E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮

দুটি সরকারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন তীব্র হবে

সুপ্রতীপ রায়


কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে তৃণমূলীদের ভোট লুট সত্ত্বেও বামফ্রন্ট প্রার্থীরা শত অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েও লড়াই ছাড়েন‍‌নি।
ভোট বাড়ার পাশাপাশি ভোটের শতাংশ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে বামপন্থীদের। এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে
আসার লক্ষণ স্পষ্ট। ৯২নং ওয়ার্ডের জয়ী প্রার্থী মধুছন্দা দেবের জয় সেই ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট করল।

কৃষির তিনটি কালা আইন বাতিল হয়েছে। আন্দোলনরত কৃষকরা দিল্লি সীমান্ত থেকে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। আন্দোলনের রাস্তাতেই যে নয়াউদারবাদী নীতিকে পরাস্ত করা যায় তা প্রমাণিত হয়েছে। নয়াউদারবাদী নীতি থেকে সরে আসতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করতে না পারলে সংকট আরও বাড়বে। দেশজোড়া দু’দিনের ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ধর্মঘট আসলে নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ। প্রতিদিন সংকট আরও বাড়ছে। মোদি ও মমতা সরকারের প্রতিটি নীতি যে জনবিরোধী তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আন্দোলনের পথেই মোদি-মমতার নীতি পরাস্ত হবে।

যে সত্য ঢাকা যায় না

বাতিল হওয়া তিন কৃষি আইনের ভিতরে কী ছিল যা এক বছরেরও বেশি সময় কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ভাঙতে পারল না। আসলে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে কৃষিকে সম্পূর্ণ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতেই এই তিন কৃষি আইন আনা হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশের রাস্তাকে মসৃণ করা এবং কৃষিক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বকে ঝেড়ে ফেলার লক্ষ্যেই তিন কৃষি আইন অতি দ্রুততার সঙ্গে আনা হয়েছিল।

মোদি সরকারে আসার পর কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে কৃ‍‌ষিক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হতে থাকে। ২০০৫-১৪ সালের মধ্যে গৌতম আদানি কৃষি-বাণিজ্যের কোম্পানি তৈরি করেছিল দুটো। কিন্তু তিনি মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম পাঁচ বছরেই (২০১৪-১৯) আরও ২৯টি কোম্পানি তৈরি করেন। এতেই বোঝা যায় মোদি বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্পোরেটদের সেবা করে চলেছেন।

কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার স্লোগান আর বাস্তব চিত্র

মোদির স্লোগান আগামী ৫ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র কী? ২০১৮-১৯ সালে কৃষকরা কৃষিকাজ থেকে দৈনিক উপার্জন করেছেন মাত্র ২৭ টাকা। এনএসও-র পক্ষ থেকে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর ’২১ সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৯ কোটি ৩১ লক্ষ পরিবার কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, এছাড়াও ৭ কোটি ৯৩ লক্ষ পরিবার অকৃষি কাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ গ্রামীণ জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি কৃষিকাজ থেকে ন্যূনতম আয় করতে পারেন না। কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলোর কাছে কৃষি এখন আর আয়ের প্রধান উৎস নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী, ৯৯ শতাংশ অকৃষি পরিবারের হাতে আছে এক হেক্টরেরও কম জমি। বেশিরভাগ কৃষকের কাজের ধরন অনিয়মিত। উপরের তথ্যগুলিই প্রমাণ করে কৃষকের আয় কমছে।

কৃষকদের সঙ্গে সীমাহীন প্রতারণা

২০১৮-১৯ সালে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) প্রতিটি কৃষকের কাছে পৌঁছাবে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পিএম-আশা প্রকল্প। ২০১৯-২০ সালে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১,৫০০ কোটি টাকা ও খরচ হয়েছিল মাত্র ৩২১ কোটি টাকা। মোদির আমলে অধিকাংশ ফসলের ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষকরা পাননি। কৃষির উৎপাদন খরচ সি ২+ ৫০ শতাংশ লভ্যাংশের সাম্মানিক যুক্ত এমএসপি নিশ্চিত করা হয়নি। গত চার বছরে বেসরকারি কোম্পানিগুলি শস্যের বিমা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লাভ করেছে। মনরেগা, গ্রামীণ মজুরি, কৃষি পেনশন, ঋণমুক্তি, শস্যহানির ক্ষতিপূরণ, সরকারি ফসলবিমা প্রভৃতি বিষয়ে কৃষকদের প্রতারিত করা হয়েছে। ভূমিহীন কৃষক, খেতমজুর, ভাগচাষির সংকট ক্রমবর্ধমান।

মোদি জমানায় অর্থনীতি বিপর্যস্ত

সরকারে আসার পর পরই মোদি ঘোষণা করেছিলেন - দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো হবে। বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির দুটি পদক্ষেপ ছিল - ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থভরা। দুটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত চরম সংকটের মুখে। কর্মহীনতা ক্রমবর্ধমান। কোভিড পরিস্থিতি এই অবস্থাকে আরও সংকটাপন্ন করেছে।

কর্মহীনতা নিয়ে নীরব কেন?

নতুন করে কাজ পাওয়া দূরে থাক, বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মচ্যুতি ঘটছে। কাজ হারানো ও মজুরি হ্রাস পাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। ২০২০’র ডিসেম্বরে প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারানোর পর আর তা ফিরে পান নি। কোভিডের আগে থেকেই দেশে কর্মহীনতা বাড়ছিল, অতিমারী তা আরও বৃদ্ধি করেছে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মহীনতা আগামী দিনে আরও ক্ষতি ডেকে আনবে। লক ডাউনের প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন রাজ্য থেকে নিজ রাজ্যে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার ৯৬৮। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৫ লক্ষ ১৫ হাজার ৩৬৩। ভারতীয় শ্রমবাজার থেকে মহিলারা ছিটকে যাচ্ছে। আইএলও-র সমীক্ষা অনুযায়ী মজুরির প্রশ্নে ভারতে লিঙ্গ বৈষম্য মারাত্মক। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লক ডাউন ঘোষণার পর গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসে মহিলাদের শ্রম-অংশীদারিত্ব ১৫.৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। বিজেপি আমলে মহিলা শ্রমিকের কাজ হারানোর পরিমাণ ক্রমশ বেড়েছে। ২০০০ সালে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৬ শতাংশেরও বেশি, ২০০৯ সালে তা নেমে আসে ২০.৩ শতাংশে। গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন বহু মহিলা শ্রমিক। মহিলা শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১৬.১ শতাংশ। ওই সময় কর্মচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১৫.৮ শতাংশ মহিলা শ্রমিক। কিন্তু পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ হারানোর পরিমাণ ছিল ১২.৬ শতাংশ।

ঋণের বোঝা বাড়ছে

ভারতীয় ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ডিভিএআরএ তাদের সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে - কোভিড অতিমারী শুরুর অনেক আগে থেকেই গ্রামীণ ভারতবর্ষে ঋণ সংকট দ্রুত বেড়ে হয়েছে ৮৪ শতাংশ ও শহর এলাকায় হয়েছে ৪২ শতাংশ। গার্হস্থ্য ঋণ ২০২০-২১ সালে জিডিপি’র হারে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৭.৩ শতাংশ, ২০১৯-২০-‍‌সালে এটি ছিল ৩২.৫ শতাংশ।

ভারতীয় শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ লকডাউনের সময় কোনো বেতন পাননি ও ৩১ শতাংশ লকডাউনের ৬ মাস পরেও কাজ পাননি। ফলে সংসার খরচ চালাবার জন্য তাঁরা আরও ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। কর্মহীন মানুষ চড়া সুদে মহাজনদের থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন।

ক্ষুধা আর অপুষ্টি নিত্যসঙ্গী

ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। ২০২১ সালে বিশ্বের ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১; ২০২০ সালে ভারত ছিল ৯৪-তে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে মায়ানমার আছে ৭১-এ, বাংলাদেশ ও নেপাল আছে ৭৬-এ, পাকিস্তান ৯২-এ।

অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুদের ভোগার পরিমাণও আমাদের দেশে বেশি। অপুষ্টিতে ভুগছে ৩৩ লাখেরও বেশি শিশু। আরটিআই-এ এক আবেদনের ভিত্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক। তথ্য জানার অধিকার আইনে সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর এক আবেদনের উত্তরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক জানিয়েছে, চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতে গুরুতর অপুষ্টির শিকার প্রায় ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৮০২টি শিশু, মাঝারি-তীব্র অপুষ্টিতে ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৪২০টি শিশু আক্রান্ত।

শিক্ষার হাল খারাপ

অতি সম্প্রতি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয় খুললেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি টানা বন্ধ। এরফলে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন ছাত্র-ছাত্রীরা। সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞানী জঁ দ্রেজ এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন। উক্ত সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, লকডাউন পর্বে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত পড়াশুনা করেছে, ৩৭ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনার বাইরে, ৫০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী কয়েকটি শব্দ একটানা পড়তে পারছে না। বিপুল অংশের ছাত্র-ছাত্রী লেখা ও পড়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামীণ ভারতের তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের ৪২ শতাংশ একটি শব্দও পড়তে পারছে না। শিক্ষার্থীদের নানা মানসিক ও আচরণগত সমস্যা বেড়েছে। বিদ্যালয় পুনরায় চালু হওয়ার পরও (নবম থেকে দ্বাদশ) বিদ্যালয়ে আসার অনাগ্রহ দেখা যাচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

কোভিড ভ্যাকসিন প্রদানে চরম ব্যর্থতা

মিথ্যা কথা বলায় মোদির দক্ষতা প্রশ্নাতীত। মোদির দাবি - সব ভারতবাসী নাকি বিনা পয়সাতে ভ্যাকসিন পেয়েছে। এটি একটি নির্জলা মিথ্যাকথা। বাস্তবে পৃথিবীর যে অল্প কয়েকটি দেশের মানুষের অনেককেই ব্যক্তিগত খরচে টিকা নিতে হয়েছে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল, তিন মাসের মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ সম্পন্ন করা হবে। সময় লেগেছে নয় মাস। মোদির ঘোষণা ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্কদের টিকা সম্পূর্ণ করা হবে। মোদির ঘোষণা আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ১২ বছর ও তার বেশি বয়স্কদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে ১৮ বছর ও তার বেশি বয়স্কদের কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভারতে জনসংখ্যার মোট যত শতাংশকে টিকার যোগ্য ধরা হয়েছে তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। আবার এই জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষের সম্পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে এবং একটা ডোজ পেয়েছেন মাত্র ৭৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভারতে টিকাকরণে অগ্রগতি থাকলে অনেক মৃত্যু ঠেকানো যেতো।

তৃণমূলের চালাকি ক্রমশ স্পষ্ট

মোদির মতোই তৃণমূল নেত্রী এরাজ্য পরিচালনা করছেন। মিথ্যাচার আর দ্বিচারিতা তৃণমূল নেত্রীর অঙ্গের ভূষণ। রাজ্য ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। অথচ বিজ্ঞাপন আর প্রচারে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে বাংলা পিছিয়ে পড়ছে।

বেকারত্বের পরিমাণ বাড়ছে এখানে

কর্মসংস্থান ও বেকারির পরিমাণ হ্রাস করার প্রশ্নে তৃণমূল সরকার উন্নাসিক। তৃণমূলের দাবি - ক্ষমতায় আসার দশ বছরের মধ্যে ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থান করে দিয়েছে। কিন্তু কোন্‌ কোন্‌ ক্ষেত্রে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয়েছে তার তালিকা রাজ্য সরকার দিতে পারবে না। রাজ্যে বর্তমানে বেকারির হার ৬.২ শতাংশ। কর্মসংস্থান কেন্দ্রগুলিতে কর্মপ্রার্থী হিসাবে নাম নথিভুক্ত করার সংখ্যা ৩০ লক্ষ ৫০ হাজার। নাম লেখাননি এমন সংখ্যাও প্রচুর। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান মিলে সাড়ে তিন লক্ষের উপর পদ ফাঁকা। তৃণমূলের আমলে স্থায়ী কাজের বদলে চুক্তি ও ঠিকা প্রথায় কিন্তু নিয়োগ হয়েছে। আগামী দিনে রাজ্যে নতুন কাজের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মা-মাটি-মানুষের টাকা নয়ছয়

বছরের পর বছর ক্লাবগু‍‌লিকে টাকা দিয়ে টাকা নয়ছয় করা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি রাজ্য সরকার তেইশটি দপ্তরের ৫০ জন পরামর্শদাতা নিয়োগের পদক্ষেপ নিতে চলেছে। পদমর্যাদায় এঁরা হবেন সচিব পর্যায়ের সমতুল। বেতন মর্যাদায় সিনিয়র পরামর্শদাতারা মাসে পাবেন দু’লক্ষ টাকা আর বাকিরা নিযুক্ত হবেন দেড় লক্ষ টাকায়। এই নিয়োগ হবে চুক্তিতে, নেওয়া হবে অবসরপ্রাপ্তদের। এরফলে ব্যয় বৃদ্ধি হবে। কি স্বার্থে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে এই নিয়োগ হবে?

মমতার কৃষকদের প্রতি মেকি দরদ

হঠাৎ মমতা ব্যানার্জি কৃষকদের প্রতি দরদি হয়ে উঠেছেন। কৃষক আন্দোলন জয়ী হওয়ার পর তিনি আন্দোলনরত কৃষকদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। যদিও কৃষক আন্দোলনে তৃণমূলের কোনো ভূমিকা ছিল না। তৃণমূলের আমলে রাজ্যে কৃষি সংকট বেড়েছে, কৃষকও সংকটে।

তৃণমূল সরকারের আমলে অভাবি বিক্রয় বেড়েছে। ফড়েদের দাপট বেড়েছে। বিপুল টাকা খরচ করে কৃষক মান্ডি গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত কৃষক মান্ডিতে ধান বিক্রয় করতে পারেন না। ফড়েদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।

২০১৯-২০ সালে ধান কেনা বিষয়ক রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা জারি হয়েছিল ২০১৯-র ১১ ডিসেম্বর। ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, ধান কেনা হবে ৫২ লক্ষ মেট্রিক টন। এ বছরে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্র ৪৯ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রাতেই কমে গেল ৩ লক্ষ মেট্রিক টন।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করার জন্য নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে কৃষকরা চূড়ান্ত হয়রানির মুখে পড়ছেন। রাত ১১টা থেকে কৃষকদের লাইন দিতে হয়েছে। পরের দিন সকালে সেন্ট্রাল পারচেজ সেন্টার খোলার পর নাম নথিভুক্ত করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সবাই নথিভুক্ত করতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে সার্ভার ডাউন বলে নাম নথিভুক্ত করা যায় নি। নথিভুক্ত করার সংখ্যাও ৫০ জনে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আবার কৃষকবন্ধু প্রকল্পের আওতার বাইরে তাদের নাম নথিভুক্ত করা হয়নি।

তৃণমূল সরকারে আসার পর প্রকৃত কৃষকদের বড়ো অংশ সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন না। চাষি অভাবি বিক্রয়ে বাধ্য হন। তৃণমূলী জমানায় ধান কেনার শিবির নিয়ন্ত্রণ করে রাইস মিলের মালিকরা।

মোদি-মমতা উভয়েই কর্পোরেট সেবায় ব্যস্ত

কর্পোরেটদের কাছে কৃষিপণ্যের বাজার তুলে দিতে চেয়েছিল মোদি সরকার। কৃষকদের আন্দোলন তা ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে মোদি সরকার কর্পোরেটদের স্বার্থে যে আইন তৈরি করেছিল, মমতা ব্যানার্জি ২০১৪ সালেই এই আইন লাগু করেছেন। ফলে মমতা ব্যানার্জির কৃষকদের প্রতি দরদ আসলে মেকি, ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ তা প্রমাণ হয়েছে। ২০১৪ সালের আইনকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চয়তা আইন চাই

এই মুহূর্তে সারা দেশের কৃষকরা চাইছেন ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা। মমতা ব্যানার্জি যদি কৃষকদের প্রতি আন্তরিক হতেন তাহলে নিজের রাজ্যে তা করে দেখাতে পারতেন।

এমএসপি প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক কোথায় দাঁড়িয়ে? পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ জেলাতেই নতুন ধান ওঠার পর থেকেই কৃষকরা ১২০০/১৩০০ টাকা কুইন্টালে ফড়েদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। উৎপাদন খরচ বিঘা পিছু প্রায় ১২০০ টাকা। উৎপাদন হয় বিঘা পিছু ৬-৮ কুইন্টাল। বিঘাপিছু লোকসান হয় প্রায় ৪,০০০ টাকা। অর্থাৎ একর পিছু লোকসান ১২,০০০ টাকা। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে ধানের এমএসপি হওয়া উচিত, ২,৭০০ টাকা।

আমাদের রাজ্যে ভাগচাষি, লিজচাষি, পাট্টাহীন গরিব চাষি সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এই অংশ সরকারি সহায়ক মূল্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আবার সবজি বা আলু, পেঁয়াজ প্রভৃতির জন্য সরকারি কোনো সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করা হয় না। ফলে কৃষকরা সংকটের মধ্যেই আছেন।

নয়াউদারবাদী নীতি পরাস্ত না হলে দেশে, আমাদের রাজ্যে সংকট বাড়বে। নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র হচ্ছে। নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক সহ অর্থনৈতিকভাবে আক্রান্ত মানুষের ঐক্য দৃঢ় হচ্ছে। নয়াউদারবাদের সমর্থক মোদি-মমতা। তাই উভয় সরকারের বিরুদ্ধেই আন্দোলনকে তীব্র করতে হবে।