৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮
দিগন্ত প্রসারিত পিতৃভূমির জন্যে
বনবাণী ভট্টাচার্য
কারোর পৌষ মাস হলে অন্যজনের তো সর্বনাশ। করোনার গ্রাসে এখনও পর্যন্ত ভারতে মানুষের প্রাণ গিয়েছে ৪ লক্ষ ৭৮ হাজার ৭ জনের। দেশে ১২ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আর সেই মহামারীর করাল কালেই মার্কিন বিলিওনেয়াররা বছরে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি রোজগার করেছেন অন্য বছরগুলির তুলনায়। ঠিকই, এত মানুষের মৃত্যু এবং এত মানুষের কর্মচ্যুতি একই সময়ে, সাধারণত হয় না। কিন্তু অনাহার-অপুষ্টি-অস্বাস্থ্য ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুমিছিল তো অতিমারীর আগের থেকেই ক্রমবর্ধমান - ক্রমবর্ধমান কর্মচ্যুতি এবং বেকারি এই বৈষম্য এবং আর্থ-সামাজিক সংকটের তীব্রতা মহামারীর পরিণাম বলে ঢ্যাঁড়া পেটানো যায়, কিন্তু ‘সহি বাত’ বলে প্রতিষ্ঠা পায় না। আসলে এই তীব্র আর্থিক সামাজিক সংকট ও বৈষম্য দক্ষিণপন্থার অনিবার্যতা। একটা চিরকালীন সংঘাত তাই বামপন্থা ও দক্ষিণপন্থায় চলে আসছে - আসছে চিরকালীন সেই দ্বন্দ্বের কারণে - জনস্বার্থ বনাম মুনাফার সংঘাতে।
আর এই সংঘাতের প্রেক্ষিতেই প্রশ্নটা দুনিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়ায় - নিরসন দক্ষিণপন্থায় না বামপন্থায়? জনগণকে বঞ্চিত করে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করা দক্ষিণপন্থীদের কাজ। বামপন্থার কাজ ঠিক উল্টোটা, বঞ্চিত-নিপীড়িতের স্বার্থ রক্ষা করা এবং জীবন-জীবিকার সংকট, মানুষের চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্দশা পুঁজি করেই দক্ষিণপন্থায় মুনাফার দৌড় বাড়ে। দক্ষিণপন্থাকে তাই উঁচুদরের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি প্রভৃতি মুনাফা শিকারিদের প্রয়োজন। বিশ্বজোড়া মহামন্দার কারণে জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট হিটলারের উত্থান। জার্মানি এবং ইয়োরোপ-আমেরিকার মুনাফাবাজরা ‘রতন’ চিনেছিল - এরকম নীতিহীন-চতুর-ধর্মবিদ্বেষী, জনগণের ঐক্যবিনাশকারী তুখোড় বক্তাই তাদের প্রয়োজন। তাই, জার্মানিতে ধ্বনি উঠল ‘হের হিটলার’। যেমন লগ্নিপুঁজির জোয়াল টানার জন্য ভারতের আদানি-আম্বানিদের কাছে নরেন্দ্র মোদি হয়ে উঠলেন (অবশ্যই গুজরাট গণহত্যায় তার এলেম দেখে) তাদের প্রথম পছন্দ - কারোর কাছে তিনি অর্জুন - স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই হয়তো আবার কারোর কাছে। তাই সারা পৃথিবীতে বৈষম্যের নিরিখে ভারত শীর্ষে। এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কঙ্কালসার চেহারাটা প্রকট হয়েছে অতিমারীর এক্সরে-তে।
প্রাকৃতিক থেকে স্বাস্থ্য বিপর্যয়ে দেশে দেশে ত্রাতা হিসেবে ‘হেনরি রিভ ইন্টারন্যাশনাল কন্টিনজেন্ট’ উচ্চারিত হচ্ছে। করোনা-বিধ্বস্ত বিশ্বমানবতার চরম দুর্যোগে। আর্তপীড়িত মানুষ এদের জন্য অপেক্ষা করে। এরা ধনী প্রথম বিশ্বের কেউ নয়, তবু তাদের দেশ কোভিড মহামারীর দিনে ২০২০-২১ সালের মধ্যেই ৫৭টি মেডিকেল ব্রিগেড পাঠিয়েছে ৪০টি দেশে। প্রায় ৫০০০ নার্স-ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি মহিলা। এই দেশটির নাম কিউবা এবং ৬১ বছর ধরে মার্কিনিদের অর্থনৈতিক অবরোধে এই করোনাকালেই তাদের ৯০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। তবু ব্রিগেডের থামা নেই। এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের বছরে যার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭০ লক্ষ, তার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো, বর্তমানে মিগুয়েল জয়াজ ক্যানেল। এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি সমাজতান্ত্রিক এবং বামপন্থীদের বন্ধু। কয়েকটি ছোটো ছোটো রাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ডের মতো তাদের জনকল্যাণমুখী নীতিতে করোনার ভয়াবহতা রোধ করতে যথেষ্ট সফল হয়েছে।
এইসব রাষ্ট্রই জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে, বিলিওনেয়ার সৃষ্টিতে মন দেয়নি। জনস্বার্থ-জনকল্যাণী নীতির প্রেরণার উৎস পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন। হিটলারের মানুষ মারা নাজি পার্টিকেও এই সোস্যাল তক্মাটা লাগাতে হয়েছিল, হয়েছিল সোভিয়েতের পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রচেষ্টাও। কিন্তু উগ্র দক্ষিণ পথের সর্বোচ্চ শিখর ফ্যাসিজম আর পরিকল্পিত অর্থনীতি সহাবস্থান করতে পারে না - করেওনি। বরং জার্মানি ছাড়িয়ে তার মানব-বিধ্বংসী সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে মানবসভ্যতা ধ্বংস হতে বসেছিল।
আর সেই ধ্বংসের কিনারা থেকে পৃথিবী নামের গ্রহটাকে উদ্ধার করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লালফৌজসহ সমগ্র জনগণ। জর্জিয়াবাসী এক দাসের পৌত্র ও মুচির সন্তান থেকে, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা, ফ্যাসিস্ট দস্যুর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ইস্পাত-মানব যোসেফ স্তালিনের অসাধারণ নেতৃত্বে। জর্জিয়ার গোরিতে ১৮৭৯ সালে ২৩ ডিসেম্বর যে শিশুটা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল যোসেফ ভিসারিয়োনভিচ জুগাশ ভেলি নামে এক সার্ফ পরিবারে, যাকে বলশেভিক পার্টির বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় তাঁর সহযোদ্ধারা বিশেষত উন্নাসিক, নিজের সীমাহীন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অতি সচেতন ট্রটস্কি সব সময়েই, ‘কুঁড়ে, স্থূলবুদ্ধির লোক’ বলে চিহ্নিত করতে উৎসাহী ছিলেন। সেই-ই যোসেফ স্তালিন হয়ে সারা মানব সভ্যতার নায়ক হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনার ছায়াও সেদিন হয়তো ছিল না। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী কমিউনিস্ট হীরেন মুখার্জির মতে স্তালিনের জীবনঃ ‘‘এক অসাধারণ জীবন, বিরামহীন, নিরহঙ্কার, কিন্তু আলো-আঁধার দিয়ে রচিত ইতিহাসের মহাকাব্য - বোধহয় একটি ক্ষুদ্র মহাকাব্য...।’’ আর সেই মহাজীবনই, ইয়োরোপের ধনী দেশগুলো থেকে অন্তত ৫০-১০০ বছর পিছিয়ে থাকা একটা দেশকে সম্পদে-শৌর্যে-বীর্যে-শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পথ ধরে।
যোসেফ স্তালিন, তাই গোটা বুর্জোয়া-বিশ্বের চরমতম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ১৮৪৮ সালে, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর মধ্যে ইয়োরোপের বুর্জোয়ারা ভূত দেখেছিল, আর স্তালিনের মধ্যে সেই ভূতকে বোধহয় এমন জ্যান্ত দেখে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর প্রবল আক্রোশে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্তালিন-পীড়ন মাত্রাছাড়া গতিতে তীব্র করে। তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সেদেশের জ্ঞানচর্চার ধারায় বিশিষ্ট চারজন, লিওটার্ক-ফুকো-দেরিদা ও বডিলার্ড যে উত্তর আধুনিকতার তত্ত্বের উদ্ভব করেন, সেই তত্ত্ব মূলত মার্কসবাদকে দ্ব্যর্থহীনভাবে খণ্ডন করে তো বটেই, এমনকি স্তালিনের নেতৃত্বকে বিশেষভাবে তীরবিদ্ধ করে। সোভিয়েত বিরোধী ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯৮২ সালে সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ডের পতনের পর থেকেই গণমাধ্যমে যেভাবে সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশের জনসাধারণের দুর্দশাকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে উদগ্রীব ছিল, তাতেই হয়তো এরা আরও উৎসাহী হয়ে বিশ্ব সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ যোসেফ স্তালিনের অসাধারণ সাফল্যকে নস্যাৎ করে। তার ত্রুটি ও খুঁত বের করতেই তৎপর হয়ে ওঠে।
বুর্জোয়া বিশ্ব এবং শেষদিকের সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্ণধারেরা হাতির দাঁতের খুঁত ধরতেই সময় ও মেধা ব্যয় করেছেন। ঐতিহাসিক চরিত্র যেমন বহু ক্ষেত্রেই মহান হয়েও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নন, স্তালিনও তেমনি নিশ্চয়ই সর্বশুদ্ধ ছিলেন না। তিনি কল্পিত দেবতাও নন। প্রাণহীন যন্ত্রও নন, ঝড় তুফানে প্রবলভাবে বেঁচে থাকা একজন বিরামহীন কাজের মানুষ। কাজের মানুষের পক্ষে ১ শতাংশ কাজ বেঠিক করাটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। আর তার জন্যে ৯৯ শতাংশে কালিঢালা, শত্রুতা এবং হীনম্মন্যতার একাংশ।
স্তালিনকে বলা হয়েছে ‘বলশেভিক জার’। সমাজতন্ত্রের শত্রুদের স্তালিনের প্রতি ক্রোধের মাত্রা এত বেশি যে, তাঁকে কলঙ্কিত এবং হীন প্রমাণ করতে অভিধানে এমন কোনো কদর্য শব্দ নেই, যা তারা প্রয়োগ করেনি। স্তালিন তাই কখনও ‘জারজ বুড়ো ভাম’, ‘ঘোলাটে চোখের বদমাইশ’, আবার কখনো ‘বসন্ত রোগের গুঁটিচিহ্নে ভরা ভগবান’ ইত্যাদি ইত্যাদিতে চিহ্নিত হয়েছেন।
হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার দায়ে যোসেফ স্তালিনকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। রুশ বিপ্লব, বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মাণ এবং বিশ্বাসঘাতকদের বিচার নিয়ে কিছু হয়তো বাড়াবাড়িই হয়েছে। কিন্তু শেষ ব্যাখ্যায় - এই আপাত অবাঞ্ছিত পদক্ষেপগুলি ফরাসি বিপ্লবের কিছু ভয়ংকরতা সত্ত্বেও, যেমন ইতিহাসের গতিকে প্রগতিমুখী করেছে, তেমনি স্তালিন যুগও মানব সভ্যতাকে তার ভালো-মন্দ নিয়েই আগামী দিনের জন্য উর্বরতা দান করেছে। চিরকালই যা কিছু সুন্দর, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের মতো, তার জন্য যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা অনেক সময়ই ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে।
স্তালিনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলির অন্যতম, তাঁর অনুদারতা ও গোঁড়ামি, সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের সরিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, সোস্যাল ডেমোক্র্যাসির বিরাগ-বিতৃষ্ণা ছিল। তাঁর মতে এটা ফ্যাসিবাদের বিপরীত মেরুর তা নয়ই বরং একই বৃন্তের দুটো মটরশুঁটির দানার মতোই। জার্মানিতে হিটলারের ভয়ংকরতার উত্থান বা স্পেনের প্রশ্নে অথবা নাৎসি-সোভিয়েত যুদ্ধের সময়ে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের ভূমিকা কখনই সমাজতন্ত্রের স্বার্থমূলক ছিল না, যার সাথে স্তালিনের মতো বিশুদ্ধ লেনিনবাদীর কোনো আপস করা কখনও সম্ভব নয়, তবুও ১৯৩৫ সালের কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে গৃহীত যুক্তফ্রন্ট লাইনের পক্ষেই বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অন্যান্যদের সাথে বিরোধ যেমন প্রকাশ পেয়েছে, জর্জি ডিমিট্রভের সাথে বিরোধ হলে তা গোপন থাকত না।
জোসেফ স্তালিন নাকি চরম স্বৈরাচারী এক অমানবিক শাসক। সম্ভবত ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত স্তালিনের ইতিবাচক দিকই উদ্ভাসিত হয়েছে। বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি যত ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এবং ক্লেশকর হয়েছে - ততই ‘ইস্পাত’ তপ্ত হয়েছে - আর জনগণকে দিতে হয়েছে কল্পনাতীত কঠোর সচেতন ও সুশৃঙ্খল শ্রম যা বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়ত। পিছিয়ে পড়া দেশের কৃষি ও শিল্প-উন্নয়ন করার চ্যালেঞ্জ সফল করতে তাঁকে সমস্ত শক্তির উদ্বোধনের জন্য বলতে হয়েছে অন্য দেশ থেকে ৫০ বা ১০০ বছরের দূরত্ব তারা দশ বছরে অতিক্রম করবে। ‘‘আমরা এটা করব, নচেৎ তারা আমাদের ধ্বংস করে দেবে’’। তাই ওই রুঢ়-রুক্ষ্ম-অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষটিই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপুল সাফল্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন।
১৯৩৭ সালকে চিহ্নিত করা যায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অপরাধে অপরাধীদের বিচার ও বহিষ্কার হিসেবে। যা দেশি-বিদেশি দর্শকদের উপস্থিতিতে হয়েছে। নির্মম বিচার হয়েছে জিনোভিয়েভ, কামেনেভ-বুখারিনদের মতো জবরদস্ত বলশেভিক নেতাদের। না - ইস্পাতদৃঢ় স্তালিন এডমন্ড বার্কের মতো মরণোন্মুখ পাখির জন্য দরদ না দেখিয়ে - পাখির পালকের জন্য দরদ দেখাননি। গ্ল্যামারহীন সাদা-সরল, মার্কসবাদে অটল বিশ্বাসী লেনিন শিষ্য স্তালিন তাঁর কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা নিয়ে কখনও অনুতপ্ত ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, এর মধ্যদিয়ে ইতিহাস-নির্দেশিত এক দায়িত্বই তিনি পালন করছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জে কে ভিস’র মতো ব্যক্তিত্বও অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, প্রকাশ্য বিচার অভিযুক্তদের প্রতি যুক্তিযুক্ত ভাবেই ন্যায্য ছিল। স্তালিন এমনই অমানবিক এবং নিষ্ঠুর, নিজের ছেলেটি যখন নাৎসি কারাগারে বন্দি তখনও। মার্শাল যুকভের প্রশ্নের উত্তরে স্তালিন বলেছিলেন - ‘‘কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে তাঁর ছেলের মুক্তির চেয়ে মৃত্যুই তাঁর কাছে কাম্য।
যোসেফ স্তালিন কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং আত্মম্ভরী স্বেচ্ছাচারী? যুদ্ধবিজয়ী সোভিয়েত জনগণের হৃদয়ে যখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে, তখন জার্মানির জন্য তাঁর ছিটেফোঁটা দয়া না থাকলেও তিনি ইস্পাত কঠোর কণ্ঠে ‘না’ বলে ওই জনগণকে সংযত করেছেন তাঁর পায়ের জুতোর দিকে তাকিয়ে, যখন নিজের কাপড় বাঁধা পা দেখছিল তরুণ সেনা স্তালিনকে গার্ড অফ অনার জানাবার সময়, তখন স্তালিন অবলীলায় কিন্তু তাঁর জুতো জোড়া সেই সৈনিককে দিয়েছিলেন প্রসন্ন মনে, কোনো চমক দেখাতে নয়। কিন্তু ট্রটস্কি যখন শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে তার শাস্তির সুপারিশ করেন, তখন মার্শাল স্তালিন তাকে ক্ষমা করেছেন। তাঁর উদার হৃদয় এবং অপরিসীম মানবিকতার সাক্ষী, বার্লিনে যুদ্ধ-স্মারক তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী নিজের মূর্তির বদলে, এক লাল ফৌজের কোলে উদ্ধার করা জার্মান শিশুর মূর্তি-স্থাপন।
স্তালিনের স্বৈরতন্ত্র, নিষ্ঠুরতার দায়ে যারা তাঁকে অভিযুক্ত করেন, তারা কি, হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসের জন্য কখনও কি প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান-এর দিকে আঙুলটুকু তুলেছেন - অভিযোগ দায়ের করেছেন সেইসব মানবতাবাদীরা ইরাক গণহত্যার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে? স্তালিনবাদ কি, সমাজতন্ত্রের মুখোশ পরে সমাজতন্ত্র ধ্বংস করা গর্বাচভের অপরাধের থেকেও বেশি বিপজ্জনক, যে কারণে স্বনামধন্য বিপ্লবীরা নীরব থাকেন?
মহান লেনিনের পর, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রধান স্থপতি, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রয়োগের শীর্ষ নেতৃত্ব, নিপীড়িত জাতির নবজীবনের উদ্গাতা, সরল-সহজ-সনিষ্ঠ-অনমনীয় মার্কসবাদী হিসেবে যোসেফ স্তালিনকে স্বীকৃতি না দিলেও কে অস্বীকার করবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্টদের উন্মত্ত তাণ্ডব থেকে মানব সভ্যতা বেঁচে আছে ওই অনভিজাত সাদা-মাটা যোসেফ স্তালিনের সাহসী সুযোগ্য কুশলী নেতৃত্বের কারণে? ভারতের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্তালিনের স্মরণে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কেন বললেন - ‘‘যে যুগে আমরা বাস করছি, তিনি ছিলেন তার স্রষ্টা? ব্রিটিশ শ্রমিকদলের সমাজতত্ববিদ জে এল হ্যামন্ড কি বলেননি - ‘‘এমন এক সৈন্যবাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন যা আমাদের সকলকে বাঁচিয়েছে’’?
‘স্বৈরাচারী’ স্তালিন যুগের অভিজ্ঞতায় নেহরু আবারও বলেছিলেন - ‘‘ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নীতির এমন বাস্তব প্রয়োগ ঘটেনি।’’ স্তালিন, নতুন সভ্যতার নতুন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, যারা দেশপ্রেমী ও বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী। লৌহ-দৃঢ় শৃঙ্খলায় তিনি জনগণকে সৈন্যবাহিনীর ঐক্যে সজ্জিত করেছিলেন। সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করতে। শুধু সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের স্বার্থ নয়, স্তালিন চেয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের আশার কেন্দ্রকে রক্ষা করতে। শ্রমিকশ্রেণি আন্তর্জাতিক চেতনায় সমৃদ্ধ তাঁর উক্তি সোভিয়েত জনগণকে উদ্দেশ্য করে বিশ্ব নিপীড়িতের ভাবনায় - ‘‘এই হলো আমার অগ্রগামী বাহিনী, আমার কাজ সম্পাদন করার কর্মীবাহিনী, এই হলো আমার শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র, আমার পিতৃভূমি।’’ তাই তিনি, বিশ্ব নিপীড়িতের ভরসার স্থানকে নিরাপদ, নিষ্কণ্টক রাখতে সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক ও অপরাধীদের গণমৃত্যুদণ্ডও দিয়েছেন এই বিবেচনায় যে, কিছু নির্দোষ ব্যক্তির শাস্তি হলেও, কোনো দোষী ব্যক্তিই যেন শাস্তি এড়াতে না পারে। এর ন্যায্যতা আছে সেই ভয়ঙ্কর সময়ে, সমাজতন্ত্র নির্মাণে বাধার প্রাচীর আর ফ্যাসিস্ট শত্রুর বিধ্বংসী তাণ্ডব ও সমাজতন্ত্রের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের বিভীষিকার পরিস্থিতিতে এবং ‘‘সামুদ্রিক ঝড়, প্লাবন অথবা সূর্যগ্রহণের মতো প্রাকৃতিক শক্তির বহির্প্রকাশে কোনো নৈতিক বিচারের মানদণ্ড প্রয়োগ করা অবাস্তব।’’
শুধু সমাজতন্ত্র নয়, আক্রান্ত বামপন্থার বিপন্নতায়, যিনি কখনও পিছু হঠেননি, বুক চিতিয়ে এগিয়ে গেছেন, মতাদর্শের অস্ত্রে সজ্জিত, আপসহীন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী যোসেফ স্তালিনের শিক্ষা অনুসরণ করে বামপন্থার যোদ্ধাদের রণক্ষেত্রে দাঁড়াতে হবে এই বিশ্বাসে - ‘‘We fall to rise, are baffled to fight better; sleep, to wake.”। আর তাদের জাগরণে যখন একদিন মানুষের পক্ষে সব মানুষকে হাত এগিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, সেদিন হয়তো এই অনমনীয়-লৌহমানব যোসেফ স্তালিনের বিচার এমন কর্কশ ও বর্বর হবে না।