৬০ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১১ ফাল্গুন, ১৪২৯
ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে তীব্র করো পরাস্ত করো কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের করপোরেট-সাম্প্রদায়িক নীতিকে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ নয়া উদারনীতির আগ্রাসী অনুসরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে তীব্র করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে নীতি পরিবর্তনের জন্য বাধ্য করতে হবে। প্রত্যক্ষ শ্রেণি আন্দোলনের মধ্যদিয়ে করপোরেট-সাম্প্রদায়িক নীতিকে পরাস্ত করতে হবে। চেতনায় শান দিয়ে জান কবুল লড়াইয়ের শপথ নিতে হবে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার রক্ষার জন্য। নির্মাণ শ্রমিকদের সর্বভারতীয় সংগঠন কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (সিডব্লিউএফআই)-এর দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন থেকে এই আহ্বান জানানো হয়। ১১ থেকে ফেব্রুয়ারি গুয়াহাটিতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১১ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনদিন ব্যাপী সম্মেলন শুরু হয় গুয়াহাটির সোনারাম হাইস্কুলের মাঠে প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে।
সম্মেলন থেকে ১৩২ জন সদস্যের নতুন কর্মসমিতি এবং ৩৮ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। সংগঠনের নতুন সভানেত্রী হিসেবে কে হেমলতা, সাধারণ সম্পাদক ইউপি জোসেফ এবং রামচন্দ্রন কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হন।
আসামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিকরা বর্ণাঢ্য মিছিল করে প্রকাশ্য সমাবেশে যোগ দেয়। হাইস্কুল মাঠের প্রায় ২৫ হাজার মানুষের এই সমাবেশ থেকে গুয়াহাটির মানুষ প্রত্যক্ষ করেন শহরের সাম্প্রতিক সময়ের সর্ববৃহৎ শ্রমিক জমায়েতের উত্তাপ। উদ্দীপনাময় স্লোগানমুখর সমাবেশ থেকে শ্রমিকদের জঙ্গি চেতনা ছড়িয়ে যায় শহরে।
সমাবেশের মূল বক্তা সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন বলেন, সিআইটিইউ সর্বভারতীয় ১৭ তম সম্মেলন দেশবিরোধী আরএসএস-বিজেপি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার ডাক দিয়েছে। এই সময়ে আমাদের জরুরি কাজ হলো এই সরকার কতটা জনবিরোধী, শ্রমিকবিরোধী এবং দেশবিরোধী সেই বার্তা নিচুতলায় পৌঁছে দিতে হবে, আমাদের পৌঁছাতে হবে দেশের প্রতিটি বাড়িতে।
নির্মাণ শ্রমিকদের বিভিন্ন ইস্যু তুলে ধরে তিনি বলেন, মোদি সরকার নির্মাণ শ্রমিকদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকার বিওসিডব্লিউ আইন এবং পরিযায়ী শ্রমিক আইন দু’টিকে শ্রম কোডের ভেতরে সংযুক্ত করে লঘু করেছে। নির্মাণ শ্রমিকদের ওয়েলফেয়ার বোর্ডকে দুর্বল করার জন্য সেস সংগ্রহে ঢিলেমি দেখাচ্ছে। ওয়েলফেয়ার বোর্ডের পড়ে থাকা বহু কোটি টাকা শ্রমিকদের স্বার্থে ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে। এই সরকার শ্রমিকদের কথা শুনতে চাইছে না। তাই আগামী ৫ এপ্রিল দেশের শ্রমিক এবং কৃষকরা লাখো সংখ্যায় দিল্লি পৌঁছে এই সরকার যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষাতেই স্পষ্ট বার্তা দিতে চায় যে, দেশকে বেচে দেওয়া আর বরদাস্ত করা হবে না।
সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সু্খবীর সিং, দেবাঞ্জন চক্রবর্তী, ভি শশী কুমার সহ আসামের সিপিআই(এম) নেতা, বিধায়ক মনোরঞ্জন তালুকদার প্রমুখ।
সমাবেশ থেকে ত্রিপুরার বাম এবং গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। শ্রমিকরা ওই সমাবেশ থেকে ৩৩ হাজার টাকা তুলে দেন ত্রিপুরা সংহতি তহবিলে।
১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্ব শুরু হয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে। সংগঠনের বিদায়ী সভাপতি সুখবীর সিং রক্তপতাকা উত্তোলন করেন। এরপর নেতৃবৃন্দ এবং প্রতিনিধিরা শহিদ স্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনস্থল প্রাগজ্যোতি কালচারাল কমপ্লেক্স-এর নামকরণ করা হয় কমরেড কেভি জোস নগর এবং মঞ্চের নামকরণ করা হয় কমরেড বিশ্বেশ্বর পাসওয়ান এবং কমরেড অসিত মুখার্জির নামে।
সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশনপর্বের উদ্বোধন করে সিআইটিইউ সভানেত্রী কে হেমলতা বলেন, সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র এবং নয়া উদারবাদী রাজনীতিকে পরাস্ত করার প্রশ্নে নির্মাণ কর্মীদের সংগঠন সিডব্লিউএফআই-কে সর্ববৃহৎ ফেডারেশন হিসেবে শ্রেণি ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে এবং সংগ্রামকে তীক্ষ্ণ করে তুলতে ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, মোদি সরকার নিবন্ধীকৃত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছে। তাই নির্মাণ কর্মীদের মানুষের কাছে গিয়ে বলতে হবে এই নীতিসমূহের পেছনে থাকা শ্রেণি রাজনীতির কথা।
দিল্লির আসন্ন ৫ এপ্রিলের মহাসমাবেশ সফল করার জন্য নির্দিষ্ট দাবি দাওয়ার ভিত্তিতে প্রচার গড়ে তোলার বিষয়টিতে জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রচারের মধ্য দিয়ে সাধারণ শ্রমিক এবং শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে আমাদের। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই সময়কালে চলা শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমান উদারবাদীনীতি সমূহের জেরে অসন্তোষ বাড়ছে বিশ্বজুড়েই। দেশে করপোরেট-সাম্প্রদায়িক এই জমানার বিরুদ্ধে আরও বড়ো মাপের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সম্মেলন পরিচালনার জন্য সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয় সংগঠনের বিদায়ী সভাপতি এবং সমস্ত সহ-সভাপতিদের নিয়ে। শোক প্রস্তাব পেশ করেন আর সিঙ্গারাভেলু।
দুটি পর্বে সংগঠনের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক ভি শশী কুমার সম্পাদকীয় খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন।
খসড়া প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে ধনতন্ত্রের ব্যবস্থাগত সংকট, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, ক্ষুধা, নিদারুণ বেকারত্ব, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি, বাড়তে থাকা শ্রমিকদের প্রতিরোধের লড়াই, বিগত নবম সম্মেলন থেকে এ পর্যন্ত দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যক্রম সবটাই তুলে ধরা হয়েছে।
খসড়া রিপোর্টের দ্বিতীয় পর্বে নির্মাণ শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি এবং পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রের পরে নির্মাণ ক্ষেত্র হচ্ছে দ্বিতীয় ক্ষেত্র, যেখানে সব থেকে বেশি কর্মসংস্থান হয়। বর্তমানে ৫ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, যারা দেশের জিডিপি’র ১১ শতাংশের জোগানদার।
কিন্তু সিডব্লিউএফআই-এর সদস্য এই এই বিশাল অংশের মানুষদের মাত্র ২.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ নিবন্ধীকৃত নির্মাণ শ্রমিক সংগঠনের বাইরে রয়ে গেছে। রিপোর্টে আহ্বান জানানো হয়েছে, সংগঠিত ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র এবং বেসরকারি নির্মাণ সংস্থাগুলিতে যুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে আসতে হবে সংগঠনের মধ্যে।
সম্মেলনে ৩৪০ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন গোটা দেশে ছড়িয়ে থাকা সংগঠনের ১১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬০২ জন সদস্যের পক্ষ থেকে। মহিলা প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ৪৫ জন।
খসড়া প্রতিবেদনের ওপর ২১টি রাজ্য থেকে আসা প্রতিনিধিদের মধ্যে ৪২জন আলোচনা করেছেন।
সম্মেলন থেকে ৫ এপ্রিলের মজদুর কিষান সংঘর্ষ রালি, চারটি শ্রম কোড বাতিল, বিওসিডব্লিউ আইন সুরক্ষা, আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন সুরক্ষা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকারী শক্তিকে পরাস্ত করা এবং ত্রিপুরার বাম ও গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের জয়যুক্ত করা সহ অন্যান্য প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়েছে।
সিআইটিইউ সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে কাশ্মীর সিং ঠাকুর বলেন, সংগঠনের বিস্তৃতির প্রচুর সুযোগ রয়েছে আমাদের কাছে।
সম্মেলনের শেষ পর্বে ধন্যবাদসূচক বক্তব্য রাখেন কে হেমলতা।