৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮
কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থীর অভিজ্ঞতার কথা তাঁর বয়ানে -
মানুষের ভোটে নয়, তৃণমূলের এই জয় বুথ দখলের জয়
ফৈয়াজ আহমেদ খান
ভোট লুটের প্রতিবাদে খিদিরপুর মোড়ে বামফ্রন্টের অবস্থান।
যে ওয়ার্ড থেকে আমি বামফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি, সেই ৭৫ নম্বরে তৃণমূল আগে থেকেই বুঝেছিল ওরা ভোট পাবে না। আর এই ওয়ার্ডের কোনো ক্যান্ডিডেটও পায়নি ওরা। ওরা প্রার্থী করেছে ওয়ার্ডের বাইরের লোককে। মানুষের পাশে সারা বছর থেকে পুর পরিষেবা সহ বিভিন্ন প্রয়োজনে যে কাজগুলো আমি করেছিলাম তার ভিত্তিতে মানুষ আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আমাকে তাঁরা ভোট দেবেন। কিন্তু তাঁরা অনেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেন না তৃণমূলের ভোট সন্ত্রাসের জেরে।
দিনের শুরুতে শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছিল। আমি বিভিন্ন বুথে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় মানুষ আমাকে বলতে শুরু করেছিলেন, ‘মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য রেডি থাকুন, আজকেই আপনার জয় আমরা ঘোষণা করে দিচ্ছি!’ বেলা একটা অবধি ঠিকঠাক ভোট হয়েছে। এরপরই বহিরাগত সমাজবিরোধীরা এই ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ে। আমি তখন মেরিন হাউসে ছিলাম। সেখানে ছ’টা বুথ। এমনিতে মেরিন হাউস সংরক্ষিত এলাকা। বাইরে লোহার গেট। আমি সেখানে ঢোকার পর মুহূর্তে প্রায় দেড়শ’ সমাজবিরোধী ‘মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে আসে। পুলিশ তাদের গেট খুলে দেয়। তারা ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাদের কারও হাতেই কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না, ছিল অস্ত্র।
এরা ঢুকেই প্রথমে সিপিআই(এম)’র এক পোলিং এজেন্টকে মারতে শুরু করে। ওদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। আমি ওই পোলিং এজেন্টকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে ওরা আমার ওপর চড়াও হয়। অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকে। ওরা আমাকে দেখিয়ে বলছিল, ‘একে মেরে দে’। ওরা মারতে মারতে টানতে টানতে আমাকে বুথের বাইরে মেরিন হাউসের সামনে রাস্তায় নিয়ে আসে। মাটিতে ফেলে দেয়। পড়ে থাকা অবস্থায় ওরা আমার বুকে, পায়ে, হাতে, পেটে, মুখে, রড এবং লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। আমার গাড়ির ড্রাইভার এবং আশেপাশের দু-একজন কমরেড ওদের হাতে মার খেতে খেতেও কোনওক্রমে আমাকে আহত অবস্থায় গাড়িতে তুলে দেয়। ওই দুষ্কৃতীরা তখন গাড়ি ভাঙচুর করতে শুরু করে। গাড়ির কাঁচ ভাঙতে থাকে। আমার গাড়ির চালক ওই পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কোনক্রমে আমায় ওখান থেকে বার করে নিয়ে আসে। ওরা আমাকে রড থেকে রিভালবারের বাঁট সবকিছু দিয়েই মেরেছে। আহত অবস্থায় আমাকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি হাটু, বুক সহ বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছি। আমার নাক মেরে ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপর পুলিশের সামনেই আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ওরা একের পর এক বুথ দখল করতে শুরু করে। আমাদের সমস্ত এজেন্টদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনে ওই সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। আমাদের পুরুষ এজেন্টদের বেধড়ক মারধর করে আর মহিলা এবং বিশেষত ছাত্রী কমরেডদের যারা বুথে এজেন্ট ছিলেন তাদের ধর্ষণ করার হুমকি দেয়। তাদের হাত ধরে টেনে বার করে দেওয়া হয় বুথ থেকে। আমার ইলেকশন এজেন্ট আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তাফাকেও মারা হয়েছে। এই দুষ্কৃতীরা শুধু প্রার্থী বা পোলিং এজেন্টদের মেরেছে তা নয়, পকেটমারিও করেছে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বের করে নিয়েছে।
তবে এই দুষ্কৃতীরা প্রতিরোধের সম্মুখীনও হয়েছে। সাধারণ মানুষের বাধা পেয়ে সেখান থেকে পিছু হটে পালিয়ে গেছে ঘটেছে এমন ঘটনাও। এই ওয়ার্ডেরই একটি পোলিং স্টেশন হেস্টিংস। সেখানে মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরিত ঘাসফুলের ভোট লুটেরারা ভোট লুট করতে এলে রাজনীতির সঙ্গে সংযোগহীন মহিলা পুরুষ যারা ওই এলাকার বাসিন্দা, তাঁরা এককাট্টা হয়ে বলেছেন, এখানে ভোট লুট চলবে না। আমরা আমাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো ভোট দেব। তাই ৬ নম্বর এবং ৯ নম্বর এই দুটি বুথে ওরা ইভিএম দখল করতে পারেনি সমবেত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ওই দুটি বুথে আমার দলের প্রাপ্ত ভোটের মার্জিন খুব ভালো। ৬ নম্বর বুথে ১৪৫ এবং ৯ নম্বর বুথের ব্যবধান ১১২ ভোট।
তবে শেষ অবধি কমরেডরা জান কবুল লড়াই করেছেন। কোনো বুথে এজেন্ট ছিল না এমন হয় নি, প্রতিটি বুথেই সাধ্যমতো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়েছেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে আমাদের এলাকার এসএফআই ইউনিটের সম্পাদিকা রুবিনা মুস্তাফার ভূমিকার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। একটি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী রুবিনা একটি বুথে সিপিআই(এম)’র পোলিং এজেন্ট ছিল। ওর দিকে বন্দুক তাক করে দুষ্কৃতীরা ওকে হুমকি দেয় ‘রেপ’ করে দেওয়ার। কেন ওকে এরকম বলল তৃণমূলীরা? ওর অপরাধ হলো, বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকে ভোট লুটের বিরুদ্ধে বারবার আপত্তি করা সত্ত্বেও যখন তিনি অবাধে ছাপ্পা বন্ধ করতে কোনও পদক্ষেপ করেন নি তখন রুবিনা প্রতিবাদে এই ভোটচুরি রুখতে ইভিএমের তার ছিঁড়ে দেয়।
খিদিরপুরে ভোট লুটের বিরুদ্ধে অবরোধে পুলিশের বাধা।
খিদিরপুরের ইতিহাসে এই রকম ভোট হয়নি। আমি শুনেছি, এই ওয়ার্ডে অধিকাংশ বুথের বাইরে কলকাতা পুলিশের বাহিনী মোতায়েন রেখে ভেতরে তৃণ-গুন্ডারা লাগাতার ইভিএম এর বোতাম টিপে গেছে। এই জয় বুথ দখলের জয়। মানুষের ভোটে নয়। এলাকায় এই অভূতপূর্ব ঘটনায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাঁরা বলছেন, এরচেয়ে ওরা বলে দিত ভোট করার কোনো দরকার ছিল না।
তৃণমূলের এই ওয়ার্ডের নেতা ও কর্মীরা বাইরের থেকে প্রার্থী আনা নিয়ে এমনিতেই বিরক্ত ছিল দলের ওপর। আর মমতা ব্যানার্জির ভাইপোর বাহিনী যারা এখানে ভোট লুট করতে এসেছিল তারাও ওয়ার্ডের তৃণমূলীদের উপর ভরসা রাখে নি। এলাকার বহু তৃণমূলী ১৯ তারিখ থেকেই ফোন করছে আমাকে। ওরা বলছে, দাদা আপনার সঙ্গে যা হয়েছে তা খুব খারাপ হয়েছে। আমরা প্রকাশ্যে এটা বলতে পারছিনা। এখানে যে পরিবেশ কোনদিন ছিল না সেটা শুরু হয়ে গেল এবার।
পুলিশের ভূমিকাটা এখানে সবথেকে বেশি ন্যক্কারজনক। ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ দুষ্কৃতীদের এখানে আসতে দিল কি করে? আমি ডিসি-পোর্ট এবং যিনি অবজারভার তাদের প্রত্যেককেই ফোন করে ঘটনার কথা তৎক্ষণাৎ জানিয়েছি। কিন্তু তারা ‘দেখছি’ বলে ফোন রেখে দিয়েছেন। কিছুই করেননি। হেস্টিংস ওয়াটগঞ্জ এবং সাউথপোর্ট থানার পুলিশ বাহিনী এই ভোট লুটে সম্পূর্ণ সহায়তা করেছে।
মেটিয়াবুরুজে পুলিশ নয় ভোটের লাইন নিয়ন্ত্রণ করছে তৃণমূলীরা।
আমি শুনেছি কোথাও কোথাও পোলিং অফিসাররাই ছাপ্পা ভোট দিয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, অবাধ এবং নিরপেক্ষ ভোট প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে ইলেকশন কমিশনকে। কমিশন ব্যর্থ। এমনকি যে সিসিটিভিগুলি বুথের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছিল সেগুলো কাগজে মুড়ে অকেজো করে দেওয়া হয়েছিল। কমিশনের তরফে কোনো নজরদারি ছিল না। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, কিছু ক্ষেত্রে দুষ্কৃতী বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের এই ‘উৎসবে’ অংশগ্রহণ করেছে। মানুষ এসব দেখেছেন। তাঁরা বিরক্ত। সুস্থ হয়ে উঠে আমি ভোটের নামে এই প্রহসনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করব।