৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮
তৃণমূলের সন্ত্রাস-হুমকি উপেক্ষা করেই আরামবাগ মেতেছিল সম্মেলন-উৎসবে
প্রায় কুড়ি বছর পর আরামবাগ শহরে আবার পার্টির হুগলি জেলা সম্মেলন। সেই রবীন্দ্র ভবনেই। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে লালপতাকা-ফেস্টুন আর তোরণে, বলা যায় পুরো আরামবাগ শহরকে প্রায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্মেলন উৎসবে সেজে ওঠা নবরূপের আরামবাগ শহরের রঙ হয়ে উঠেছিল প্রকৃত অথেই লাল। ১৯-২১ ডিসেম্বর ২৪তম সম্মেলনের তিনদিন শহরের নামকরণ করা হয় কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরী নগর।
কুড়ি বছর আগে ২০০২ সালে সেবার ছিল পার্টির হুগলি জেলার ১৮ তম সম্মেলন। তবে আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণই ভিন্ন। ২০১১ সালের মে মাসে রাজ্যে পালাবদলের পর আরামবাগ থানা এলাকায় শুরু হয় তৃণমূলের লাগামছাড়া সন্ত্রাস। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে সেই সন্ত্রাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেনঃ “ গত দশ বছরে ঘরছাড়া হয়েছে কয়েক শত মানুষ। মোট মিথ্যা মামলা হয়েছিল ২৯২টি। এই মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০০। শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭৪ জন। মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন পার্টি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর ও জেলা কমিটির সদস্যসহ ৭৫ জন। এছাড়া বাড়িঘর ভাঙা, আগুন লাগানো, বর্গাদার উচ্ছেদ ,পাট্টা জমি দখল হয়েছে। আরামবাগ শহরে পার্টির মূল কার্যালয়টি বারবার আক্রমণ করেও বন্ধ করে দিতে পারেনি। কিন্তু বাকি প্রায় সব শাখা দপ্তরই জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে বা দখল করে নিয়েছে।”
তৃণমূলের হুমকি-সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করেই আরামবাগে পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মেলন সফল করতে পথে নামে। এই পরিস্থিতিতে আরামবাগের মানুষের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এই সম্মেলন সফল করা কখনই সম্ভব হতো না।পার্টির আরামবাগ ১ এবং আরামবাগ ২ এরিয়া কমিটির পার্টি সদস্য-কর্মীরা এই সম্মেলনের বার্তাকে পৌঁছে দিতে এলাকার প্রতিটা গ্রামে প্রচার সংঘটিত করেছে। রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে পার্টির আরামবাগ ২ এরিয়া কমিটির প্রতিনিধি আবদুল রউফ জানানঃ “এলাকার ৮৭ টা গ্রামের মধ্যে ৪৩টা গ্রামে সম্মেলনের নিবিড় প্রচার হয়েছে, বাকি গ্রামগুলিতে বিচ্ছিন্নভাবে। মন্দেশ্বরী নদীর পাড়ে হরিণখোলার কেষ্টপুর গ্রামে যেখানে বহুবছর পরে পার্টিকর্মীরা এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে যেতে পারল। ১০ হাজারের কাছাকাছি পরিবারের কাছে যাওয়া হয়েছে। মাত্র চারটি পরিবার অর্থ সাহায্য করেনি। এই তহবিল সংগ্রহে আড়াই লক্ষ টাকার বেশি সংগৃহীত হয়েছে। এমনকী বহু তৃণমূলী সমর্থক পরিবারও অর্থ দিয়েছে।”
শুধু আরামবাগ শহরই নয়, সারা জেলায় লালপতাকা, দাবি সংবলিত ফেস্টুন এবং তোরণে সেজে উঠেছিল। বাস্তবিকই,একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো রাজনৈতিক দলের এধরনের রুচিশীল প্রচার নিকট-অতীতে হুগলি জেলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেননি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ডানকুনি মোড় থেকে আরামবাগ শহর পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৬০ কিলোমিটার রাস্তার দু’ধারে লাল পতাকা লাগানো হয়েছে, আর নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর তৈরি করা হয়েছে বড়ো বড়ো তোরণ। তোরণগুলিতে প্রয়াত নেতৃবৃন্দকে স্মরণের সাথেই বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সম্প্রতি অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হওয়া আলুচাষে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি।
সম্মেলন উপলক্ষে আরামবাগ শহরের প্রাণকেন্দ্র নেতাজি স্কোয়ারে ১৮-২০ ডিসেম্বর তিন দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। গণনাট্য সংঘের হুগলি জেলা কেন্দ্রীয় দল ও তারকেশ্বর গণ-মঞ্চ শাখা, রাজহাটি বৈতালিক শাখা, কোন্নগর প্রাভদা শাখা, আরামবাগ অয়ন শাখা, মশাট সৃষ্টি শাখা, ঠাকুরানিচক দুর্বার শাখা, চুঁচুড়া অনির্বাণ শাখার শিল্পীরা এবং স্থানীয় শিল্পীরা সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক পরিবেশন করেন। এছাড়াও জনবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীরা কুসংস্কারবিরোধী যুক্তিবাদী অনুষ্ঠান, বৈদ্যনাথ মুখার্জি বাউল, সম্পূর্ণা দাস ও কাবেরী সিং সঙ্গীত, সরোজ রায় হরবোলা এবং ‘কাইচি’ সংস্থার শিল্পীবৃন্দ ছৌনাচ, ওডিশি নৃত্য, ভাদু গান, কাঠি নাচ, টুসু গান, রণপা নৃত্য প্রভৃতি পরিবেশন করেন।
৬০ জনের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিতে গঠিত
সিপিআই(এম) হুগলি জেলা ২৪তম সম্মেলন থেকে ৬০ জনের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চে অনুষ্ঠিত নবনির্বাচিত জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে দেবব্রত ঘোষ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। জেলা সম্পাদকমণ্ডলী ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের পর গঠিত হবে। ওই বৈঠকে ঠিক হয়েছে, বিদায়ী সম্পাদকমণ্ডলীর যাঁরা নতুন কমিটিতে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা নতুন সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালাবেন।নবনির্বাচিত জেলা কমিটিতে ২১ জন নতুন। জেলা কমিটিতে ৪ জন বিশেষ আমন্ত্রিত রয়েছেন। এঁরা হলেন - মিতালী কুমার, পরিতোষ ঘোষ, মলয় সরকার এবং মোজাম্মেল হোসেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলনের জন্য ১৬ জন প্রতিনিধি এবং ৩ জন বিকল্প প্রতিনিধি সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়াও জেলা সম্মেলনে উপস্থিত গণফ্রন্টের ৩ রাজ্য নেতা রাজ্য সম্মেলনের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলনে উপস্থিত ৩৮৫ জন
পরিচিতি পত্র কমিটির পেশ করা রিপোর্ট অনুযায়ী জেলার ৪২টা এরিয়া কমিটি এবং ১১টা গণফ্রন্ট থেকে ৩৪৬ জন প্রতিনিধি এবং ৩৯ জন দর্শক সহ মোট ৩৮৫ জন সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে মহিলা ৫৪ জন। সর্বক্ষণের কর্মী ৬৫ জন। ওই রিপোর্ট থেকে জানা গেছে - শ্রমিক, গরিব কৃষক, মাঝারি কৃষক এবং খেতমজুর পরিবার থেকে এসেছেন ১৯১ জন। সবচেয়ে বয়স্ক প্রতিনিধি বিদায়ী জেলা কমিটির সদস্য ৮৬ বছরের রেবতীমোহন সাহা। সবচেয়ে নবীন প্রতিনিধি হরিপালের সৌমেন মুখার্জি। তাঁর বয়স ২৩ বছর। প্রতিনিধি ও দর্শকদের মধ্যে কারাজীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৪৬ জনের এবং ৯০ জন প্রতিনিধির আত্মগোপনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সর্বোচ্চ কারাবাসের অভিজ্ঞতা ধনিয়াখালির লালু হাঁসদার, নয় মাস। সর্বোচ্চ সময়ের আত্মগোপেনের অভিজ্ঞতা অভয় ঘোষের, ১০ বছর। প্রতিনিধি ও দর্শকদের মধ্যে ১১৯ জনের নামে মিথ্যা মামলা রয়েছে এবং ২৪৮ জনের আয় ১০ হাজার টাকার নিচে।
২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের ফেডারেশনগুলির ডাকে আগামী ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি ১২ দফা দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘট সফল করতে সর্বাঙ্গীণ সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছেঃ কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রাসী করপোরেটমুখী নীতির বিরুদ্ধে এই ধর্মঘটের বার্তাকে জেলার গ্রাম-শহরে সর্বত্র পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধর্মঘটের বার্তা পৌঁছে দিতে শাসকের সব ধরনের প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে প্রচারের সব পদ্ধতিগুলিকেই ব্যবহার করতে হবে।
প্রতিনিধি অধিবেশনের শুরুতে শহিদ স্মরণে ও শোকপ্রস্তাব পেশ করেন মিতালী কুমার, মোজাম্মেল হোসেন, পরিতোষ ঘোষ।
এছাড়াও সম্মেলনে ১০টি প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবগুলি হলোঃ
১) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিকল্পই একমাত্র পথ।
২) সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদের ধ্বজাধারী আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি’র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক মতাদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
৩) কেন্দ্রীয় সরকারের করপোরেট স্বার্থবাহী অর্থনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলো।
৪) অবিলম্বে কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম সুনিশ্চিতিকরণের আইনি বন্দোবস্ত করতে হবে।
৫) শ্রমআইন সংস্কারের নামে শ্রম কোডের দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলো।
৬) ধনতন্ত্রের গ্রাসে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনে শামিল হোন।
৭) রাজ্যে খুন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলুন।
৮) কর্মনাশা নীতির বিরুদ্ধে - কর্মসংস্থানের দাবিতে।
৯) মহিলাদের ওপর বেড়ে চলা আক্রমণের বিরুদ্ধে।
১০) বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীভাঙন প্রতিরোধ, নিকাশি ব্যবস্থা কার্যকরসহ নিম্ন দামোদর পরিকল্পনার সঠিক রূপায়ণ।
তিন প্রবীণ নেতাকে সংবর্ধনা
হুগলি জেলার তিন প্রবীণ নেতা মণীন্দ্র জানা, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এবং তুষার মিত্রকে সম্মেলনের প্রথমদিন সংবর্ধনা জানানো হয়। তুষার মিত্র ১৯৫০ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ১৯৫৩ সালে এবং মণীন্দ্র জানা ১৯৫৪ সালে অবিভক্ত পার্টিতে সদস্যপদ লাভ করেন। পরে পার্টি ভাগ হলে এঁরা সিপিআই(এম)-এ যোগ দেন। তুষার মিত্র অসুস্থ থাকার জন্য আসতে পারেননি। প্রসঙ্গত, মণীন্দ্র জানা আটবার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন।
পুস্তক ও স্মরণিকা প্রকাশ
সম্মেলনে ‘হুগলি জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ইতিবৃত্ত ১৯৩৪-১৯৭৭’ পুস্তক এবং স্মরণিকা প্রকাশ হয়। এই পুস্তকটির লেখক রূপচাঁদ পাল। পুস্তকটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। স্মরণিকা প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অমিয় পাত্র।
প্রতিবেদকঃ শংকর মুখার্জি
ছবিঃ অনন্ত সাঁতরা