৬০ বর্ষ ৭ সংখ্যা / ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ৬ আশ্বিন, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (দুই)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
আধুনিক যুগে আমরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রত্যক্ষ করছি। প্রকৃতি বিজ্ঞানের অসংখ্য শাখা, সমাজবিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি শাখা, এই জ্ঞানের প্রতিটি বিভাগেও কত শাখা। দর্শনকেও জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট শাখা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অতীতে জ্ঞানের বর্তমান বিকাশ ঘটেনি, সেই সময়ে বিভিন্ন চর্চা তথা অনুসন্ধানে লব্ধ জ্ঞানকে দর্শন হিসাবে অভিহিত করা হতো। সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তি, তিনি যে শাখারই হোন না কেন, তাকে দার্শনিক হিসাবে বিবেচনা করা হলো। যার জন্যই কার্ল মার্কস বলেছেন, ‘‘যে-কোনো যুগের প্রকৃত দর্শন হলো সেই যুগের বুদ্ধিগত বিকাশের সারাংশ।’’ (Every true philosophy is the intellectual quint essence of its time- Marx.)
দর্শন সব সময়েই শ্রেণির দর্শন
● শ্রেণিহীন কোনো দর্শনের অস্তিত্ব নেই। দর্শন সবসময়ই কোনো না কোনো শ্রেণির স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। দর্শন হয় শোষকশ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে অথবা দর্শন শোষিত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। শোষিতদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনায় উৎসাহিত করে, উদ্বুদ্ধ করে, সাহায্য করে। শ্রেণি নিরপেক্ষ দর্শন কখনো হয় না। আমরা যে মার্কসীয় দর্শন অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক-ঐতিহাসিক দর্শনের চর্চা করছি, তা হলো আধুনিক যুগের সর্বাপেক্ষা বিপ্লবী শ্রেণি, সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির দর্শন।
দর্শনের প্রধানত দুইটি ধারা
● অতীতকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দর্শনের ইতিহাস যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে দর্শনের মূলত দুইটি ধারা। একটি হলো বস্তুবাদী দর্শন, অপর ধারাটি হলো ভাববাদী দর্শন। মূলত বস্তু ও চেতনার সম্পর্ককে ঘিরেই দর্শনের এই বিভাজন। বস্তুবাদী দর্শনের বক্তব্য হলো, বস্তুই আদি, মুখ্য ও সত্য। বস্তুর বিকাশের ধারায় চেতনার আবির্ভাব ঘটেছে। বস্তুবাদ কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি, অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে না। বিষয়টি বোঝার জন্য একটু আলোচনা করা যাক। এই পৃথিবীতে অজৈব পদার্থ বিকাশের ধারায় (জলের মধ্যে কোটি কোটি বছর ধরে এই বিক্রিয়া চলেছে। এই বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়েছে। জৈব পদার্থকে অবলম্বন করে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে)। প্রাণ সৃষ্টির পরই প্রাণের বিবর্তন ধারা শুরু হয়েছে। প্রাণের বিবর্তন ধারাতেই সরল থেকে জটিল প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। মেরুদণ্ডী, স্তন্যপায়ী স্তরের মধ্য দিয়ে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে বিবর্তনের ধারায়। হোমো স্যাপিয়েস, স্যাপিয়েন্স এই হলো বর্তমান মানুষের পরিচয়। মানুষের রয়েছে মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক কী? একটি বস্তু। শুধুমাত্র বস্তু নয়, অতি-উন্নতমানের বস্তু। মস্তিষ্ক রূপের বস্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটা বহির্জগতকে প্রতিফলিত করতে সক্ষম। শুধুমাত্র প্রতিফলিতই করে না, তাকে বিশ্লেষণও করতে পারে। কোটি কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীতে বস্তুর নিরন্তর বিকাশের ধারায় মস্তিষ্কের গঠন সম্ভব হয়েছে। অতি-সূক্ষ্ম বস্তুই হলো মানব মস্তিষ্ক। মানব মস্তিষ্কের কার্যধারার ফল হলো চেতনা। তাহলে তো এটা বোঝার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হওয়া উচিত নয় যে, বস্তুকে (এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক) ভিত্তি করেই চেতনা।
● ভাববাদী দর্শনের বক্তব্য হলো, চেতনাই আদি মুখ্য ও সত্য। চেতনার ইচ্ছানুসারে বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। ঈশ্বর-কল্পনা ভাববাদকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। ঈশ্বর তথা অতীন্দ্রিয় শক্তির সৃষ্টি এই জগৎ, মানব সমাজ। আর এক ধরনের ভাববাদ রয়েছে, যার বক্তব্য হলো আমরা যা চাইছি, তাই বাস্তবে দেখছি। আমি যেভাবে দেখতে চাইছি, তাই দেখছি। যেমন সবুজ রঙের গাছ আমি চাইছি, তাই দেখছি। বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। সবই মায়া। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে, যাকে ঘিরে বস্তুবাদ ও ভাববাদের শিবিরে বিতর্ক রয়েছে। বস্তুকে কি জানা সম্ভব?
● এক্ষেত্রে বস্তুবাদের বক্তব্য হলো বস্তুজগৎ অসীম, এর কোনো সীমা নেই। তবে নির্দিষ্ট বস্তুকে যদি জানার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেই বস্তু সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়। সেই জানা বা জ্ঞান বাস্তব। মানব সভ্যতার যা কিছু সৃষ্টি আমাদের চারপাশে তা তো বাস্তব। জ্ঞান বাস্তব বলেই তাকে আশ্রয় করেই সমস্ত সৃষ্টি-উদ্ভাবন সমস্ত কিছু সম্ভব হয়েছে। বহু কিছুই জানার বাইরে। জানবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলির বিকাশ আগামীদিনে বহু অজানাকে জানতে সাহায্য করবে।
● ভাববাদের এব্যাপারে দুই ধরনের বক্তব্য রয়েছে। এক ধরনের ভাববাদীরা বলেন - সবই যেহেতু সেই অতীন্দ্রিয় শক্তির সৃষ্টি, আর তিনি যেহেতু মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তাই তাঁর সৃষ্টিকেও প্রকৃতপথে জানা সম্ভব নয়। (বিষয়গত ভাববাদ)
● আর এক ধরনের ভাববাদীরা বলেন - চেতনা চাইছে বলেই কোনো বস্তুকে দেখছে। যে বস্তুকে দেখছে, তার সম্বন্ধে চেষ্টা করলে জানা হয়তো সম্ভব। কিন্তু সেই জানা শেষ বিচারে সঠিক নয়। কারণ কোনো কিছুরই তো বাস্তব অস্তিত্ব নেই, সবই মায়া। বস্তুবাদই - বস্তুকে জানা সম্ভব ও সেই জানাটা যে বাস্তব, একথা সোচ্চারে তুলে ধরে।
● মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলি সমাধানে তারা বস্তুবাদকেই আশ্রয় করে, অবলম্বন করে। মানুষের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম ক্রমান্বয়ে বস্তুবাদকে২ই পুষ্ট করেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ক্রমান্বয়ে বস্তুবাদকে পুষ্ট করে চলেছে।
● প্রসঙ্গত, বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতি বস্তুজগতের অসীমতা সম্পর্কে স্বচ্ছ্তর ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। অতি-শক্তিশালী জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ যা কিছুকাল পূর্বে প্রেরণ করা হয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কিত অনুসন্ধানের জন্য, তার থেকে প্রতিদিন অসংখ্য নতুন তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। সর্বশেষ যে তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে, তার থেকে বস্তুজগতের অসীমতা উপলব্ধি করা সহজতর হচ্ছে।
বস্তুর অস্তিত্বকে বাতিল করার ব্যর্থ প্রয়াস
● বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে বস্তুর অস্তিত্বকে বাতিল করার প্রয়াসও লক্ষ করা যায়। বিশেষকরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইলেকট্রনের আবিষ্কার সহ আরও বেশকিছু আবিষ্কার এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে বস্তুর অস্তিত্ব বাতিল করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়, যার মূল লক্ষ্য ছিল, বস্তুবাদকে অস্বীকার করা। সেই সময়ে মার্কস ও এঙ্গেলস জীবিত নেই। তাই লেনিনকে বস্তুবাদী দর্শনকে রক্ষা ও পুষ্ট করার লড়াইয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে হলো। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বিজ্ঞানের নব নব অগ্রগতি ও আবিষ্কারগুলি বস্তুবাদকেই পুষ্ট করে চলেছে।
● অনাদিকাল ধরে বস্তু নানারূপে বিরাজ করছে। তাই এর সৃষ্টি বা স্রষ্টার প্রশ্ন থাকতেই পারে না। কোনো একটি লক্ষ্য নিয়ে এই মহাবিশ্ব - যা অনাদি ও অসীম - এই তত্ত্বকে বস্তুবাদ খারিজ করে। সচেতন বস্তু, মানুষ সচেতনভাবে তাদের কার্যধারা পরিচালনা করে। বস্তুবাদ একথাও বলে যে, মানুষের চিন্তা, আবেগ, আদর্শ, চাহিদাগুলি গড়ে ওঠে জীব হিসাবে এবং এই পৃথিবী গ্রহে অন্য জীবগুলির সাথে তার সম্পর্কের ভিত্তিতে। তার সাথে যে-কোনো সমাজের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই চিন্তা, আবেগ, আদর্শ ও চাহিদাগুলি গড়ে ওঠে।
● বস্তুবাদ একথাই বলে যে, একমাত্র ব্যবহারিক কার্যধারায়, শ্রম প্রয়োগের ধারায় নির্দিষ্ট বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। বিজ্ঞানই হলো সেই হাতিয়ার, যার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানার্জন সম্ভব।
বিজ্ঞান
● বস্তুবাদের আলোচনায় বিজ্ঞানের আলোচনা আসা স্বাভাবিক। তবে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিজ্ঞান প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। পৃথিবীর বুকে আবির্ভাব লগ্ন থেকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিরন্তর-ধারাবাহিক সংগ্রাম মানুষ করেছে। দাঁড়াতে হয়েছে প্রকৃতিজগতের মুখোমুখি।
● প্রকৃতিজগতের বুকে নিরন্তর সংগ্রামের ধারাতেই বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃতিজগতের নিয়মগুলি জানাই তো হলো বিজ্ঞান। মানবসমাজও প্রকৃতিজগতের অংশ। বিজ্ঞানের যে পদ্ধতি অর্থাৎ অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ, পরীক্ষা, সিদ্ধান্ত, যাচাই, সূত্র - এই পদ্ধতি তো জ্ঞানের সমস্ত শাখাই অনুসরণ করে।
● যে-কোনো বস্তুর (প্রকৃতি ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই) অভ্যন্তরকে জানা, বাইরের ও অভ্যন্তরের রূপকে ভালো করে অধ্যয়ন করা এবং সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই তো হলো বিজ্ঞান। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, প্রকৃতি জগৎ এবং মানবসমাজের আন্তঃসম্পর্কই বিজ্ঞানের ভিত্তি।
● বিজ্ঞান নিরন্তর অগ্রগতির ধারায় রয়েছে। কিভাবে প্রাচীনকালের বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে মধ্যযুগের বিজ্ঞান ও পরবর্তীকালে আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ, যা আজও ঘটে চলেছে, সে সম্পর্কে আমরা কম-বেশি অবহিত। বস্তু সম্পর্কিত সংকীর্ণ ধারণা তো ভেঙে দিয়েছে বিজ্ঞান। শক্তিও বস্তুর একটি রূপ - এটা তো বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জেনেছি। বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতি বস্তুজগতের অসীমতা সম্পর্কে ধারণাকে বহুগুণ উন্নত করেছে।