৬০ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৬ আশ্বিন, ১৪২৯
দেশদ্রোহের ভুয়ো মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি চাই
অর্ণব ভট্টাচার্য
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত অনুচর এদেশের হিন্দুত্ববাদী শাসকরা এখনও ঔপনিবেশিক জমানার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশদ্রোহের অভিযোগে শতশত মানুষকে জেলে বন্দি করে রাখছে।
মোদি সরকারের আমলে ইউএপিএ আইন, জাতীয় সুরক্ষা আইন (এনএসএ) প্রভৃতির যথেচ্ছ ব্যবহার স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে ব্যাপকভাবে খর্ব করছে। এই সমস্ত দানবীয় ব্যবস্থা বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া যে সকল সাংবাদিক ও সমাজকর্মী সরকারের নানা নীতির বিরোধিতা করেন তাঁদেরকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যারা সিএএ-র সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করেছেন, দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসায় যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, যাঁরা দাঙ্গাপীড়িতদের সংহতি জানিয়েছেন বা সমর্থন জুগিয়েছেন তাঁদেরকেও এইসমস্ত দমনমূলক আইন প্রয়োগ করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় ১৬ জন বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীকে সাজানো অভিযোগে জেলবন্দি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ফাদার স্ট্যান স্বামী জেল কর্তৃপক্ষের চরম অমানবিক আচরণের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থাতেই মারা গেছেন। ২০২১ সালে ত্রিপুরাতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ সংঘটিত হওয়ার পর সেই ঘটনার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা করে মন্তব্য করার জন্য ১০২জনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র ধারায় মামলা করে ত্রিপুরার বিজেপি সরকার। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইউএপিএ-তে কেস দেওয়া বেড়েছে ৭২ শতাংশ যদিও দণ্ড হয়েছে মাত্র ২ শতাংশের।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এই যে, ইউএপিএ আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে বিচার ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবন্দি করে রাখা যায়। প্রথমে যখন এই আইন প্রবর্তন হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল যে, সন্ত্রাসবাদী ও বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু ২০১৯ সালের জুলাই মাসে নরেন্দ্র মোদি সরকার এমনভাবে এই আইনটিকে পরিবর্তন করে যার সুবাদে সরকার নিজের বিবেচনা মতো যে কাউকে সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যা দিতে পারে এবং তা কোর্টে প্রমাণ করতে সরকার বাধ্য নয়। দেখা গিয়েছে ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই আইনের প্রয়োগ করে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যাদের অর্ধেকেরও কমের বিচার শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে সুপ্রিমকোর্ট জানিয়েছে যে, আমাদের দেশের কারাগারগুলোতে যারা বন্দি রয়েছে তাদের নব্বই শতাংশেরও বেশি বিচারাধীন। অর্থাৎ আমাদের দেশে বিচারের প্রক্রিয়া এতটাই দীর্ঘ যে, এই প্রক্রিয়াই শাস্তির নামান্তর। আর ইউএপিএ আইনের ক্ষেত্রে বিচারের প্রক্রিয়া কখন শুরু হবে সেটাই জানা থাকে না। সবটাই নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছে,অনিচ্ছের ওপর। এই স্বৈরাচারী আইন আজ শাসকের খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করা হচ্ছে গণতন্ত্র ও প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করতে। এই দমনমূলক আইনের নির্মম প্রয়োগের যারা শিকার তাদের সকলের মুক্তির দাবিতে জনমত গড়ে তোলা তাই অত্যন্ত জরুরি।
সকলের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে যে, আজ থেকে দু’বছর আগে ২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এক ১৯ বছরের দলিত যুবতীর গণধর্ষণ ও হত্যা গোটা দেশে প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছিল। ধর্ষকরা উচ্চবর্ণের হওয়ায় তাদের অপরাধের প্রমাণ লোপাট করতে ধর্ষিতার মৃতদেহ পরিবারের সম্মতি ছাড়াই পুলিশের পক্ষ থেকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই জঘন্য অপরাধ ও উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের ন্যক্কারজনক আচরণের প্রতিবাদে প্রত্যেক সংবেদনশীল নাগরিক সোচ্চার হন। সেই সময় কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান এই অমানবিক ঘটনার অনুসন্ধান করবার জন্য উত্তরপ্রদেশে পৌঁছালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি নিষিদ্ধ সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার সদস্যদের সাথে নিয়ে দাঙ্গা বাধানোর উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছেন। এই গুরুতর অভিযোগটি যোগী সরকার আদালতে প্রমাণ করার আগেই সাংবাদিক কাপ্পানকে গ্রেফতার করা হয় এবং গত দু’বছর ধরে তিনি বিনা বিচারে জেলবন্দি আছেন।
সিদ্দিক কাপ্পানকে ভারতীয় দণ্ডবিধির নানারকম ধারা সহ ইউএপিএ এবং বেআইনি আর্থিক লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে পিএমএলএ ( Prevention of Money Laundering Act) প্রয়োগ করে এতদিন ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি তাঁকে মুক্তি দিলেও ইডি’র করা বেআইনি আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত মামলায় তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। অথচ তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষ থেকে টাকা জমা করার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি যোগী সরকারের পুলিশ। মোদ্দা কথা স্রেফ বিজেপি’র বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য সিদ্দিক কাপ্পানকে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কোর্টে কোনোরকম নথি জমা দিতে পারেনি সরকার। যা দেখে বোঝা যায় যে, তিনি অশান্তি বা প্ররোচনা সৃষ্টির চক্রান্ত করছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইউইউ ললিত, বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাট ও বিচারপতি পিএস নরসিমহা সাংবাদিক কাপ্পানকে ইউএপিএ সংক্রান্ত মামলায় জামিন দেওয়ার প্রসঙ্গে এই বিষয়টি উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। অথচ কার্যত সুপ্রিম কোর্টের মতামতকে পাশ কাটিয়ে কাপ্পানকে আরও কিছুকাল ছলেবলে জেলবন্দি রেখে মোদি সরকার এই বার্তা দিতে চায় যে, শাসকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে বিপদে পড়তে হবে। এভাবে কার্যত গোটা দেশে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিজেপি। যোগী-রাজত্বে উত্তরপ্রদেশে এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে যে, সিদ্দিক কাপ্পানের জন্য দু’জন জামিনদার পাওয়া যাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ৭৯ বছর বয়সি দর্শনের অধ্যাপিকা রূপরেখা ভার্মা সহ আরেকজন (যার পরিচয় সুরক্ষার কারণে গোপন রাখা হয়েছে) এগিয়ে আসেন। অধ্যাপিকা ভার্মা বলেছেন, ‘‘এই অন্ধকারে এইটুকু ন্যূনতম কাজ একজন নাগরিক করতে পারে।’’ প্রসঙ্গত, যে বিলকিস বানুর ধর্ষকদের মুক্তির বিরুদ্ধে যারা কোর্টে আপিল করেছেন তিনি তাঁদের একজন। দেশের দুঃসময়ে এই ধরনের নির্ভীকতা প্রগতিশীল নাগরিক সমাজকে মুক্তচিন্তার পক্ষে, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রেরণা জোগাক।