরা মুক্ত হলো। ডাহা মিথ্যা। আসলে এর ফলে চাষিরা কৃষি ব্যবসা, বড়ো খুচরো ব্যবসায়ী ও রফতানিকারীদের মর্জির উপর নির্ভর হয়ে পড়ল। কৃষকদের বৃহৎ ব্যবসা ও বড়ো ব্যবসায়ীদের শর্তের উপর চলতে হবে। কৃষকদের অধিকার চ্যুত করে কর্পোরেট আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হলো।

আসলে এই আইনগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিত শর্তের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে। তৈরি হচ্ছে ভয়ঙ্কর অবস্থা। এফপিটিসিও ২০২০ র মাধ্যমে এপিএমসি বাজারকে পাশ কাটিয়ে কৃষক সরাসরি উৎপন্ন কৃষিজ শস্য নিজের খুশি মতো বিক্রয় করতে পারবে। অতএব চাষি স্বাধীন! ১৯২৯ সালে এপিএমসি আইন আনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল - জমিদার, মহাজন, ফড়েদের শোষণের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচানো। স্বাধীনতার পরও এই আইন চালু ছিল। সরকার এমএসপি’র মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি পণ্য সংগ্রহ করার সময় থেকে এপিএমসি বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

কৃষি পণ্যের দামের বিষয়ে তথ্য সঠিকভাবে সবার কাছে থাকে না। আইনের সংশোধনের ফলে কৃষক নিজ ফসল স্বাধীনভাবে তাদের ক্রেতার কাছে বিক্রি করার স্বাধীনতা হারাবে। কারণ দরকষাকষির ক্ষমতা তার নেই। এপিএমসি বাজারগুলি ভবিষ্যতে কর বাবদ অর্থ হারাবে। কারণ সেখানে বর্ধিত কর দিয়ে কৃষি পণ্য ক্রয় না করে সবাই এপিএমসি বাজারের বাইরে গিয়ে তা ক্রয় করবে, যেখানে তাদের কোনো কর দিতে হবে না। অর্থাৎ এপিএমসি বাজারগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।

এপিএমসি বাজারগুলি এতকাল ধরে দাম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমান আইনে সেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আর সে পালন করতে পারবে না। কৃষি উৎপাদন বাজার সমিতি ব্যবস্থাকে কার্যত ধ্বংস করে দেওয়া হলো। আইনে খুব পরিষ্কার করে বলা আছে - কৃষক ও বাণিজ্যিক ক্রেতা সংস্থার মধ্যে যাবতীয় চুক্তি, লেনদেন কিষান মান্ডির মধ্যে দিয়ে হবে না। অর্থাৎ সরকারি মান্ডির আর কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। রাজ্যগুলি গত ছয় দশক ধরে কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থাকে আরও সহায়তা দান করত এখন আর তা করতে পারবে না। কৃষকদের মান্ডির বাইরে গিয়ে বা বহিরাগত বাণিজ্যিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। কৃষকদের ঠেলে দেওয়া হল হাঙরের মুখে।

বিজেপি বলছে কৃষিক্ষেত্রে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বাধাগুলির অপসারণ, ই-ট্রেডিং-এ উৎসাহ প্রদান ও কৃষকদের এপিএমসি বাজারগুলির বাইরে বিক্রি করার স্বাধীনতা দেওয়া হলো। আসলে এর মধ্যে দিয়ে চুক্তি চাষের বৈধকরণ, এতদিনের চালু নিয়মিত বাজারগুলিকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক রিটেল চেন দ্বারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কৃষিজ দ্রব্য কেনা বৈধতা, বৃহৎ কর্পোরেটদের নতুন কৃষি বাজার খোলাও নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দেওয়া হলো।

বলা হচ্ছে কৃষকরা পূর্বের তুলনায় বেশি দাম পাবে। এখনই বাস্তবে তা হবে না কারণ, এই বাজারগুলি প্রতিস্থাপন যোগ্য হয় না। এপিএমসি বাজারগুলির অনুপস্থিতিতে কৃষি বিপণন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কৃষকরা তীব্র শোষণের শিকার হবে। এপিএমসি-র মূল কারণটাই ছিল যাতে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত না হয়।

এপিএমসি নির্ভর মান্ডি ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পর নতুন আইনে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়ার আর কোনো নিশ্চয়তা থাকল না। রাজ্যের হাতে মান্ডির বাইরে কৃষি থেকে আয়ের আর কোনো উপায় থাকল না। কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ীরা মুনাফার স্বার্থে মান্ডির কমিশন এজেন্ট বা দালালদের মাধ্যমে কৃষকদের পণ্য মাঠ থেকে লুঠ করবে। এপিএমসি নির্ধারিত দাম মান্ডির বাইরে আদায় হওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় কৃষকদের জবরদস্তির মুখে পড়তে হবে। চুক্তিভঙ্গ হলে সরকারের ভূমিকা কি থাকবে তা আইনে বলা নেই।

বিজেপি দাবি করছে স্বাধীনতার পর এই প্রথম কৃষকদের প্রক্রিয়াকারক, মজুতদার, পাইকারি ব্যবসাদার, বৃহৎ ব্যবসাদারদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অধিকার দেওয়া হলো। বলা হচ্ছে কৃষকদের শোষণের আর কোনো আশঙ্কা থাকবে না। বাস্তবে ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্স, আদানির মতো হাঙরের সাথে গরিব কৃষকদের কখনই অন্যায় করা হবে না? এটা কখনই ঠিক নয়। আসলে কৃষকদের এটি শেষ করার একটি পাকা ব্যবস্থা।

বিজেপি’র দাবি - আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্য চলাচলে রাষ্ট্র-আরোপিত বাধা অনেকটাই অপসারিত করা হলো। সরকার বলছে এমএসপি তুলে দেওয়া হবে না। কিন্তু এমএসপি-তে ফসল বিক্রয় করা কঠিন হয়ে পড়বে কেননা সরকারি মান্ডিই তুলে দেওয়া হবে। এমএসপি তুলে দেওয়ার আইন আনা হয়েছে এই উদ্দেশ্যে।

বিজেপি কৃষি আইনগুলির পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে অদ্ভুত যুক্তি হাজির করছে। বলা হচ্ছে এর ফলে ফসল জমি থেকে বাজারে আনার পথে মধ্যবর্তী দালালতন্ত্র বা ফড়েরাজ নির্মূল হবে। বলা হচ্ছে এর ফলে চাষিরা ফসলের সঠিক দাম পাবেন। কিন্তু এটি একটি নির্জলা মিথ্যাচার।

কারণ আমাদের দেশের দরিদ্র চাষিদের পক্ষে চুক্তি শর্তাবলি বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের কৃষি এখনও প্রকৃতি নির্ভরশীল। কিন্তু আইন অনুযায়ী চুক্তির শর্তানুযায়ী রাজ্য সরকার সহায়তা নিয়ে হাজির হতে পারবেন না। আবার চুক্তির শর্তাবলি লঙ্ঘন করলে চাষির রক্ষাকবচ কি? না রক্ষা কবচ নেই। তাহলে মধ্যবর্তী দালালতন্ত্র বিলুপ্ত হলো কীভাবে? কৃষিপণ্যের বাজারে এর ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট কমবে না, বাড়বে। মধ্যস্বত্বভোগীরা বিদায় নেবে না। এরা হয়ে উঠবে কর্পোরেটদের স্থানীয় প্রতিনিধি। কর্পোরেটরা দখল নেবে ভারতীয় কৃষির বাজার।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে কৃষকের মাঠের ফসল যদি নষ্ট হয় তাহলে চাষি কি করবেন? সরকার কি করবেন? কোনো কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ কৃষকদের আত্মহত্যার মিছিল আরও বাড়বে।

আগামী দিনে কর্পোরেট চুক্তি চাষ প্রসারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চুক্তি চাষে জোর দেওয়ার ফলে কৃষককে কর্পোরেটদের চাহিদা অনুযায়ী চাষিকে চাষ করতে হবে। অর্থাৎ চাষিদের সারাজীবন দাসত্ব করতে হবে। তৃতীয় আইনটিতে চুক্তি চাষের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তির একদিকে থাকবেন শক্তিমান ক্রেতা, অন্যদিকে থাকবেন দুর্বল চাষি। যে দুর্বল চাষিকে যেমন খুশি বিপদে ফেলা যাবে। যে চাষি এই চুক্তিচাষে রাজি হবেন তাঁকে নিজের জমিতেই কৃষি মজুরে পরিণত হবে। কৃষিজ উপকরণগুলি আসবে কোম্পানি থেকে, ফসল নির্দিষ্ট দামে নিয়ে যাবে কোম্পানি। চুক্তিবদ্ধ কৃষক যা পাবেন সেটা মজুরির বেশি নয়।

এখন থেকে কর্পোরেট সংস্থা কৃষকের সঙ্গে আগাম চুক্তির মাধ্যমে কৃষককে দিয়ে চাষ করাতে পারবেন। অর্থাৎ চাষের আগেই চুক্তি অনুযায়ী দরদাম স্থির হয়ে যাবে। বিজেপি এটাকেই বলছে - কৃষকের স্বাধীনতা। অথচ কর্পোরেট সংস্থার সাথে দরকষাকষিতে সরকার কৃষকের পক্ষে থাকবেন কিনা অর্থাৎ কর্পোরেট সংস্থা চাষীর সঙ্গে জুলুম করলে সরকার কৃষককে সহায়তা দেবেন কিনা তার কোনো উল্লেখ নেই আইনে। আগামী দিনে ভূমিহীন কৃষকের পরিমাণ বাড়বে। বাড়বে জমি কেন্দ্রীভবন। অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল কৃষকদের কাছ থেকে নামমাত্র দামে জমি কর্পোরেট সংস্থাগুলি কিনবে। নতুন কৃষি আইনে কৃষকদের অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলবে কৃষকদের। চাষিদের জমিহীন হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে।

১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে লঘু করে দেওয়া হয়েছে। এটি আসলে গণবণ্টন ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, এখন থেকে অনেকগুলি পণ্য আর অত্যাবশ্যকীয় নয়। যেমন খুশি মজুতদাররা মজুত করতে পারবেন। আটকানোর আর কোনো ব্যবস্থা থাকল না। রাজ্যের হাতে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের কোনো অধিকার থাকবে না। ভয়ঙ্কর সঙ্কট নেমে আসবে।

আসলে তিনটি আইন কৃষকের স্বার্থে নয়। এত তিনটি আইনের বিরোধিতা কেন? এই আইনগুলিতে কোথাও কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কথা নেই। মজুতদারি আর বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত হবে না। বলা হয়েছে - পচনশীল কৃষিজপণ্যের দামের একশ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ও অপচনশীল কৃষিজ ফসলের দাম পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধি হলে তবে সরকার ব্যবস্থা নেবে। কর্পোরেটের পৌষ মাস, দেশের মানুষের সর্বনাশ।

কৃষি বাজার ও কৃষি বাণিজ্যের সমস্ত অধিকার কুক্ষিগত হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। রাজ্য সরকার কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা হবে নীরব দর্শকের। অর্থাৎ কৃষি অর্থনীতির উপর নেমে আসবে স্বেচ্ছাচার। কৃষি ও কৃষকের উপর বল্গাহীন আক্রমণের পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে সাম্প্রতিক কৃষির তিনটি আইনে। কিন্তু প্রতিরোধের মধ্যে দিয়েই কৃষকবিরোধী সরকারকে বাধ্য করা হবে এই তিনটি আইন প্রত্যাহার করার জন্য।