E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১১শ সংখ্যা / ২৩ অক্টোবর ২০২০ / ৬ কার্ত্তিক ১৪২৭

সোচ্চার চিন্তা

ঘুঁটে মাহাত্ম্যঃ সময়োচিত কিছু প্রস্তাব

পল্লব সেনগুপ্ত


চিরকালই ‘ঘুঁটে’ নামক বস্তুটিকে লোকে খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে। ঘুঁটের মেডেল পড়িয়ে দিয়ে কিংবা ঘুঁটের মালা গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে কারুকে হেনস্থা করার অভিপ্রায় জানানো তো, তার মানহানি করার একটা অতি প্রকৃষ্ট পদ্ধতি বলে বহুকাল ধরেই স্বীকৃতি লাভ করেছে। ঘুঁটে কুড়ানির সঙ্গে রাজপুত্তুরের বে-থা হওয়ার ব্যাপারটাও তো বাংলা রূপকথার একটা পরিচিত উপকরণ! অবিশ্যি, ঘুঁটে যে সদাসর্বদাই একটা বিদ্রূপ তাচ্ছিল্য উপেক্ষার উপকরণ এমনটিও নয় আবার। ঘুঁটের উপকারিতা নিয়ে আমাদের বাঙালি ঘরের গিন্নিবান্নিরা কিন্তু আপনারা চাইলেই বড়ো-সড়ো মাপের একখানা ভাষণ শুনিয়ে দিতে পারেন: ঘুঁটের আগুনের জ্বালে ‘পোরের ভাত’ চা‍‌পিয়ে জ্বোরো রুগীর পথ্যির ব্যবস্থা করা, কিংবা সাঁঝের কালে নাছ্‌-দুয়ারে মালসায় ঘুঁটেতে আগুন দিলে মশাদের ‘গুষ্টির তুষ্টি’ (অর্থাৎ, নির্বংশ!) করার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো, অথবা ‘মুখপোড়া’ উনুন কিছুতেই ধরে না যখন, তখন একখানা ঘুঁটের ওপর চারফোঁটা ‘কেরাচিনি’ (অর্থাৎ, কেরোসিন) ফেলে আগুন ছুঁইয়ে উনুনে ফেলে দিয়ে সেই ব্যাদড়া উনুনকে শায়েস্তা করার পদ্ধতি - ইত্যাদি বহু বহু বিষয় নিয়ে মা-ঠাকরুণরা মান্যবর নরেন্দ্র মোদী মহোদয়ের গড়পড়তা ভাষণের সাইজের একপিস লম্বা বক্তৃতা যে কোনো সময়েই শুনিয়ে দিতে পারেন!... না, একটু বোধহয় ভুল বলে ফেললুম। ওটা ‘পারতেন’ বলাই বোধহয় ঠিক হতো! কারণ শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়িতেও এখন আর ঘুঁটে কয়লার সেই জাঁকিয়ে বসে ‘রাজত্বি’ করার দিন নেই। গাঁয়ে-গঞ্জে এখনও (‘স্বচ্ছ ভার্ৎ’-এর সরকারি ধোঁকার টাটির প্রচার সত্ত্বেও) অবশ্য ঘুঁটের ব্যবহার একেবারে ঘুচে গেছে যে, তা নয়। তবে সে যাই হোক না কেন, মোটের ওপর (বঙ্কিমচন্দ্রের কথার নকল করেই!) বলতে পারি, ‘‘হায়, ঘুঁটে তোমার দিন গিয়াছে!’’

।। দুই ।।

কী ভাবছেন? লোকটার আশি পেরিয়ে অ্যাদ্দিনে তবে বাহাত্তুরে-ভিমরতি ধরল না কি! এতো এতো বিষয় চাদ্দিকে রয়েছে, সে সব ছেড়ে ‘ঘুঁটে’ নিয়ে এতো বাক্‌চাল্লি কিসের বাবদে? বলছি ভাই, বলছি! কেন ঘুঁটের ব্যাপারে হঠাৎ এই উচ্ছ্বাস এ অভাজনের, বলি এবারে। আচ্ছা, শ্রীমান বল্লভভাই কাঠারিয়ার নাম জানেন আপনারা কেউ? হয়তো দু-চারজন পত্রান্তরে প্রকাশিত এক পিস খুচরো-খবরের সূত্রে তাঁর নামটা পড়েছেন এবং তদ্দন্তেই ভুলে গেছেন! আর, বাকিরা নজরেই আনেননি কিংবা ওই পত্রিকাটাই ওদিন পড়েন নি। তাই এই বৃদ্ধ দুর্মুখই দায়িত্ব নিচ্ছে ঘুঁটে-বিষয়ে তাঁর আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা আপনাদের সমীপেষু করতে!

ইস্‌, সদ্য-সদ্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারটা ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, কাঠারিয়াজির যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘোষণার আগেই, তাই এবছরে ওঁর চান্সটা ফস্‌কে গেল! তা নইলে, এবারের ‘ব্ল্যাক হোল’-সংক্রান্ত যে-গবেষণা নোবেল প্রাইজ পেয়েছে ফিজিক্সে, তার সঙ্গে বাঙালি অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরির উদ্ভাবিত ‘ইকোয়েশ্যন’ (অর্থাৎ, অঙ্কের বাঙালি পরিভাষায় ‘সমীকরণ’) কতখানি জড়িত ছিল - তাই জেনেই আমরা উচ্ছ্বসিত - কাঠারিয়া বাবুর গবেষণা আগে সাধারণ্যে প্রচারিত হলে - পুরোপুরি এদেশি ‘নোবেল ইন ফিজিক্স’ নিয়ে আমরা অহঙ্কারী হতে পারতুম! এবং অধুনা যেসব ভারতীয় নোবেল পেয়েছেন, অমর্ত্য সেন, কৈলাস সত্যার্থী, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি - তাঁদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক-রাজনৈতিক মতামতের কারণে বিজেপি-ওয়ালারা তাঁদেরকে দেখতে পারেনা দু’চক্ষে - এবারে আর তা হতো না! কারণ এই কাঠারিয়া ভাই হলেন ‘রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ’ নামক একটি বিজেপি-তথা-কেন্দ্রীয় সরকার-পৃষ্ঠপোষিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা!

তো, এই মহাবিজ্ঞানী (!) বল্লভভাই কাঠারিয়া ঘুঁটে নিয়ে কী মহতী আবিষ্কার করেছেন, সেটা এবারে বলিঃ
গোরুর সর্ববিধ রক্ষা এবং প্রতিপালন, নিরাপত্তা দান এবং তাদের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে - যা কি না, ‘মহান’ আর্যধর্মের জন্ম ও বিকাশভূমির সদ্ধর্মনিষ্ঠ সমস্ত হিন্দুর পক্ষেই অবশ্যকর্তব্য বলে ধার্য হবার পরিপূর্ণ সূচকবিশেষ - তার জন্য দেশজোড়া যে এক অভিযান শুরু হয়েছে (যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কামধেনু দীপাবলি অভিযান’) গত বছর দেওয়ালির সময় থেকে - তারই সর্বশেষ সুভাষিত জ্ঞানামৃত হলো - এই ঘুঁটে-মাহাত্ম্য-বিষয়ক তত্ত্বটি। শ্রীমদ্‌ বল্লভভাই কাঠারিয়াজি বলেছেন যে, মোবাইল ফোন থেকে যে বিকিরণ (অর্থাৎ, রেডিয়েশন) হয় - তার একমাত্র প্রতিষেধক হলো সেটিকে সব সময়ে একটি ঘুঁটের সঙ্গে জড়িয়ে রাখা। ওই বিশেষ যন্ত্রটি মুঠোয় ধরে কানে লাগানোর সময়ে তেমনটা যে কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে অবশ্য মান্যবর কাঠারিয়া কিছু পথনির্দেশ দেননি অবিশ্যি।

।। তিন ।।

এর আগে বিজেপি-র মন্ত্রী-সান্ত্রী-সেপাই-বরকন্দাজরা গোরু এবং তার দেহজাত অনেক কিছুরই মাহাত্ম্যকীর্তন করে নানা ধরনের হাস্যকর ফরমান জারি করেছেন। এই ঘুঁটে-বন্দনা সেই মূর্খতা-সিরিজের সর্বশেষ সংযোজন। এর আগে যেসব পয়গাম উৎক্ষিপ্ত হয়েছে গোমাতার সুপুত্রদের শ্রীমুখ থেকে, সেগুলির একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যাক তা হলেঃ এক, গোরুর দেহনির্গত শ্বাসপ্রশ্বাস সহ যাবতীয় বায়বীয় পদার্থ নিয়মিতভাবে প্রতিদিন সকা‍‌লে নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে মানুষ সমস্ত ধরনের রোগ-বালাই থেকে মুক্ত থাকে। (এই বিধানের আনুষঙ্গিক এক‍‌টি সংযোজনীও ছিলঃ প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে একটি করে গোয়াল রাখা দরকার।) এই সুপরামর্শের সূত্রে এই দুর্মুখের একটি প্রশ্ন - তাহলে ডাক্তার বদ্যিদের আর কোনও প্রয়োজন থাকছে না? নার্সদের? ওষুধ-নির্মাতাদের? বায়ো-কেমিস্টদের? দুইঃ গোরুর চোনা প্রতিদিন সকালে বেশ কিছু পরিমাণে আত্মস্থ করলে যে কোনও আগন্তুক-ব্যাধির (পড়ুন, কোভিড-১৯) থেকে আত্মরক্ষা করা খুবই সহজ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে! তিনঃ (এটিও করোনা-প্রতিরোধ সংক্রান্ত) সারা শরীরে গোবর মেখে সবাই প্রখর রোদে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে গা সেঁকলে করোনা নামক ‘চৈনিক-দস্যু’(!) পিতৃ-পিতামহকে স্মরণ করে এই পবিত্র আর্যভূমিকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করে পালাবে এক হপ্তার মধ্যেই। চারঃ কপালে গোময়-তিলক এঁকে গঙ্গা-যমুনা-নর্মদার জলের সঙ্গে গো-চোনা পান করলে মারী ভয় (পড়ুন, করোনা), অরি ভয় (পড়ুন, চীন ও পাকিস্তান), ধনক্ষয় (পড়ুন, জিডিপি হ্রাস) ইত্যাদি অধুনা যেসব বিপদ-আপদ আমাদেরকে বিপর্যস্ত করছে, তা’ থেকে রেহাই মিলবে। পাঁচঃ প্রতিদিন ভোরে জলগ্রহণের আগে স্নান সেরে ফুল-তুলসি পাতা দিয়ে গো-বন্দনা করে, গোমাতার পবিত্র খুর-চতুষ্টয় ধুইয়ে দিয়ে সেই পুন্যজল পান করলে সর্ব দুঃখ ক্লেশের মোচন হয়!

এতসব বড়ো-সড়ো কাণ্ডকারখানার পাশে অবিশ্যি ঘুঁটের মাহাত্ম্যসূচক ওই মোবাইল ফোনের বিকিরণ-রোধ করার ব্যাপারটা নেহাতই তুশ্চু! তবে কাঠারিয়াজি যে-ঘুঁটে নির্মিত ‘গোস্বত্ব কবচ’-এর কথা বলেছেন, তার একটা বাণিজ্যিক দিকও কিন্তু দেখতে পাচ্ছি ভাই! ওই ‘ঘুঁটিয়া কবচ’ সরকারি উদ্‌যোগে কোটি কোটি সংখ্যায় তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করলে বৈদেশিক বাণিজ্যেরও একটা বিরাট অগ্রগতি হতে পারবে! তারপর ওগুলি তৈরি করার জন্য এই ‘পুণ্যভূমির’ গ্রামে-গ্রামে গো-পালন আর ঘুঁটে প্রস্তুতির সূত্রে বহু নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানও হবে! তারপর সেই কোটি-কোটি ঘুঁটের বাবদে শহরে বড়ো-বড়ো কারখানা তৈরি করে রেডিয়েশন-নিরোধক কবচ তৈরি করার জন্যও বহুজনের জীবিকা সংস্থান হবে! ফলে, সামগ্রিকভাবে ঘুঁটের সূত্রে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি একেবারে পোল ভল্ট দিয়ে চড়্‌চড়্‌ করে উঠে যাবে! মোদীজির ‘‘অচ্ছে দিন’’ নিয়ে মন্দ-লোকেদের মন্দ-কথা-বলা থোঁতা-মুখ একেবারে ভোঁতা হয়ে যাবে! তখন ‘‘সত্যমেব জয়তে’’-র বদলে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘‘গোমাতা কি জ্যায়’’-ও বিনা আয়াসে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে!

তাহলে বন্ধুগণ, এ হেন সুপ্রবল ঘুঁটে-মাহাত্ম্য জানার পরে গো-সেবক হতে কি আর কারুর আপত্তি হতে পারে? আসুন, আমরাও সকলে নিজেদের বাড়িতে ঘুঁটে দিয়েই দেয়াল সাজাই! একই সঙ্গে স্বাস্থ্যোন্নতি এবং আর্থিক সংস্থান বৃদ্ধি দুই-ই হতে পারবে, কী বলেন?

পুনশ্চঃ লেখাটা শেষ করার পর খবর দেখলুম যে, দেশের বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক-গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত শতাধিক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী একযোগে ওই ঘুঁটে-মাহাত্ম্যকে চ্যালেঞ্জ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রমাণ ও জবাবদিহি চেয়েছেন। তাঁদেরকে দেশদ্রোহী তক্‌মা না-দিয়ে দেয় আবার?