৬০ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৬ আশ্বিন, ১৪২৯
তরুণ প্রজন্ম ও বেকারত্বের অতলান্ত খাদ
পলাশ দাশ
অনেকগুলো প্রজন্ম সমাজে একই সাথে চলছে। আছেন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রৌঢ় মানুষ, মাঝবয়সি মানুষ প্রধানত যাঁদের বুদ্ধি, শ্রম, অভিজ্ঞতা সমাজ, আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, আর আছে নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত, আজকের প্রযুক্তি নিয়ে বেড়ে ওঠা, শ্রম দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম। এছাড়াও আছে শৈশব ও বার্ধক্যে উপনীত মানুষ, যা প্রধানত কর্মক্ষম অংশের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। একটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার তরুণ প্রজন্মের ভালোমন্দের ওপর।
বিশ্বের জনসংখ্যার প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জনের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই তারুণ্যের উপস্থিতি অধিক। ভাবতে ভালো লাগে ভারত হলো এই নীল গ্রহের তরুণতম দেশের একটি, যদিও জনসংখ্যায় আমাদের থেকে বেশি চীন। মিডিয়ান এজ চীনের থেকে ভারতের কম। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ্ সার্ভে -৫–র ২০১৯-২০২১ সালের রিপোর্ট সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে এর আগের সার্ভের তুলনায়, ১৫ বছরের নিচে জনসংখ্যা ২ শতাংশ কমেছে এবং ৬০ বছরের ওপরে ২ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ একদিকে গড় আয়ু বেড়েছে অন্যদিকে জন্মহার কিছুটা কমেছে। লক্ষণীয় হলো, জনসংখ্যার ৫২ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে আছে জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। ভারতের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম। তারুণ্যের শক্তি, স্কিল, স্বপ্নকে যদি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে যুক্ত করা যায় তাহলে সেই বিপুল শ্রমশক্তির আধারের সমতুল্য দেশ আর পাওয়া যাবে না।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ অর্জনের ক্ষেত্রে নতুনপ্রযুক্তি জানা তরুণ শ্রমশক্তির ভূমিকা বিরাট। বর্তমানে এই মানবসম্পদ ভারতের আছে। কিন্তু তা থাকলেই আর্থিক বিকাশ ঘটবে এমনটা হবে না। জনসংখ্যাগত লাভ পেতে হলে সরকারকে, তরুণ প্রজন্মের জন্য আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ এবং সর্বোপরি প্রচুর পরিমাণ কোয়ালিটি জব বা গুণমানসম্পন্ন কাজ সৃষ্টি করতে হবে। সরকার হাত গুটিয়ে বাজারের দিকে চেয়ে থাকলে এই বিপুল তরুণ প্রজন্ম দেশের সম্পদ না হয়ে অসহনীয় বোঝায় পরিণত হবে। ইউনাইটেড নেশন পপুলেশন ফান্ডের মতানুসারে ভারত বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনের পর্যায়ে চলে এসেছে, যা শুরু হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে আর এই পর্যায় চলবে ২০৫৫/৫৬ সাল পর্যন্ত। তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা এতোটাই যে, তাকে কাজে লাগালে সে যেমন আর্থিক চালচিত্র বদলে দিতে পারে, তেমনই সে রাজনীতিও বদলে দিতে পারে।
তারুণ্য ও যৌবনের এই প্রাচুর্যকে, তাদের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, হতাশা, দুঃখ, দুশ্চিন্তাকে এবং তাদের বিপুল সংখ্যাকে বুঝতে ভুল হয়নি আমাদের রাজ্যের ও দেশের দুই শাসকের। তারুণ্যের জোয়ারে কীভাবে রাজনৈতিক লাভ অর্জন করা যায় শাসক তা করেছে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, প্রলোভনের জালে তারুণ্যের ভোট কুড়িয়েছে এরা। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি’র প্রতিশ্রুতি ছিল, বছরে দুকোটি কাজ, গরিব মানুষকে ১৫ লক্ষ করে টাকা, কৃষিতে আয় দ্বিগুণ হওয়া, বিপুল বিনিয়োগ, করপোরেট-মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদি।সভার পর সভায়, বিজ্ঞাপনে হবু প্রধানমন্ত্রী অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের সামনে এই মিথ্যা স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন। বছরে ৫ লাখ কর্মসংস্থানের গল্প শুনিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্পর্কে অমিত শাহ নির্দ্বিধায় বলেছেন, এসব হলো জুমলা। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কম যান না, তাঁর কথায়, তিনি সব করে দিয়েছেন যতই দাও ততোই চাই। তরুণ প্রজন্মকে কাজ, শিক্ষা, সুস্থ পরিবেশ না দিয়ে শাসক দিয়েছে ঘৃণা, হিংসা, নেশা, হানাহানি, বিভাজনের উন্মত্ত পরিবেশ। সারাক্ষণ চলছে ঝকমকে প্রচার; মেক ইন ইন্ডিয়া; ডিজিটাল ইন্ডিয়া; ভোকাল ফর লোকাল; সব কা সাথ সব কা বিকাশ; দিদিকে বলো; উন্নয়ন।
সেন্টার ফর মনিটরিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই প্রতি ৩ মাস অন্তর ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত রিপোর্ট হাজির করে। আগস্ট ২০২২ তারা যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা প্রকৃতই বিপজ্জনক। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়ই দেশে, স্বাধীনোত্তর সময়ে সর্বাধিক বেকারত্ব দেখা গেছে, তখনও প্যানডেমিক আসেনি। এরপর প্যানডেমিকে কর্মচ্যুতি ঘটে কয়েক কোটি কর্মরত মানুষের, যাঁরা চাকরিতে বহাল থাকেন তাঁদের বেতন কমে যায়। ২০২০ ও ২০২১ পেরিয়ে ২০২২ সালের শেষ পর্যায়ে এসেও অর্থনীতির বেহাল দশা কাটেনি। একদিকে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে কাজ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের। এ অবস্থায় যা হবার তাই হয়েছে অর্থাৎ শ্রমের দাম কমেছে আর সময় বেড়েছে।
সিএমআইই-র আগস্ট, ২০২২ রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে লেবার পার্টিসিপেশন রেট ৩৯.১৭ শতাংশ। শহরে এই হার ৩৭ শতাংশ এবং গ্রামে ৪৪.৭ শতাংশ। শহরে কাজ না থাকায়, কর্মচ্যুত হওয়ায় গ্রামে চাপ বাড়ছে। নতুন করে শহর থেকে গ্রামে কর্মক্ষম মানুষের স্রোত তৈরি হচ্ছে। শ্রম বাজারে ভারতীয় নারী একেবারেই ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে। পুরুষদের শ্রম বাজারে যুক্ত থাকার হার যেখানে ৬৫.৭২ শতাংশ সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ৮.৪৩ শতাংশ। ভারতে লেবার পার্টিসিপেশন রেট ৩৯.১৭ শতাংশ অর্থাৎ ৬০.৮৩ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ, কাজের বাজার থেকে উধাও হয়েছে। এদের মধ্যে একটা অংশ কাজ খুঁজলেও একটা বড়ো অংশ আর কাজ খুঁজতে আগ্রহী নয়। অর্থনীতিতে এই প্রবণতা মারাত্মক। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো কাজ খোঁজা ছেড়ে দেওয়া মানুষের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের। মানব জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা। লেখাপড়া না জানা বা কম জানা শ্রমশক্তি শ্রম দেওয়ার জায়গাই পাচ্ছে না। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী একটা ভদ্রস্থ, স্থায়ী কাজের সন্ধান কোথাও পাচ্ছে না। অনেকেই ভাবছে এখন না পেলেও পরে পাবে তাই এটা ওটা প্রশিক্ষণের দিকে অনেকেই যাচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই ফলপ্রসূ না হওয়ায় এক সময় কাজের আশা ছেড়ে দিচ্ছে, কাজ খোঁজার চেষ্টা করছে না।
ভারতে এখন বেকারত্বের হার পৌঁছেছে ৭.৪৩ শতাংশে। বেকারত্বের হার পুরুষদের মধ্যে ৬.৫৭ শতাংশ ও নারীদের মধ্যে ১৫.২০ শতাংশ। গ্রামীণ মহিলাদের বেকারত্ব যেখানে ১৩ শতাংশ সেখানে শহরে মহিলাদের বেকারত্বের হার ২১.৬ শতাংশ। পুরুষদের বেকারত্বের হার শহর ও গ্রামে যথাক্রমে ৬.৭ শতাংশ ও ৬.৫ শতাংশ। যতদিন যাচ্ছে বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতি বছর প্রায় ৮০ লক্ষ ছেলেমেয়ে স্কুল, কলেজ থেকে পাস করে বা ড্রপ আউট হয়ে কাজের বাজারে আসছে। কাজের বাজারে ফি বছর আসা কর্মপ্রার্থীদের সংখ্যার থেকে বেশি কাজ প্রতি বছর সৃষ্টি করতে না পারলে পুরোনো বেকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন কর্মপ্রার্থী ও কর্মচ্যুতির ফলে কাজ খুঁজতে থাকা মানুষের মিলিত কর্মসংস্থানের চাহিদা পূরণ তো হবেই না বরং কর্মক্ষম বিপুল মানুষ ফি বছর জব মার্কেট থেকে ড্রপ আউট হতে থাকবে।
শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে লেবার পার্টিসিপেশন রেট-র চিত্র হলোঃ নিরক্ষর - ১৮.২২ শতাংশ, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত - ৩১.১২ শতাংশ, ৬ষ্ঠ-৯ম পর্যন্ত - ৩৮.১৯ শতাংশ, ১০ম-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত - ৩৯.৪৫ শতাংশ এবং স্নাতক ও ততোধিক - ৬১.৪১ শতাংশ। বেকারত্বের হারের চিত্রটা এর ঠিক বিপরীত। যতো লেখাপড়া তত বেশি বেকারত্বের হার। ৫ম পর্যন্ত - ১ শতাংশ, ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম পর্যন্ত - ১.৮ শতাংশ, দশম থেকে দ্বাদশ - ১০.৭ শতাংশ, স্নাতক ও ততোধিক - ১৭.৪ শতাংশ। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান হার ভারতের ওয়ার্কফোর্সের দক্ষতা, যোগ্যতা কমিয়ে তাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল করে তুলছে। লেবার পার্টিসিপেশন রেট ক্রমশ কমছে। ২০২২ সালের মে, ২০২২ মাসে যা ছিল ৩৯.৯ শতাংশ, আগস্ট মাসে এসে তা কমে হয়েছে ৩৯.২৪ শতাংশ। এর পাশাপাশি বেকারত্বের হার মে মাসে ছিল ৭.১৪ শতাংশ, আগস্ট মাসে তা হয়েছে ৮.২৮ শতাংশ।
শ্রমশক্তি অপেক্ষাকৃত তরুণ হলে তা হতো অনেক দক্ষ। বেকারত্বের হারে এর ভয়ংকর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ১৫-১৯ বছরের ছেলেমেয়েদের বেকারত্বের হার ৫৮.৫১ শতাংশ, ২০ থেকে ২৪ - ৪৩.৩৬ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৯ - ১২.২৭ শতাংশ, ৩০ থেকে ৩৪ - ১.৮৫ শতাংশ, ৩৫ থেকে ৩৯ - ০.৬০ শতাংশ, ৪০ থেকে ৪৪ - ০.৪২ শতাংশ, ৪৫ থেকে ৪৯ - ০.২১ শতাংশ , ৫০ থেকে ৫৪ - ০.২৩ শতাংশ , ৫৫ থেকে ৫৯ - ০.২৬ শতাংশ , ৬০ থেকে ৬৪ - ০.২২ শতাংশ ৬৫ ঊর্ধ্বে - ০.৫৭ শতাংশ । যত কম বয়স তত বেশি বেকারি। বেকারত্বের এই হারের পাশে যদি লেবার পার্টিসিপেশন রেট বয়স অনুযায়ী সাজানো হয় তাহলে দেখা যাবে যত বেশি বয়স তত বেশি কর্মরত, আর বয়স যত কম তত বেশি বেকার। ভারতের ওয়ার্কফোর্স তাই বয়সেও প্রবীণ। পুরোনো যুগের প্রযুক্তি জ্ঞান থাকলেও তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে নতুন নতুন প্রযুক্তি যা আসছে সে সম্পর্কে দক্ষতা না থাকায় ক্রমাগত ওয়ার্ক ফোর্স পিছিয়ে পড়ছে। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের বেকারির হার ৫৮.৫১ শতাংশ, ২০ থেকে ২৪ - ৪৩.৩৬ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৯ - ১২.২৭ শতাংশ, ৩০ থেকে ৩৪ - ১.৮৫ শতাংশ। আবার ৫৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের বেকারত্বের হার ০.২৬ শতাংশ, ৬০ থেকে ৬৪ - ০.২২ শতাংশ সব থেকে খারাপ অবস্থা ১৫ থেকে ২৪ বছরের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। এদের কাজের সুযোগ সাংঘাতিক ভাবে কম। তরুণ প্রজন্মের অর্ধেকের বেশিই বেকার।
সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব কমিয়ে দেশকে আর্থিক সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখানো। সরকারি শূন্য পদে নিয়োগ না করে ব্যাপকভাবে সরকারি, আধা সরকারি, সরকার পোষিত সব দপ্তর, প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিল্প, কলকারখানা স্থাপনের জন্য পরিকাঠামো, উপযোগী মানবসম্পদ সৃষ্টির পরিকল্পিত উদ্যোগ সৃষ্টি না করে সরকার প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র, ব্যাঙ্ক, বিমা, খনি, বন্দর, রেল, বিমান বন্দর, প্রতিরক্ষা এমনকী শিক্ষা, জল, জঙ্গল, সড়ক, পরিবহণ করপোরেটের হাতে জলের দরে তুলে দিয়েছে। করপোরেট নেওয়ার পর ব্যাপক হারে কর্মী সংখ্যা কমেছে। নানা ক্ষেত্রে সরকার আবার স্থায়ী নিয়োগ না করে কন্ট্রাক্টস লেবারদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। সরকারের দায় কমেছে, ঠিকাদারি শোষণে সামান্য বেতনে দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে শ্রমিকরা। সরকারের স্থায়ী নিয়োগ থেকে সরে আসার আরেকটি বড়ো উদাহরণ হলো অগ্নিবীর প্রকল্প। অগ্নিবীরের বিরুদ্ধে গোটা দেশে কর্মপ্রার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভের সময় কিছু মিডিয়া অক্সফ্যাম, সিএমআইই-র আর্থিক সার্ভে রিপোর্টে প্রকাশিত ভয়ংকর বেকারির কথা দু-একবার আলোচনায় আনলেও অচিরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। মোদির আমলে কখনও ক্রমবর্ধমান বেকারি নিয়ে আলোচনা হয় না। চিতা থেকে লাভ জিহাদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন কি বাও’-এ কত কথা বলেন, কিন্তু ভুলেও বেকারি নিয়ে বলেন না। এ প্রসঙ্গে এত নীরবতা দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন দেশে বেকারি কোনো সমস্যাই নয়। অথচ ১৩০ কোটির দেশে কর্মরত মাত্র ৪০ কোটি মানুষ। দিশাহীন সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হলো করপোরেটের মুনাফা নিশ্চিত করা ও সরকারের সব দায় ও দায়িত্ব কমিয়ে ফেলা।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির জন্য ২২.০৫কোটি আবেদন জমা পড়েছে এবং তার মধ্যে থেকে ৭.২২ লক্ষ কর্মপ্রার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছে। ২০২১-২০২২ সালে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ ৭১ হাজার ১২১ টি আবেদন জমা পড়লেও নিয়োগ করা হয়েছে মাত্র ৩৮,৮৫০ জনকে। ২০২০-২০২১ সালে ১ কোটি ৮০ লক্ষ আবেদনের মধ্যে থেকে ৭৮,৫৫৫ কর্মপ্রার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছিল। ২০১৯-২০২০ সালে ১ কোটি ৭৮ লক্ষ আবেদনের মধ্যে নিয়োগ হয়েছিল ১ লক্ষ ৪৭ হাজার। প্রতি বছর আবেদন বাড়ছে আর সরকার সাংঘাতিক ভাবে নিয়োগ কমাচ্ছে। গত ৩ বছরের এই তথ্য থেকে বোঝা যায় সরকার কার্যত লোক নিয়োগ বন্ধ করার পথে চলেছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে অতিরিক্ত কর্মচারী আছে সব দপ্তরে। আইএএস, আইপিএস অফিসারের সংখ্যার ঘাটতি থাকলেও নিয়োগ হচ্ছে সামান্য। কর্মসংস্থান সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এমন হয় তবে সেই সরকারের আমলে বেসরকারি উদ্যোগে আর কতটুকু কর্মসংস্থান তৈরি হবে!
চারিদিকে বেকারের দল। শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের বেঁচে থাকার জন্য এমন সব পেশায় যুক্ত হতে হচ্ছে যেখানে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিগুলো মূল্যহীন। একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার চালাচ্ছে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নির্ভর বাইক অথবা হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করা যুবক হয়েছে অনলাইন দোকানের ডেলিভারি বয়। কোনো সামাজিক সুরক্ষার বালাই নেই। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির যুগে এইসব চুঁইয়ে আসা ভালনারেবল পেশায় ছেলেরা যদিওবা বাধ্য হয়ে ঢুকছে, মেয়েদের কাজের জায়গা থাকছে না কোথাও। লেখাপড়া করে যখন কিছুই হচ্ছে না তখন তার প্রতি আগ্রহ কমতে বাধ্য। তীব্র আর্থিক সংকটে লেখাপড়া চালানোটাও অনেকের কাছে বিলাসিতা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় একটা বেশ বড়ো সংখ্যক ছেলেমেয়ে (NEET-Not in Employment,Education or Training) কর্মসংস্থান, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ কোনো কিছুর মধ্যেই থাকছে না। এই অংশ বেড়ে চলেছে। এরা লেবার ফোর্সের বাইরে পড়ে থাকছে। এই অংশের সিংহভাগ দখল করে আছে মেয়েরা। অথচ স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্যাপনের বক্তৃতায় নারী শক্তি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন। যেটুকু কাজ আছে সেখানেও চরম দুর্নীতি, চুরি, জোচ্চুরি চলছে। মানুষকে প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে, অন্যদিকে টাকার পাহাড় তৈরি হচ্ছে। একটা প্রজন্ম আশা হারিয়ে ফেলছে। মদের বোতল, লটারির টিকিট, ফি বছর ক্লাবের নামে টাকা, ধর্মের নামে ঘৃণা, হানাহানিতে মত্ত রাখার সুকৌশলী ব্যবস্থায় শাসক তরুণ প্রজন্মকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ধ্বংস করছে নির্মম ভাবে। চাকরি, কাজ বলে কিছু তারা পেতে পারে এই বিশ্বাস চলে যাচ্ছে, ফলে প্রথাগত শিক্ষা থেকে প্রশিক্ষণ সবকিছু সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্মের এক সুবিশাল অংশ।
শিক্ষা, কাজের দাবিতে তাই লড়াই জরুরি। ছড়িয়ে, ছিটিয়ে দেওয়া যৎসামান্য সরকারি অনুদান আর ভেঙে পড়া রেশন ব্যবস্থা দিয়ে মিটবে না মানুষের জীবনের প্রধান সমস্যা। শাসকের মিথ্যাচার আর সর্বস্ব লুটের বিরুদ্ধে জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষা ও কাজের দাবির লড়াই এ দেশে, এ রাজ্যে জোরদার করতেই হবে। বদলাতে হবে আর্থিক নীতি, অভিমুখ।