৬০ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৬ আশ্বিন, ১৪২৯
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতন সংগ্রাম
স্বপ্না ভট্টাচার্য
সমসাময়িক ভারতে মহিলা সমাজ নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সাধারণভাবে মহিলাদের আর্থিক, সামাজিক পারিবারিক ক্ষেত্রে অবস্থার ভয়াবহ অবনমন ঘটে চলেছে। বিশেষত দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মহিলাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক ও ভীতিকর হিংসাশ্রয়ী আক্রমণ। বিশেষত অল্প বয়সি কন্যা এবং মহিলারা প্রতিদিনই ক্রমবর্ধমানভাবে হিংসার শিকার হচ্ছেন। পণপ্রথা, গার্হস্থ্য হিংসা, পণসংক্রান্ত হিংসা, লাভ জিহাদের নামে হত্যা, পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে হত্যার মতো ঘটনা প্রতিদিনের রোজনামচা। কন্যাভ্রূণ হত্যা, সদ্যোজাত কন্যা হত্যা, শিশু কন্যা বিবাহ, নারী শিশু বিক্রয়, নারী ও শিশু পাচার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যৌন হেনস্তা, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এমনকী ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে হত্যা করে প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা অহরহ ঘটে চলেছে। অপরদিকে অপরাধীরা প্রশাসনের সাহায্যে পার পেয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ঘৃণ্য অপরাধে যুক্ত অপরাধীরা শাসকদলের প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষ মদতে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ক্ষমতাবান হিসাবে জাহির করে চলেছে, অথচ ধর্ষিতা ও তার পরিবার বিচার পাচ্ছেন না। গুজরাটে বিলকিস বানুর ঘটনা আমাদের ভয়ানকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। যে ঘৃণ্য অপরাধে প্রমাণিত ধর্ষকেরা যাবজ্জীবন জেলের সাজা খাটার কথা, সেখানে বিজেপি-শাসিত রাজ্যের সরকারের উমেদারিতে অপরাধীরা ছাড়া পেল অথচ বিলকিস বানুর জন্য মামলা চালানো আইনজীবী তিস্তা শীতলবাদকে গ্রেপ্তার করা হলো বিনাবিচারে। এ এক অদ্ভুত নৈরাজ্যবাদ।
নারী ধর্ষণের ক্ষেত্রে এক তৃতীয়াংশ ঘটনা কন্যা শিশুদের ওপর ঘটছে। সারা দেশেই এই যন্ত্রণাদায়ক চিত্র আমরা লক্ষ করছি। এমনকী ৮ মাসের শিশুকন্যাও ছাড় পাচ্ছে না। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী প্রতিমাসে দিল্লিতে ৭টি করে ‘পকসো’ (POCSO) কেস দায়ের করা হয়। উত্তর প্রদেশ, পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন রাজ্যেও কন্যাশিশুদের ওপর অত্যাচার বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন রিপোর্ট (TRFR) অনুযায়ী নারী পাচারের প্রশ্নে ভারত অত্যন্ত বিপজ্জনক দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। যৌন দাসত্ব, গৃহস্থালী কাজ, জোরপূর্বক বিবাহ সহ অসংখ্য ঘৃণ্যজনক অপরাধমূলক কাজে মহিলাদের যুক্ত করার মতো ভয়াবহ ও নির্মম ঘটনা ঘটে চলেছে। জাতীয় মহিলা কমিশন (NCW) দেখিয়েছে যে, ২০২০-র তুলনায় ২০২১-এ নারীর ওপর হিংসার ঘটনা ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ঘটনা পারিবারিক হিংসার কারণে যা স্বামী অথবা নিকটাত্মীয়দের থেকে ঘটেছে। ২০২২-এ এই ঘটনা কমেনি বরং বেড়েছে।
২০১৯ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী ১০ জন দলিত মহিলা প্রতিদিন ধর্ষিতা হচ্ছেন। প্রকৃত ঘটনা এর থেকে আরও বেশি ভয়াবহ। তথ্যানুযায়ী ৮৭ জন মহিলা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের শিকার। ২০১৯ সালে ৪,০৫,৮৬১টি হিংসার ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। সরকারি এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী প্রতি ১৬ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন। কী অমানবিক ও নিদারুণ যন্ত্রণার ছবি। যদিও এই তথ্যই শেষ কথা নয় কারণ অনেক মহিলাই ভয়ে লজ্জায় অপমানে প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে পারেন না। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে অক্ষম নারীরাও নির্যাতনের শিকার।
বিজেপি শাসিত রাজ্যে মহিলাদের অবস্থা
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে চলেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা সংঘ পরিবার দ্বারা পরিচালিত বিজেপি দলের ও তাদের সরকারের নারীদের প্রশ্নে বক্তব্য স্পষ্ট। মনুবাদী দর্শন দ্বারা পরিচালিত এই দল ও তার সরকার, নারীদের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে কতটা অমানবিক তা বোঝা যায় তাদের কাজ ও বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে। বিজেপি’র মহিলা মোর্চার প্রাক্তন সভানেত্রী মৃদুলা সিন্হার বক্তব্য হলোঃ ‘‘We in Bharatiya Janata Party are opposed to women’s liberation’’। সংঘ পরিবারের কাছে নারী হলো শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র এবং নারী হলো পণ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মহিলাদের ভোট আদায়ের লক্ষ্যে ভাষণ দিচ্ছেন ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’ অথচ তার সময়কালে নারীর সম্মান, ইজ্জত, অধিকার আজ ভুলুণ্ঠিত। বর্বরতার চূড়ান্ত নজির দেখতে পাচ্ছি। পশ্চাৎগামী মনুবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত সরকার পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী আচরণগুলির আবহ বাড়িয়ে তুলেছে। তাই তাদের কাছে আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু মুসলমান ও নারী সমাজ আজ অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
উত্তর প্রদেশে উন্নাওয়ে ১৭ বছরের দলিত মেয়েকে ধর্ষণ ও মেয়েটির পিতাকে হত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে চলেছে। হাথরসে ১৯ বছরের দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় পুড়িয়ে মারার ঘটনা, জম্মুর কাঠুয়ায় মন্দিরের মধ্যেই পুরোহিত ও তার পুত্রের দ্বারা শিশু কন্যাকে ধর্ষণ এবং খুন করা, অতি সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে লখিমপুর খেরিতে মায়ের সামনে থেকে দুই বোনকে টেনে নিয়ে ধর্ষণ ও পরে গাছে ঝুলিয়ে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতে পিলভিতে দুই বোনকে ধর্ষণ করে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে মারার ঘটনাগুলি শিউরে ওঠার মতো। এই ধরনের অপরাধের রেখচিত্র ক্রমাগত ঊর্ধ্বগামী। এ কোন দেশ?
অপরাধের নির্মমতা সর্বত্র
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজকরা মহিলাসহ, অফিস, আদালত, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত মহিলারা যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে ‘Me too’ (আমিও) এই আন্দোলন গড়ে তুলেছে। লজ্জাজনক বিষয় হলো অভিনেত্রী, গায়িকা, শিক্ষিত মহিলা, কর্মরত শ্রমজীবী মহিলা, শিক্ষিকা, ছাত্রী কেউই যৌন হয়রানি থেকে বাদ যাচ্ছেন না।
নারীদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিবাহ করতে না দেওয়া, পারিবারিক সম্মানের নামে হত্যা, উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা দলিত ও নিম্নবর্ণের মহিলাদের হত্যার মতো ঘটনাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে। বিভিন্ন রাজ্যে জাতভিত্তিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রান্তিক মহিলাদের অবস্থা আরও অবর্ণনীয় হয়ে উঠছে। দলিত ও আদিবাসী মহিলাদের ডাইন অপবাদ দিয়ে গৃহচ্যুত ও সমাজচ্যুত করা হচ্ছে। পণজনিত নির্যাতন ও গার্হস্থ্য হিংসাকে রোখার জন্য ৪৯৮-এ ধারাকে লঘু করে পারিবারিক সম্মানকে পবিত্র হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে, ‘ভার্মা কমিশন’র সুপারিশ কার্যকর করা হচ্ছে না। যা অপরাধ ঘটে তার মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীরা আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। বৈবাহিক ধর্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহিলা গোষ্ঠী, ধর্ষণের ঘটনাকে ৩৭৬ আইপিসি ধারায় অপরাধ বলে চিহ্নিত করার দাবি তোলার সাথে সাথে বৈবাহিক ধর্ষণকে ব্যতিক্রম হিসাবে আইপিসি হিসাবে আইপিসি ধারা থেকে সরিয়ে দেওয়ারও বিরোধিতা করেছে। সংরক্ষণবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক যে ভাবনার অস্তিত্ব বিচারব্যবস্থার একাংশকে গ্রাস করেছে তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার দাবি তুলেছে।
একইসাথে রাষ্ট্রীয় মদতে এই ধরনের সংরক্ষণবাদীরা নারীদের ক্ষেত্রে যে সব ফতোয়া জারি করে চলেছে - বিবাহের বয়স (যা ইতিমধ্যেই সংবিধানে প্রদত্ত) নতুন করে চাপিয়ে দেওয়া, পোশাকের বিধি লাগু, খাপ পঞ্চায়েতে মহিলাদের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা জারি এই ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়েও মহিলাদের ওপর আক্রমণ শানিত হচ্ছে।
পশ্চিম বাংলার পরিস্থিতি
আমাদের রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। অথচ তাঁরই শাসনকালে প্রতিনিয়ত মহিলারা জঘন্যতম আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ২০১১-র পরবর্তী সময়ে কামদুনি, পার্কস্ট্রিটের ঘটনায় আমরা রাজ্যের মহিলারা শিহরিত হয়েছিলাম। অপরাধীরা শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে প্রকৃত বিচার করে অপরাধীর সাজা ঘোষণা আজ অলীক স্বপ্নমাত্র। মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষিতার মান-সম্মান, মর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে তার দাম স্থির করে দেন। এরফলে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়। আমাদের রাজ্যে ধর্ষণের মতো লজ্জাকর ঘটনা হলো রোজকার দিননামচা। নদীয়ার বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী থেকে শুরু করে, বিশেষভাবে সক্ষম মহিলা, কন্যাশিশু, শ্রমজীবী মহিলা, যুবতী, ছাত্রী কেউই দুষ্কৃতীদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না, অথচ অবাক বিষয় হলো এই অপরাধীরা হয় ধরা পড়ে না বা ধরা পড়লেও পুলিশ প্রশাসনের অপদার্থতায় ছাড়া পায়। ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে নির্যাতিতারা ও ধর্ষিতা সহ তার পরিবারের লোকজন। দলিত, আদিবাসী সংখ্যালঘু মহিলা কেউই এর বাইরে নন।
আমাদের রাজ্যে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের বিষয়গুলি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সহ রাজ্য মহিলা কমিশন উদাসীন ও নির্বিকার। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর ঢক্কানিনাদের আড়ালে আজ নারী পাচার, বাল্যবিবাহের সংখ্যা আমাদের রাজ্যে ঊর্ধ্বমুখী, এমনকী যে নারী নির্যাতিতা, ধর্ষিতা হচ্ছেন রাজ্য প্রশাসনের কাছে তারা উপস্থিত হতে পারেন না। নদীয়ার হাঁসখালীতে নাবালিকা কন্যাকে তৃণমূলের নেতার পুত্র ও বন্ধুরা ধর্ষণ করে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা, বিহারের ট্যাক্সি চালকের কন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা (যার পরিবার ছিল আমাদের রাজ্যের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা) - প্রতিদিন এই ধরনের অসংখ্য ঘটনা আমাদের হতবাক করে দিচ্ছে। অপরাধীর বিরুদ্ধে যাতে ধর্ষিতা ও তার পরিবার অভিযোগ দায়ের না করতে পারে তারজন্য তৃণমূল মাতব্বর ও পুলিশ প্রশাসন সর্বদা তৎপর থাকে ও ওই পরিবারের ওপর ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। কাকদ্বীপ থেকে কামদুনি, গেঁদে থেকে উত্তর দিনাজপুর, রাজ্যের প্রত্যেক জায়গায় এই ভয়াবহ চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করছি। মুখ্যমন্ত্রী ‘বাংলার মেয়ে’ অথচ সেই বাংলার মেয়েরা আজ সুরক্ষিত নয় এটা যথেষ্ট বেদনাদায়ক।
এনসিআরবি রিপোর্টে নাবালিকা বিক্রিতে পশ্চিমবঙ্গ একদম সামনের সারিতে। এদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬-২০১৮ পশ্চিমবঙ্গে শিশু ও নারী হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অথচ মাত্র ১ শতাংশ অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
বিভিন্ন রাজ্য সহ দেশজুড়ে মহিলাদের ওপর এই ভয়াবহ, অমানবিক, পাশবিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র ২৩তম কংগ্রেস ও ২৬তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন থেকে মহিলাদের ওপর প্রতিটি আক্রমণের বিরুদ্ধে পার্টিকে দ্রুততার সাথে নির্ধারক এবং সঠিক কার্যকর ভূমিকা নেবার প্রয়োজনে বেশি বেশি করে নারী ও পুরুষের সমবেত উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে এবং এর মধ্যে দিয়ে নারীর প্রতি সমস্ত অবিচার, হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছে মহিলাদের একতা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে সেই সঙ্গে।
আসুন আজকের এই আলোচনার মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি সমস্ত ধরনের অন্যায়, হিংসা, অবিচারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ লড়াইয়ের অঙ্গীকার গ্রহণ করি।