E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮

কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করল তৃণমূল

ইতিবাচক দিক হলো বামফ্রন্টের ভোট শতাংশের বৃদ্ধি


জয়ের শংসাপত্র হাতে ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই(এম) প্রার্থী নন্দিতা রায়।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ভোটের প্রহসনে কলকাতা কর্পোরেশন দখল নিল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। লাগামহীন সন্ত্রাস, ভোট লুট ও মানুষের ভোটাধিকার নির্বিচারে কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্র নিধনের নজির রেখে কর্পোরেশনের ১৪৪টি আসনের মধ্যে ১৩৪টি ওয়ার্ড কবজা করে তৃণমূল কংগ্রেস। এসব সত্ত্বেও ২টি আসন পেয়েছে বামফ্রন্ট। এছাড়া কংগ্রেস ২টি এবং বিজেপি ৩টি আসন পেয়েছে। শতাং‍‌শের হারে তৃণমূল কংগ্রেস ৭২.১২ শতাংশ ভোট দখল করেছে। বামফ্রন্ট পেয়েছে ১১.৮৯ শতাংশ ভোট। অপরদিকে কংগ্রেস ৪.১৩ শতাংশ এবং বিজেপি ৯.২১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। লক্ষণীয় দিক হলো, এই প্রহসনের নির্বাচনেও গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বামফ্রন্টের ভোট প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্বাধীনতার পর কলকাতা মহানগরে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, কলঙ্কজনক নির্বাচন হয়েছে এবারের কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচন। শাসকদল তৃণমূল নির্লজ্জভাবে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে নিশ্চল করে হিংসা-সন্ত্রাস-রিগিংয়ের মধ্য দিয়ে কার্যত কর্পোরেশনকে বিরোধীশূন্য করতে চেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই ভোট লুটের ফলাফলে শাসকদলের ভোট সন্ত্রাসের নজির প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেকগুলি ওয়ার্ডের বুথে বামপন্থীরা ‘শূন্য’ পেয়েছেন।

এমনই কলঙ্কজনক ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘এই জয় গণতন্ত্রের জয়। গণতন্ত্রের উৎসবের জয়। যে রায় মা-মাটি-মানুষ দিয়েছে তারপরে আমাদের আরও মাথানত করে কাজ করতে হবে।’ তাঁর এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণার পর বিভিন্ন স্থানে তৃণমূল বাহিনী দল বেঁধে হামলা চালিয়েছে। টালিগঞ্জের নেতাজিনগরে সিপিআই(এম) এবং বাস্তুহারা পরিষদের অফিস সহ গণসংগঠনের বেশ কয়েকটি দপ্তর দখল করে নেয় মমতা ব্যানার্জির ‘নত’ শাকরেদরা। পরে অবশ্য এই দপ্তরগুলি সম্পূর্ণ তৃণমূলের দখলমুক্ত করা হয়।

এবারের কর্পোরেশন নির্বাচনে এই সমস্ত কদর্য ঘটনার সাক্ষী রইলেন কলকাতা মহানগরীর মানুষ।

এমনই একটি হিংসা ও ভোট সন্ত্রাসের আবহের মধ্যেও শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে বামফ্রন্টের। বামফ্রন্টের জেতা ২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯২ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই প্রার্থী মধুছন্দা দেব জয়ী হয়েছেন ২১৭৮ ভোটে। এবং ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই (এম) প্রার্থী নন্দিতা রায় জিতেছেন ৯২ ভোটে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ৬৫টি ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট ভোট প্রাপ্তির নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। অপরদিকে কংগ্রেস রয়েছে ১৭টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থানে। আর ৪৭টি ওয়ার্ডে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এছাড়া ৫টি ওয়ার্ডে নির্দলরা দ্বিতীয় স্থানে এবং তৃণমূল ১০টি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

মমতা ব্যানার্জি এবারের কর্পোরেশনের সন্ত্রাস, ভোটলুট ও প্রহসনের কলঙ্কজনক ভোটকে গণতন্ত্রের উৎসব বলে বর্ণনা করেছেন। অথচ নির্বাচনের ফলাফলে তাঁর সেই ঘোষণা পুরোপুরি নস্যাৎ হয়ে কদর্য দিকই প্রকট হয়ে উঠেছে। যেমন ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩৯ নম্বর বুথ। এখানে তৃণমূল প্রার্থীর পক্ষে ভোটবাক্সে পড়েছে ১০০৯টি ভোট, অন্যদিকে সিপিআই(এম) শূন্য। পাশের ১৪০ নম্বর বুথ - তৃণমূল পেয়েছে ১১৬৮টি ভোট, সিপিআই(এম)’র ঝু‍‌লি‍‌তে গেছে মাত্র ১টি ভোট! তেমনি পাশের ১৪১ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৯৬৫টি ভোট, সিপিআই(এম) প্রার্থীর পক্ষে পড়েছে ১টি ভোট! এরপর ১৪২ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৯০০টি ভোট, সিপিআই(এম) ২টি!

বেলেঘাটার ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে শাসকদল তৃণমূল ৯৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এখানে তৃণমূল ভোট লুঠ করতে এসে হিসাব মাথায় রাখেনি। এখানে তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ২০,৮৯৭টি ভোট। আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিপিআই(এম) প্রার্থী সাকুল্যে পেয়েছেন ৯৫৩টি ভোট। এই ওয়ার্ডেই ২৭ নম্বর বুথে তৃণমূলের পক্ষে ভোট পড়েছে ৮৩৮টি। সিপিআই (এম) প্রার্থী পেয়েছেন ১টি ভোট, বিজেপি শূন্য। পাশের ২৮ নম্বর বুথে তৃণমূলের ঝুলিতে গেছে ৩৭৫টি ভোট, সিপিআই (এম) শূন্য, বিজেপি ২টি। পাশের ২৬ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৬৮৬টি ভোট, সিপিআই (এম) একটি ভোটও পায়নি, বিজেপি ২টি ভোট পেয়েছে।

ভোটলুটের এমন অসংখ্য নজির ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ওয়ার্ডে। আরও আশ্চর্যের ঘটনা হলো, ভোটের ফল প্রকাশের ১২ঘণ্টা আগেই রাতে উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন স্থানে জয়ী হওয়ার হোর্ডিং লাগিয়ে দেয় তৃণমূল কংগ্রেস। এছাড়া ভোটগণনার আগেই মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায় তাঁর ভাইয়ের স্ত্রীর ছবি দিয়ে ভবানীপুরের মানুষকে বিপুল ভোটে জয়ী করার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে হোর্ডিং লাগিয়ে দেওয়া হয়।

কলকাতায় ব্যাপক রিগিং ও লুটের ভোটের পরও তৃণমূল-বিজেপি’র দ্বিমেরু তত্ত্ব খারিজ হয়ে গেছে। কিছু সংস্থা এই নির্বাচনেও প্রাক্‌ নির্বাচনী সমীক্ষা চালিয়ে তৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে প্রচার করেছিল এবং বামফ্রন্টকে শূন্যে নামিয়ে দিয়েছিল। তাদের হিসাব ধুয়েমুছে গেছে। কলকাতায় ভোট লুটের নির্বাচনের পরেও ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিকভাবেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বামফ্রন্ট। ভোট বেড়েছে কংগ্রেসেরও।

গত নিবধানসভা নির্বাচনে কলকাতার ১৭টি আসনের মধ্যে ১৬টিতেই দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। এবার কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজেপি মাত্র ৬টি বিধানসভা আসনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আর কংগ্রেস কোনো বিধানসভা আসনেই দ্বিতীয় স্থানে ছিলনা। এবারে তারা ৪টি বিধানসভা আসনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

কাশীপুর-বেলগাছিয়া, শ্যামপুকুর, কসবা, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, বেহালা পূর্ব ও বেহালা পশ্চিম - এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে এখন বামফ্রন্ট। আর বেলেঘাটা, চৌরঙ্গি, বালিগঞ্জ, মেটিয়াবুরুজে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেস।

২১ ডিসেম্বর কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সাংবাদিক বৈঠকে বামফ্রন্ট নেতা রবীন দেব বলেছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের মদতে শাসকদল নির্লজ্জের মতো ভোট লুট করার পরেও কলকাতার মানুষের বামপন্থীদের ওপরে ভরসা বৃদ্ধিকে ঢেকে রাখা যায়নি। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার ৩ লক্ষের বেশি মানুষ বামফ্রন্টকে ভোট দিয়েছেন। বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় বারো শতাংশ হয়ে গেছে। কংগ্রেসের ভোটও বেড়েছে। ভোট শতাংশের বিচারে এখন তৃণমূলের পরেই রয়েছে বামফ্রন্ট, বিজেপি নয়।

তৃণমূল এবং বিজেপি-র মধ্যে মেরুকরণ ভেঙে কলকাতার মানুষ যে প্রকৃত বিকল্প বামফ্রন্টের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছেন, সেই কথা উল্লেখ করে রবীন দেব বলেছেন, মিডিয়ার মাধ্যমে এবং বিপুল টাকা খরচ করে প্রচারে মানুষের মধ্যে তৃণমূল-বিজেপি-র মেরুকরণ তুলে ধরা হয়েছিল। এই বছরেই সাত-আট মাস আগের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবং বিজেপি এই মেরুকরণের ফায়দা তুলেছিল। তারপর কেউ কেউ বলা শুরু করেছিল বামফ্রন্ট অস্তিত্বহীন, তারা শূন্য। কিন্তু এখন কর্পোরেশন নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল এবং বিজেপি-কে পরস্পরের বিকল্প ভাবার বিভ্রান্তি মানুষের মধ্যে কেটে যাচ্ছে। মানুষ প্রকৃত বিকল্পকে চিনতে পারছেন। এই সন্ত্রাস, ভোট লুট আর প্রহসনের নির্বাচনের ফলাফল প্রকৃত জনমতকে না বোঝালেও বামফ্রন্টের প্রতি যে মানুষের ভরসা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। কলকাতার ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে, মহামারীর সময়ে রেড ভলান্টিয়ারদের মানুষের পাশে থাকার কারণে মানুষ রাজনৈতিক বার্তাটুকু স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় বামপন্থীদের ওপর তাণ্ডব ও তাঁদের কার্যালয়ে হামলা ও দখলের ঘটনার নিন্দা করে রবীন দেব বলেন, কার্যালয় দখলের জন্য হামলা হচ্ছে, আর মন্ত্রী নিজেই তাতে সাফাই গেয়ে মদত দিচ্ছেন। বেআইনি কিছু থাকলে সেটা তো প্রশাসনের আইন মোতাবেক দেখার দায়িত্ব, তৃণমূলকে আইন হাতে নেবার অধিকার কে দিল? তিনি বলেন, আমরা গণতান্ত্রিকভাবেই এই আক্রমণের প্রতি‍‌রোধ করব। এছাড়াও এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এবং কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক কল্লোল মজুমদার।

কল্লোল মজুমদার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা কোথায় কোথায় আমাদের গণভিত্তি আছে, তা দেখে নিয়ে ১৭টি আসন বাদ রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ওই ১৭টি আসনে তৃণমূল এবং বিজেপি-বিরোধী শক্তিকে সমর্থনের কথা বলেছিলাম। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের অগ্রগতি হয়েছে তৃণমূল-বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। নির্বাচনে তৃণমূল যদি দেদার বুথ দখল, ভোট লুট করতে না পারত, তাহলে আমাদের আরও অগ্রগতি ঘটতো।

সাংবাদিক সম্মেলনে সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, বিজেপি-র বেলুন ফুটো হয়ে গেছে। যদি দেদার ভোট লুট না করতে পারত, তাহলে তৃণমূলেরও হাল খারাপ হয়ে যেতো। প্রহসনের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। যদি দিতে পারতেন, তাহলে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট আরও বাড়তো। ত্রিপুরার আগরতলার নির্বাচনে বিজেপি যা করেছে, কলকাতায় তৃণমূলও তাই করেছে। তা সত্ত্বেও একশো শতাংশ ওয়ার্ডে জিততে পারেনি। বাংলার মাথা হেঁট করে দিয়েছে ভোট লুটের এই নির্বাচন।