৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮
কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট লুটের প্রতিবাদে ধিক্কার জানিয়ে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ মিছিল বিক্ষোভ
নির্বাচন কমিশন দপ্তরের সামনে বামফ্রন্টের প্রতিবাদ বিক্ষোভ-মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের যথেচ্ছ ভোটলুট, ভোট দিতে বাধা দান, পোলিং এজেন্ট এবং প্রার্থীর উপর হামলার মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার প্রতিবাদে ২০ এবং ২১ ডিসেম্বর কলকাতা সহ রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শাসকদল যেভাবে প্রতিটি নির্বাচনকেই সন্ত্রাস, রিগিং ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কার্যত ভোট প্রহসন ও ভোটলুটের উৎসবে পরিণত করেছে, এবারের কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনেও তারই নজির দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশ - সবাই নির্বাক ভূমিকা নিয়ে পরোক্ষে শাসকদলকেই সাহায্য করেছে। এই নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে নিধন করা হয়েছে। তারই প্রতিবাদে জেলায় জেলায় প্রতিবাদ মিছিল বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দপ্তরের সামনে টানা চার ঘণ্টা অবস্থান বিক্ষোভে শামিল ছিলেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। বামফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ ২০ডিসেম্বর রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডগুলিতে পুনর্নির্বাচন এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে স্মারকলিপি দেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার বামফ্রন্টের দাবি খারিজ করে দেন।
বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান বিমান বসু স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে ভোটগ্রহণের দিনে ব্যাপক হামলা, পোলিং এজেন্টদের হুমকি ও মারধর, বাইক বাহিনী ও বহিরাগত বাহিনী দিয়ে ভোট লুট, বুথের সিসিটিভি অকেজো করে রাখা ইত্যাদি বিস্তারিত অভিযোগ জানিয়ে বলা হয়েছে, ভোটগণনা চলাকালীন এইসব অভিযোগ কমিশনের কাছে পাঠানো সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, উলটে পুনর্নির্বাচন হবে না বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। জনগণের বদলে শাসকদলের সেবকের ঘৃণ্য ভূমিকা নিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
২০ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের দপ্তরের সামনে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলে।
এই বিক্ষোভ সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক কল্লোল মজুমদার, সিপিআই(এম) নেতা তরুণ ব্যানার্জি, রূপা বাগচী, আরএসপি নেতা রাজীব ব্যানার্জি, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা জীবন সাহা, এমএফবি নেতা আশিস চক্রবর্তী প্রমুখ। এছাড়া বামফ্রন্ট প্রার্থী রত্না রায় মজুমদার, চয়ন ভট্টাচার্য, দীপু দাস, উপনীতা পাণ্ডে, অন্বেষা দাস, মহম্মদ আজম, স্বপন ঘোষ, দীপা চক্রবর্তী, প্রদ্যোৎ নাথ প্রমুখ তাঁদের বক্তব্যে নিজেদের অভিজ্ঞতায় কীভাবে ভোট লুট হয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছেন।
কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটলুট করে নির্বাচনকে প্রহসনে তৈরি করার প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় মিছিল, সভা, পথ অবরোধ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদে শামিল হন সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলের কর্মীরা।
উত্তর ২৪পরগনা জেলায় সিপিআই(এম)’র বিভিন্ন এরিয়া কমিটির উদ্যোগে মিছিল, সভা এবং পথ অবরোধ হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর বারাসত পূর্ব-দক্ষিণ এরিয়া কমিটির উদ্যোগে বারাসতের হাটখোলা থেকে মিছিল শুরু হয়ে আনন্দময়ী মোড় পর্যন্ত যায়। মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় রাস্তা অবরোধ করে মধ্যমগ্রাম ১ ও ২ এরিয়া কমিটি। বনগাঁ মহকুমার গোপালনগর বাজার, গাইঘাটা, চাঁদপাড়া, বনগাঁ শহর ও হেলেঞ্চায় মিছিল ও রাস্তা অবরোধ হয়েছে। সন্দেশখালি বাজার ও কালীনগর বাজারে মিছিল ও সভা হয়। বসিরহাটে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় সিপিআই(এম) কর্মীরা। অবরোধের আগে বৌবাজার সংলগ্ন এলাকা থেকে পুরাতন বাজার, জামরুলতলা, বেলতলা টাউনহল হয়ে রেজিস্ট্রি মোড়ে মিছিল শেষ হয়।
সন্দেশখালি ১নং এরিয়া কমিটির ডাকে মিছিল কালীনগর পার্টি অফিস থেকে শুরু হয়ে কালীনগর বাজার পরিক্রমা করে বেতনী নদীর খেয়াঘাটে শেষ হয়। দেগঙ্গার মিছিল কার্তিকপুর থেকে শুরু হয়ে টাকি রোডের বিশ্বনাথপুরে শেষ হয়। কাঁচড়াপাড়ায় ও নৈহাটি পার্টি অফিস থেকে মিছিল বের হয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিক্রমা করে।
বারাকপুর গ্রামীণ এরিয়া কমিটির উদ্যোগে এবং দমদমের নাগেরবাজার, বাগুইআটি, নিউবারাকপুর এবং খড়দহ-রহড়া এলাকায় এবং পানিহাটি-২ এরিয়া কমিটির উদ্যোগেও মিছিল হয়েছে।
হাওড়া জেলা বামফ্রন্টের ডাকে ২০ ডিসেম্বর জেলার গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন প্রান্তরে মিছিল ও বিক্ষোভসভা হয়েছে। শ্যামপুর গাদিয়াড়া মোড়, বাগনানের নুন্টিয়া, বাইনান, লাইব্রেরি মোড়, আমতার বেতাই, উদং, ফতেপুর, উলুবেড়িয়া শহর, বাউড়িয়ার ফোর্ট গ্লস্টার মিলের সামনে, রানিহাটি আমতা মোড়ে, ডোমজুড় থানার সামনে, ডোমজুড় শলপে, বেলুড় ৫৬মোড়, লিলুয়া তেলকল মোড়, সালকিয়া, বেলগাছিয়া, কদমতলা, শানপুর, রামরাজাতলা, বেতড়, বি গার্ডেন দানেশ শেখ লেন, শিবপুর সন্ধ্যাবাজার, ইত্যাদি জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
ভোট লুটের প্রতিবাদে মিছিল তমলুকে।
এদিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ৩২টি স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা হয়েছে। মেদিনীপুর শহরের বটতলা মহুয়াতে প্রতিবাদ সভা হয়েছে। এছাড়া খড়্গপুর, ইন্দা, খরিদা, ঘাটাল, দাসপুর, কলোড়া, সুলতানপুর, গোপীগঞ্জ, মোহনপুর, দাঁতন, ধনেশ্বরপুর, বেলদা, নারায়ণগড়, কেশিয়াড়ি, হাতিগেরিয়া, মাদপুর, রাধামোহনপুর, ডেবরা, বালিচক, জলচক, পিংলা, সবং, মোহাড়, তেমাথানি প্রভৃতি স্থানে ধিক্কার মিছিল ও প্রতিবাদসভা হয়।
হুগলি জেলায় বালির মোড়, কোন্নগর সহ বিভিন্ন এলাকায় ধিক্কার মিছিল ও সভা হয়েছে।
কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসকদলের ব্যাপক ভোটলুটের প্রতিবাদে শিলিগুড়ি শহরে বিশাল মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে।
আগরতলায় প্রতিবাদ মিছিল
কলকাতায় শাসকদলের ব্যাপক ভোটলুট ও গণতন্ত্র নিধনের প্রতিবাদে দৃপ্ত মিছিল সংগঠিত হয়েছে আগরতলা শহরে। ২০ ডিসেম্বর কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করা এবং মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচনকে ভোট লুটের উৎসবে পরিণত করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এই মিছিল সংগঠিত হয়। এদিন সিপিআই(এম) পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা কমিটির ডাকে মেলারমাঠ থেকে ওরিয়েন্ট চৌমুহনি পর্যন্ত রাজপথ স্পন্দিত করে মিছিল হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ত্রিপুরায় সদ্য সমাপ্ত আগরতলা পৌরনিগম সহ পৌর ও নগর সংস্থার নির্বাচনে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের মদতে শাসক বিজেপি’র নজিরবিহীন ভোট লুট ও গণতন্ত্র নিধনের অভিজ্ঞতা রয়েছে ত্রিপুরাবাসীর সামনে। ঠিক একই কায়দায় সন্ত্রাস ও ভোট লুটের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস তাদের কদর্য চেহারা প্রকট করেছে। ত্রিপুরার শাসক বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল যে অনৈতিকভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে একইভাবে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে হিংসা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে, তার বিরুদ্ধে মিছিলে প্রতিবাদ ক্ষোভ উচ্চারিত হয়েছে। মিছিল থেকে সমস্বরে আওয়াজ উঠেছে ত্রিপুরার বিজেপি’র কায়দায় কলকাতায় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের মদতে ভোটলুণ্ঠনকারী তৃণমূলীদের শাস্তি চাই। পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র হত্যা করা হচ্ছে কেন, মমতা ব্যানার্জি জবাব দাও।
মেলারমাঠে ভানু ঘোষ স্মৃতি ভবন থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি প্যারাডাইস চৌমুহনি, পোস্ট অফিস চৌমুহনি, কামান চৌমুহনি হয়ে জ্যাকসন গেট দিয়ে ওরিয়েন্ট চৌমুহনিতে গিয়ে শেষ হয়। আগরতলা শহর ও শহরতলি ছাড়াও পশ্চিম জেলার বিভিন্ন এলাকার অগণিত মানুষ লালপতাকা, ফেস্টুন নিয়ে মিছিলে অংশ নেন।
মিছিল শেষে এক পথসভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) জেলা কমিটির সম্পাদক রতন দাস, রাজ্য কমিটির সদস্য পবিত্র কর, শঙ্করপ্রসাদ দত্ত। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রমা দাস সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন।
হাইকোর্টে মামলা
১৯ ডিসেম্বর কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে হিংসা এবং ভোটলুট করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার প্রতিবাদে ২২ ডিসেম্বর সিট গঠনের আবেদন জানিয়ে মামলা দায়ের করেছেন সিপিআই(এম) নেতা এবং ৭৫নং ওয়ার্ডে বামফ্রন্ট প্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদ খান। তিনি তাঁর আবেদনে বলেছেন, সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তাতে সিট গঠন করে তদন্ত করতে হবে।
এদিন কংগ্রেস দলের তরফে হাইকোর্টে কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসকদলের হিংসা এবং ভোটলুটের বিরোধিতা করে পৃথক একটি মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে হিংসা এবং ভোটলুট করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ঘটনায় নির্বাচনে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী দেবলীনা সরকার। আবেদনকারী নিজেই কর্পোরেশন নির্বাচনে ২নং ওয়ার্ডে সিপিআই(এম) প্রার্থী ছিলেন।
প্রসঙ্গত, কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচন অবাধ হয়নি।
দেবলীনা সরকার তাঁর আবেদনে বলেছেন, আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বুথে বুথে সিসিটিভি কাজ করেনি। বহু জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরার ওপর কাগজ লাগিয়ে তা অকেজো করে দেওয়া হয়। তিনি জানিয়েছেন, ভোট চলাকালীন বহু জায়গায় বোমা ফেলা হয়েছে। এই বোমার আঘাতে জখম হয়েছেন মানুষ। কারা বোমা ফেলে ভোট প্রক্রিয়ায় হিংসা ছড়িয়েছে তা কোনো নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে তার তদন্ত করা প্রয়োজন। ২০ ডিসেম্বর মামলাটি গ্রহণ করে আদালত। ২৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিসন বেঞ্চে মামলাটি শুনানির দিন ধার্য হয়েছে।
বিজেপি’র তরফেও এই নির্বাচন বাতিল করার দাবিতে আরেকটি মামলা রুজু করা হয়েছে।