E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১১ ফাল্গুন, ১৪২৯

কাজের অভাবে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে বাংলার যুবকরা

অভয় মুখার্জি


।। এক।।

এই রাজ্যে এখন আর চাকরি পাওয়ার তালিকা বের হয়না, বরং চাকরি কাদের চলে গেল সেই তালিকা প্রকাশিত হয়। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে স্থায়ী কাজের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দ্রুত বেগে। এটাই উদার অর্থনীতির প্রভাব। যেটুকু চাকরি বা কাজ আমাদের রাজ্যে হচ্ছে সেখানে শুধুই দুর্নীতি। শাসকদলের নেতাদের মোটা টাকা দিয়ে চাকরি পাচ্ছে নিম্ন মেধার ছেলেমেয়েরা, আর মেধা তালিকার প্রথম দিকে থাকা ছেলেমেয়েরা কাজের দাবিতে অনশন করছে কলকাতার রাজপথে। এটাই বর্তমানে আমাদের রাজ্যে শিক্ষিত যুব অংশের প্রকৃত অবস্থা। অন্যদিকে এর বাইরে যে অসংখ্য যুব অংশ আছে, যাঁরা গতর খাটিয়ে কিছু উপার্জন করে দিন গুজরান করতেন তাদেরও এখন এই রাজ্যে কাজ নেই। তৃণমূল সরকার এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর কলকারখানাগুলো হয় বন্ধ হয়ে গেছে আর কিছু অন্যত্র চলে গেছে। যে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে বামফ্রন্ট সরকারের সময় আমাদের রাজ্য দেশের মধ্যে প্রথম ছিল, যার সাহায্যে গ্রামাঞ্চলে এবং মফস্‌সলে বহু ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হতো তার অবস্থাও এখন তথৈবচ। আমরা সবাই জানি গ্রামের মানুষের কাজ পাওয়ার একটা বড়ো জায়গা হলো ‘‘গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প’’। পার্লামেন্টে যখন বামপন্থীদের ৬১ জন সাংসদ ছিলেন তাঁরা কংগ্রেস সরকারকে বাধ্য করেছিলেন এই প্রকল্প চালু করতে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রাজ্যে এই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, শাসকদলের মদতে কাজ না করে টাকা আত্মসাৎ করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পে প্রতিবছর বাজেটে বরাদ্দ কমানো ইত্যাদির ফলে এই রাজ্যে গ্রামের গরিব মানুষ কাছ পাচ্ছেন না। এমনকী কাজ করেও প্রায় গত একবছর ধরে সেই কাজের টাকা এখনো গরিব মানুষ পায়নি। ফলে কাজের প্রশ্নে গ্রামবাংলা তীব্র সংকটের মধ্যে আবদ্ধ। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হলো এই বছরের মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লক্ষ কমে যাওয়া। এই অংশটা স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়েছে, কারণ গরিব অংশের যুবক যুবতীরা আর পড়াশোনা চালাতে পারছেনা। বাঁচার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। অথচ রাজ্যে যখন বামফ্রন্ট সরকার ছিল তখন প্রতিবছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ত এবং ড্রপ আউটের হারও কমে আসছিল।

আমরা সবাই জানি আমাদের রাজ্যে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলার তথাকথিত জঙ্গলমহলে আদিবাসী অংশের মানুষের বাস বেশি। বামফ্রন্ট সরকার থাকার সময় বনরক্ষা কমিটি থাকার মধ্য দিয়ে শুধু বন রক্ষা করা নয়, এই অংশের মানুষের কাজ ও উপার্জনের ব্যবস্থা করেছিল। ল্যাম্পসগুলোও ছিল সজীব। কেন্দুপাতা ছিল অর্থ উপার্জনের একটা বড়ো ক্ষেত্র। তার সাথে আদিবাসী ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা, আবাসিক হোস্টেলে বিনা পয়সায় থাকা খাওয়া ও পড়াশোনার সব দায়িত্ব ছিলো সরকারের। কিন্তু এখন বনরক্ষা তো দূরের কথা, শাসকদলের নেতাদের মদতে জঙ্গলমহলে দামি দামি গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। ল্যাম্পসগুলো কার্যত বন্ধ। আদিবাসী ছাত্র ছাত্রীদের হোস্টেলগুলো একই অবস্থা। বর্তমান সরকার এই অংশের জন্য মাঝেমাঝে নাচাগানার ব্যবস্থা করলেও তা দিয়ে পেট ভরে না। তার জন্য কাজ চাই। কিন্তু আমাদের রাজ্যে কাজের হাহাকার।

।। দুই ।।

গ্রামবাংলা এইরকম কাজের আকাল বহুদিন দেখেনি। আর তার পরিণতিতে গ্রাম ছেড়ে, শহর ছেড়ে এমনকী রাজ্য ছেড়ে প্রতিদিন আমাদের রাজ্যের হাজার হাজার যুবক ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কত ছেলে মেয়ে কাজের জন্য অন্য রাজ্যে চলে গেছে বা যাচ্ছে তার কোনো সরকারি তথ্য নেই। সরকার বরাবরই এটা অবহেলার চোখে দেখেছে। সম্প্রতি করোনার সময় এই অংশের মানুষের ভয়াবহ দুর্দশার করুণ ছবি প্রত্যক্ষ করার পর এদের বিষয়টি মানুষের নজরে আসে। এদের পরিযায়ী শ্রমিক (migrant worker) বলা হয়। সাধারণভাবে যে হিসেব আমরা পেয়েছি তাতে এই সময়ে কাজের জন্য আমাদের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে গেছেন এইরকম পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লক্ষ। প্রতিদিন এই সংখ্যাটা বাড়ছে। গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে বেশিরভাগ পুরুষ বাইরে চলে যাওয়াতে গ্রামগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া জেলাতে এইরকম অনেকগুলি গ্রাম আছে যেখানে ৪০-৪৫টি পরিবারের মধ্যে ৩৫-৩৭টি পরিবারের পুরুষেরা কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে। উত্তরবঙ্গের বহু গ্রামে, আবার উত্তর চব্বিশ পরগনা, মালদার মতো জেলার অনেক গ্রামে এই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলায়। এই যুবকদের বেশিরভাগ নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত। এছাড়া হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অলঙ্কার শিল্প, দরজির কাজ, জরির কাজ প্রভৃতি নানাবিধ কাজে যুক্ত রয়েছে। দেশের প্রায় সর্বত্র বিশেষত কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, দিল্লি ইত্যাদি রাজ্যে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সবথেকে বেশি। রাজ্যে কিছু গ্রাম এর ফলে একেবারে পুরুষ শূন্য হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাঁকুড়ার রানিবাঁধ ব্লকে টেলাপশাড়ি গ্রামে ৪০টি পরিবারের মধ্যে ৩৯টি পরিবারের পুরুষেরা কাজের জন্য অন্য রাজ্যে চলে গেছেন।

।। তিন।।

যারা অন্যত্র কাজের জন্য চলে যাচ্ছে কেরালা বাদে অন্য কোনো রাজ্যে তাদের কাজের কোনো নিরাপত্তা নেই। অধিকাংশ যুবকেরা যায় ঠিকাদারের মধ্য দিয়ে। ফলে অধিকাংশ শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, চিকিৎসার সুযোগ, ঠিকমতো থাকার জায়গা, সুরক্ষামূলক পোশাক পায়না। অথচ Inter State Migrant workers Act 1979-তে এদের ন্যূনতম মজুরি, আবাসন, চিকিৎসা, দুর্ঘটনাজনিত বিমা ইত্যাদি নানাবিধ সুযোগ সুবিধা বাধ্যতামূলকভাবে পাবার কথা বলা আছে। কিন্তু কেরালা বাদে কেন্দ্র ও কোনো রাজ্য সরকার এই আইনকে কোনো মান্যতা দেয় না। আর আমাদের বর্তমান রাজ্য সরকারেরও কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই আমাদের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যাপারে কেন্দ্র বা অন্য রাজ্যের সাথে কথা বলার। একমাত্র বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যাপারে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ও তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। এছাড়া আমাদের রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ সংখ্যালঘু। অনেক বিজেপি শাসিত রাজ্যে এদেরকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে নানারকম অত্যাচার করা হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে আমাদের রাজ্যের শাসকদলের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা একটি উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। করোনার সময় পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন বাড়ি ফিরতে পারছেন না, শুধুমাত্র বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের অক্লান্ত চেষ্টায় তারা যখন কোনোরকম ট্রেনে করে পশ্চিমবঙ্গে ফিরছেন, এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন ট্রেনগুলিকে ‘‘করোনা এক্সপেস’’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন - আপনাদের তা মনে থাকার কথা। একমাত্র বামপন্থী শাসিত কেরালা রাজ্য এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘অতিথি শ্রমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং তাদের সমস্তরকম সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করেছে।

।। চার ।।

এটাই প্রকৃত অবস্থা এখন বাংলার গ্রামগুলির। কাজহীন গ্রামের যুবকেরা অন্যত্র চলে যাওয়াতে নিদ্রাহীন আতঙ্কের মধ্যে দিনগুজরান করছেন বাড়ির বয়স্ক, নারী ও শিশুরা। বামফ্রন্টের আমলে বাংলার গ্রামের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই গ্রাম বাংলা আজকে ধুঁকছে। এখন এই রাজ্যের গ্রামের মানুষ ভাতা চায় না, কাজ চায়। যাতে তার বাড়ির মানুষটি আবার বাড়ি ফিরে আসতে পারে। গ্রামের মানুষ আজও মনে করে দয়ার দানে বেঁচে থাকার চেয়ে কাজ করে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা অনেক গর্বের। তাই আবার মানুষ জাগছে। আবার মানুষ তৈরি হচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।