৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮
কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থীর অভিজ্ঞতার কথা তাঁর বয়ানে -
এই পুর নির্বাচন ছিল স্বৈরাচারী দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই
দীপু দাস
কেন পড়ে গেল ভোট - প্রশ্নে নিরুত্তর পুলিশ।
আমি এই পুর নির্বাচনে কলকাতা কর্পোরেশনের কসবার ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ছিলাম। প্রচারে বেরিয়ে ওয়ার্ডের মানুষের কাছে বিপুল সাড়া পেয়েছি। কেন্দ্রে মোদি এবং রাজ্যে তৃণমূলের শাসনে তাঁদের জীবন যন্ত্রণার কথা, তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তাঁরা তুলে ধরেছেন আমাদের কাছে। প্রতিকার চেয়েছেন। আমাদের বিকল্পের বার্তায় মানুষ আশ্বাস দিয়েছিলেন আমার পাশে থাকার। কিন্তু ভোটের দিন তৃণমূল কংগ্রেসের অর্থবল, পেশী শক্তি ও পুলিশ প্রশাসনের সম্পূর্ণ অসহযোগিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক অসম লড়াইয়ে আমাদের হার মানতে বাধ্য করানো হয়। আমাদের লড়াকু কমরেডরা সমানে লড়াই করলেও আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে প্রতিরোধ জারি রাখতে পারেন নি। তাই ভোটাররাও পৌঁছতে পারেননি ভোট কেন্দ্রে। প্রয়োগ করতে পারেননি ভোটাধিকার।
একটু নিকট অতীতের কথা এ প্রসঙ্গে তুলে ধরলে এবারের প্রেক্ষাপট বুঝতে সুবিধা হবে। বিগত কর্পোরেশন নির্বাচনে (২০১৫ সালে) তিক্ত এবং নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের। ভোটের আগের দিন থেকেই হুমকি, শারীরিক আক্রমণ, ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়া শুরু হয়েছিল। ভোটের দিন বহু ভোটারকে ভোট দিতে না দিয়ে জোর করে হারানো হয়েছিল বাম প্রার্থীকে।
এবারেও তৃণমূল কংগ্রেস ভোটে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপরে আস্থা না রেখে গাজোয়ারি, ছাপ্পা ভোট ও বুথ দখলের পথ বেছে নেয়। একাজে এলাকার তৃণমূল কর্মীদের সাথে যোগ দিয়েছিল বহিরাগত দুষ্কৃতীরা। সকালবেলায় ভোট শুরু হবার আগেই ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা সিপিআই(এম)’র দু’জন পোলিং এজেন্টের কাছ থেকে কাগজপত্রের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে তাদের প্রকাশ্যে মারধর করে বাড়ি চলে যেতে বাধ্য করে।
এরপর একাধিক জায়গায় বুথে আমাদের এবং বিরোধী পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের সাহায্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে বিরোধী এজেন্ট শূন্য বুথে অবাধে ছাপ্পা মারা নিশ্চিত করা যায়। ভোট শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইস্ট এন্ড পার্ক স্পোর্টিং ক্লাবের একটি বুথে সিপিআই(এম)’র তরুণ পোলিং এজেন্টকে হুমকি দিতে শুরু করে তৃণমূলীরা। ছাপ্পা ভোট দিতে ওই কমরেড বাধা দেওয়ায় বেলা বাড়তেই তাঁর বাড়িতে গিয়ে হামলা চালানো হয়। তাঁর মা ও দিদাকে শাসানো হয়। হুমকি দিয়ে বলা হয় যে, বাড়ির ছেলে সিপিআই(এম)’র পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করলে তাঁকে খুন করা হবে। অন্যদিকে তাঁর পরিবার আক্রান্ত হবে এই হুমকিসহ গালিগালাজ এবং প্রবল মানসিক চাপ দিয়ে দুষ্কৃতীরা সেই তরুণ ছাত্র কর্মীকে বুথ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এলাকার বিভিন্ন বুথেই চলতে থাকে সিপিআই(এম)’র পোলিং এজেন্টদের ওপর নানা নির্যাতন। প্রিসাইডিং অফিসার, পুলিশ প্রশাসন সহ ভোট প্রশাসক কারও কাছেই অভিযোগ জানিয়ে কোনো ফল হয়নি।
এই পৌরসভার ভোট যে কার্যত প্রহসন তার অন্যতম প্রমাণ ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটের দিন সকালবেলায় সিপিআই(এম)’র প্রার্থী, অর্থাৎ আমার পরিবারের কয়েকজন সদস্যের ভোট জোর করে দিয়ে দেয় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা। বুথে সিপিআই(এম)এর প্রবীণ পোলিং এজেন্ট এই ছাপ্পা ভোটের বিরোধিতা করায় তাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয়। বলা দরকার, প্রিসাইডিং অফিসারসহ অন্যান্য ভোট কর্মীরা এ সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।
সকাল থেকে শুরু হওয়া এই নৈরাজ্য ছিল সারাদিনের সাধারণ ছবি। কসবা বালিকা বিদ্যালয়, দোলনা ক্রেশ, কল্যাণ সংঘ, অগ্রণী স্কুল, ইস্ট এন্ড পার্ক ক্লাব, বিজয়নগর প্রাথমিক স্কুল, শ্রী প্রভাত বিদ্যালয়, ই এম অ্যাকাডেমির মতো বিভিন্ন পোলিং স্টেশনে ব্যাপক ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্য আমাদের কমরেডরা দুষ্কৃতীদের সাথে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। শেষবেলায় বাম প্রার্থীর ব্যাগ পর্যন্ত ছিনতাই করবার চেষ্টা করে শাসকদলের এক দুষ্কৃতী।
কোনো সন্দেহ নেই যে, এক স্বৈরাচারী, দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করতে নেমেছিলাম। প্রতিমুহূর্তে নানারকম প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে আমরা ভোট যুদ্ধে শামিল হয়েছি। এই শক্তিকে পরাজিত করতে গেলে আরও মজবুত সাংগঠনিক শক্তি চাই। এই অসম লড়াইয়ে যাঁরা শেষ পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছেন সেই সমস্ত কমরেডকে লাল সেলাম।