৫৯ বর্ষ ১৯ সংখ্যা / ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ / ৮ পৌষ, ১৪২৮
সহজপাঠ
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘ছোটো খোকা বলে অ আ
শেখেনি সে কথা কওয়া।’
খাবার হাতের সামনে আসছে খবর পেয়ে বেড়াল নিজে থেকেই আগাম ঘোষণা করলো মাছ খাবো না, আঁশ ছোঁবো না। তাই শুনে কাকপণ্ডিতদের মাথা নেড়ে সে কী উল্লাস! এই না হলে যুবরাজ। এ একেবারে যুবরাজোচিত ঘোষণা। নিউজপ্রিন্ট কম পড়ে গেল। প্রাইমটাইমে কালোবাজারি করে সময় ভিক্ষা। যুবরাজের ঘোষণা বলে কতা! “ভোট শান্তিতে করতে হবে, কোনওরকম অভিযোগ যেন না আসে। নম্র থাকতে হবে। গায়ের জোরে নয়, মানুষের পাশে থেকে ভোট করাতে হবে। একটিও অভিযোগ পেলে দল কিন্তু কড়া ব্যবস্থা নেবে।” এটা ৪ ডিসেম্বরের বিড়ালীয় ঘোষণা। কলকাতার মহারাষ্ট্র নিবাসে। এর পরেরটা মুখ্যমন্ত্রীর। ৯ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার। পুরভোটের আগে দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে যিনি বলেছিলেন, কলকাতা পুর এলাকার লাগোয়া যাঁরা থাকেন, তাঁরা এসে দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার করতে পারেন, মিছিল-মিটিং-বক্তৃতা করতে পারেন। এছাড়া ওই নেতাদের আর কোনও ভূমিকা যেন না থাকে। ঠিক ঠিক। একদম ঠিক। আগাম এইসব ঘোষণায় পুরভোট নিয়ে সংশয় ছিলো সকলের মধ্যেই। আর ১৯ ডিসেম্বর যখন কলকাতার বুথে বুথে শান্ত ছেলের দলবল হঠাৎ ভুল করে সামান্য একটু দুষ্টুমি টুষ্টুমি করছে তখন যুবরাজ আবার কহিলেন - ‘‘অশান্তিতে তৃণমূল জড়িত আছে প্রমাণ দিতে পারলে দল ব্যবস্থা নেবে। অশান্তির ভিডিয়ো ফুটেজ থাকলে আনুন। তৃণমূলের কেউ, কোথাও, কোনও জড়িত আছে প্রমাণ দিতে পারলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দল ব্যবস্থা নেবে।” এ তো বড়ো রঙ্গ জাদু। তবে এটা ঠিক। দিন ২৫ আগে অন্য রাজ্যে মাসতুতো ভাইয়ের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে এটাও হয়তো একটা টেস্টিং। তাই ত্রিপুরার ২৪ নভেম্বরের নির্বাচনের কপি-পেস্ট ১৯ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। যেখানে আগরতলা কলকাতা মিলে মিশে এক হয়ে যায়। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই পরস্পরের পিঠ চাপড়ায়। কে বলে ছোটোখোকা কথা কওয়া শেখেনি?
‘হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
বসে খায় ক্ষীর খই’
চারিদিকে থরে থরে সাজানো ক্ষীর খই। কেউ শিঙাড়া দিয়ে খায়, কেউ তোয়ালে মুড়ে খায় আবার কেউ স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে খায়। যোগ করে খায়। বিয়োগ করে খায়। গুণ করে খায়। ভাগ করে খায়। ওপর থেকে নীচ - শতকরার হিসেবে খায়। পেলেই খায়। কিন্তু লোভ যায় না। প্রোমোটর থেকে সবজিওয়ালা - আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট - নিস্তার নেই কারোর। এখন ভোট খাচ্ছে। কেড়ে খাচ্ছে। গিলে খাচ্ছে। বন্দুক দেখিয়ে খাচ্ছে। বোতাম টিপে খাচ্ছে। বিরোধী দলের এজেন্টকে মেরে খাচ্ছে। এমনকি মরা মানুষকেও খেয়ে ফেলছে। শকুনরাও এত লজ্জা পেয়েছে যে তাদেরও আর দেখা যাচ্ছে না।
সদ্য শেষ হওয়া কলকাতার পুর নির্বাচনে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভোট পড়েছে ২৫,৩৯৫। সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ২৪,৭০৮টি ভোট। শতকরার হিসেবে ৯৭.২৯%। বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকরাও লজ্জা পেয়ে যাবেন এই ভোটের হারে। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ৯৩.০২ শতাংশ ভোট। ৩৪টি ওয়ার্ডের উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে তৃণমূল প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট ৮০ শতাংশর বেশি। ৪৪টি আসনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক দলের পক্ষে জয়ের ব্যবধান ৬২,০৪৫ ভোট। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩৯ থেকে ১৪২ নম্বর বুথ। তৃণমূলের ভোট ১০০৯, ১১৬৮, ৯৬৫, ৯০০। সিপিআইএম ০, ১, ১, ২। বেলেঘাটার ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ থেকে ২৯ নম্বর বুথ। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৬৮৬, ৩৭৫, ৮৩৮, ২৮১। সিপিআইএম-এর প্রাপ্ত ভোট ০, ০, ১, ২। ভোটে জেতার পর ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে জবরদখল হয়ে গেল পার্টি অফিস। উদাহরণ দিয়ে আর ভারাক্রান্ত করে লাভ নেই। ক্ষান্ত দিলাম।
‘হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ
ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ’
২০১৮-র আগস্ট। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ-র ন্যায্য দাবি প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, আমার কাছে মিউ মিউ ঘেউ ঘেউ করে লাভ হবে না। আমি যতটা দিতে পারি সেটা আমাকে বলতে হয় না। যে মন্তব্য প্রসঙ্গে হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে জানিয়েছিলেন, ‘ঘেউ ঘেউ শব্দটি দুর্ভাগ্যজনক৷’ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় খারিজ করা হচ্ছে। ডিএ অবশ্যই কর্মীদের অধিকার, তা সরকারের ‘দয়ার দান’ নয়। এর আগে ট্রাইব্যুনালের কাছে রাজ্য সরকার জানিয়েছিলো - ডিএ কর্মীদের অধিকার নয়। বরং তা সরকারের ইচ্ছার উপরে নির্ভরশীল। সিপিআই(এম) বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী যে প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজের মাইনেটা বাড়িয়ে নিলেন ১২ গুণ। আর শ্রমিক, কর্মচারী, মাস্টারমশাই, বোর্ড কর্মচারী, অশিক্ষক কর্মচারী - তাঁরা সব অন্যায় করেছেন? তাঁদের ডিএ দেবেন না? দয়ার দান!’’
‘ঘন মেঘ বলে ঋ
দিন বড়ো বিশ্রী’
অমুক শ্রী, তমুক শ্রী-র আড়ালে বিশ্রী-কে ঢাকার চেষ্টা চোখ এড়ায় না। ওপরের চিকন চাকন দিয়ে ভেতরের খড়ের গাদন ঢাকা যায়না। কসমেটিক ডেভেলপমেন্টে চোখের আরাম দিয়ে মাথার সমস্যা ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা। ঠিক কবে থেকে এই বিশ্রী দিনের শুরু তার হিসেব নিকেশ করাই যায়। যদিও কতটা হিসেব পাওয়া যাবে, যাবেনা, মানবেন, মানবেন না - সেটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। ঘন মেঘে ঢেকে যায় বোধ, অস্তিত্ব। আর সঙ্গে চলে মেঘ ছিঁড়ে রোদ বের করার লড়াই।
বিগত দশ এগারো বছর অথবা বিগত ছ-সাত বছর - যে কোনোটাই আলোচ্য হতে পারে। তুই ভালো না মুই ভালো সে বিতর্কও। ত্রিফলা, টেট, চিটফান্ড, নারদ, কয়লা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে এক নিঃশ্বাসে অনেক মেঘের কথা বলে ফেলা যায়। পার্ক স্ট্রিট, মধ্যমগ্রাম, রানাঘাট, আলিপুরদুয়ার, কামদুনির কথা বলা যায়। আবার বলা যায় ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ডিমনিটাইজেশনের নামে মানুষকে পথে বসানো, অপরিকল্পিত লকডাউন, পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া দাম, কৃষক আত্মহত্যা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ, অনাদায়ী ঋণ মকুব - এরকম আরও হাজারো কথা। সঙ্গে আছে বেড়ে চলা বৈষম্য, মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করার অপচেষ্টা, আদিবাসী মানুষের জল জমি জঙ্গল লুঠ। আসলে সব শাসকই ভুলে যান - সবকিছুরই যেমন শুরু থাকে তেমনই সবকিছুরই একটা শেষও।
‘বাটি হাতে এ ঐ
হাঁক দেয় দে দৈ।’
‘দে দৈ’। আর এস এস-এর বাংলা মুখপত্রে ডিসেম্বর সংখ্যায় এক নিবন্ধে লেখা হয়েছে ‘নরেন্দ্র মোদির স্বপ্ন কংগ্রেস মুক্ত ভারত। আপাতত মমতা সেই স্বপ্নের শরিক বলেই আমার ধারণা। তাই ইতিহাস মুছে ফেলে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মমতা।’ ওই প্রতিবেদনেই দিলীপ ঘোষকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘মমতাই এখন মুখ। সোনিয়া নয়। কংগ্রেসের দিন শেষ।’ অতএব নেপো যে পুরোনো অভ্যেসমতো বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এখন তার সারাদিনের চিৎকার ‘দে দৈ’, ‘দে দৈ’। সেই লক্ষ্যেই ত্রিপুরা সফর। টাকার থলি নিয়ে গোয়া সফর, উত্তরপ্রদেশ সফর। মেঘালয়ে ক্যু। সেই লক্ষ্যেই কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে প্রাণসখাকে ওয়াকওভার নেপোর। সেই লক্ষ্যেই আগরতলায় লড়তে নেমে নেপোকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। বিরোধী জোট যত ভাঙবে ততই নেপোর লাভ। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস যত ভাঙবে ততই নেপোর লাভ। আরও বেশি বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা। সামনে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। ক্ষমতা চাই যেন তেন প্রকারেণ। সেন্ট্রাল ভিস্তার রাজকীয় প্রাসাদ। ভ্রমণের জন্য কয়েকশো কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল এরোপ্লেন দুয়ারে। একটা রাজ্যে নাহয় থাকলোই পোষ্য সরকার। নেপোর তো ‘দৈ’ নিয়ে কথা। নেপোর সঙ্গীরও তাই। তাই সারদা, নারদ, কেলেঙ্কারি কান্ড শীতঘুমে। ‘ভাগ মমতা ভাগ’ বলা নেতা উত্তরপ্রদেশে। গত ১৮ ডিসেম্বর গোয়ায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস নেতা দীনেশ গুন্ডু রাও অভিযোগ করে বলেন, ‘গোয়ার জন্য তৃণমূল কী করেছে? আজ তারা কোটি কোটি টাকা নিয়ে এখানে এসেছে। বিভিন্ন জনকে বলা হচ্ছে দলের প্রার্থী হলে ১০ কোটি, ২০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। কোথা থেকে এই টাকা আসছে এবং কী কারণে তারা এই কাজ করছে?”
‘ডাক পাড়ে ও ঔ
ভাত আনো বড়ো বৌ।’
ডাক পেড়েছে। ডাক পড়েছে। রাস্তায় নামার। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। গুজরাট থেকে ত্রিপুরা। রাস্তায় বসে থেকে কৃষকদের ৩৭৮ দিনের দাঁত চাপা লড়াই। যে লড়াই আমাদের শিখিয়েছে দাবি কীভাবে ছিনিয়ে আনতে হয়। যে লড়াই শিখিয়েছে রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের বিরোধিতা সহ একাধিক দাবিতে এই ডিসেম্বরেই হয়ে গেছে দুদিনের ব্যাঙ্ক ধর্মঘট। যে ধর্মঘটের পর আপাতত বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা হলেও সাময়িক পিছু হটেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাজেটে কেন্দ্র দু’টি ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের কথা ঘোষণা করলেও বিলগ্নিকরণের বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রীসভার কমিটিকে। এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মূল প্রশ্ন ছিল, ব্যাঙ্কের মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? অর্থ মন্ত্রক উত্তর দেয়নি। শোনা যাচ্ছে আগামী বাজেট অধিবেশন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত।
আর অন্যদিকে ভোট লুঠ, সন্ত্রাসের মধ্যেও কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট বেড়েছে অনেকটাই। প্রায় ১১.৮৯ শতাংশের কাছাকাছি। লুট করা, ছিনিয়ে নেওয়া ভোট নয়। মানুষের ভোট। কলকাতা পুরসভার ১২৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছে ২টি আসনে। ৫টি আসনে খুবই কম ব্যবধানে পরাজয় আর ৬৫ আসনে দ্বিতীয় স্থান। যে ফলাফল অবশ্যই অন্য দিশার ইঙ্গিত।
শেষের কথা
বাড়ির বই-এর তাকে বহু বই, বহু কিছুর ভিড়ে সহজপাঠটা কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছিলো। গুলিয়ে যাচ্ছিলো স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ, যুক্তাক্ষর। হিসেব নিকেশ। পুরোনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ করেই দেখলাম অন্য বই-এর ভিড়ে বেমালুম চাপা পড়ে ছিলো সেই প্রাথমিক স্তরের প্রথম পড়া সহজপাঠ। যে সহজপাঠ শিখিয়েছিলো ‘আলো হয়/ গেল ভয়।/ চারি দিক/ ঝিকিমিক।’ যে সহজপাঠ বলেছিলো - ‘বেলা যায়। তেল মেখে জলে ডুব দিয়ে আসি। তার পরে খেলা হবে। একা একা খেলা যায় না। ঐ বাড়ি থেকে কয়জন ছেলে এলে বেশ হয়।’ এ বোধহয় আরও একবার ফিরে দেখার শুরু। আরও একবার নাহয় নতুন করে সহজপাঠের প্রথম ভাগ পড়া যাক...