৬০ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১১ ফাল্গুন, ১৪২৯
পথ দেখাচ্ছে স্তালিনগ্রাদ
অর্ণব ভট্টাচার্য
১৬ জুলাই, ১৯৪১। যুদ্ধ চলাকালীন জার্মান সৈন্যদের হাতে বন্দি হলেন জোসেফ স্তালিনের পুত্র ইয়াকভ জুগাশভিলি। সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধারের পুত্রকে বন্দি করতে পেরে তখন উচ্ছ্বসিত নাৎসি বাহিনী। ইয়াকভের ছবি ব্যবহার করে লিফলেট বিলি করা হলো লাল ফৌজকে হতোদ্যম করার জন্য, তবে তাতে কাজ হলো না। ইয়াকভকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো জার্মানির ওরানিয়েনবুর্গ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।
এরপরের ঘটনা ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। স্তালিনগ্রাদের মরণপণ লড়াইয়ে নাৎসিরা পর্যুদস্ত হওয়ার পর লাল ফৌজের কাছে ৯১ হাজার সৈন্য সমেত আত্মসমর্পণ করলেন নাৎসি বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল পাউলাস। শেষ চেষ্টা হিসেবে হিটলার প্রস্তাব দিলেন পাউলাসকে মুক্তি দিলে স্তালিনের ছেলেকেও মুক্তি দেওয়া হবে। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন স্তালিন। বললেন, ‘‘সমস্ত সোভিয়েত যুদ্ধ বন্দি আমার সন্তান। পাউলাসের বদলে তাদের সকলকে কি মুক্তি দেওয়া হবে?’’ এরপর ইয়াকভকে গুলি করে মারে নাৎসিরা। সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে নিজের দেশ ও দুনিয়ার অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করতে রাজি হননি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ প্রশাসক স্তালিন।
নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের এমন আত্মোৎসর্গের অসংখ্য নজির রয়েছে যেখানে সর্বাধিনায়ক স্তালিন থেকে শুরু করে কাজাকস্তানের কৃষক পরিবারের সন্তান সকলেই শামিল। তাই দু’ কোটি প্রাণের বিনিময়ে বার্লিনে লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকে নাৎসি আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্বোত্তম বিজয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ। সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধে লাল ফৌজ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের বিজয়ের আট দশক পূর্তি হলো এই বছর।
বর্তমান বিশ্বে দক্ষিণপন্থী শক্তি বিশেষত উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিস্ত মনোভাবাপন্ন শক্তির নবরূপে উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আজ থেকে আশি বছর আগে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক বিজয় আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমি ঐতিহাসিকরা ফ্যাসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভূমিকার কথা সযত্নে এড়িয়ে যান। জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতা লাভ করবার পরেই শ্রমিক শ্রেণি ও জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে চরম দমনপীড়নের নীতি গ্রহণ করেছিল এবং তীব্র জাতিবিদ্বেষ প্রচার করবার মাধ্যমে ভয়ংকর স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিষ্ঠা করেছিল। হিটলারকে একনায়ক হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল দেশি-বিদেশি করপোরেট সংস্থা। হিটলারের চরম কমিউনিস্ট বিদ্বেষকে কাজে লাগাতে চাইতো ব্রিটেন,ফ্রান্স ও আমেরিকা। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে জার্মানি অস্ট্রিয়া দখল করে নেওয়ার পর ওই বছর ২৯ সেপ্টেম্বর চেকোস্লোভাকিয়ার বেশ কিছু অংশ জার্মানিকে তুলে দেওয়ার জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির প্রতিনিধিরা মিউনিখে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যা ইয়োরোপের পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। ১৯৩৯ সালের মার্চে চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেয় হিটলার। রক্তের স্বাদ পাওয়া নাৎসি বাহিনী এবার সারা বিশ্বকে পদানত করবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এরপর সাম্রাজ্যবাদীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরিণতিতে ওই বছর ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যা ছ’ বছর ধরে বিশ্বের বুকে এক বিভীষিকা নামিয়ে আনে।
হিটলার তার ‘‘মাইন কাম্পফ’’ বইয়ে খোলাখুলি ঘোষণা করেছিলেনঃ ‘‘ইয়োরোপে সমস্ত ভূখণ্ড প্রাপ্তির কথা উঠলে এটাই বলব যে, তা প্রধানত পেতে হবে রাশিয়ার কাছ থেকে। এমতাবস্থায় নতুন জার্মান সাম্রাজ্যকে আবার সেই পথেই অভিযান করতে হবে যে পথটি বহুকাল আগে গড়ে দিয়ে গেছিলেন টিউটনিক নাইটরা।’’ বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে দখল করে ‘‘কমিউনিস্ট বিপদ’’কে ধ্বংস করা ছিল ফ্যাসিস্তদের লক্ষ্য। অন্যদিকে ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্য মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সামরিক প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সরকারের অসহযোগিতার জন্য এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানির সামনে মিত্রহীন হিসেবে প্রতিপন্ন করাই ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য। এই চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্য স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রকৃতপক্ষে এ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি কূটনৈতিক কৌশল যার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে সামরিক দিক দিয়ে আরেকটু প্রস্তুত করে নেওয়ার সুযোগ পায়। কারণ রাশিয়ার ওপর নাৎসি জার্মানির আক্রমণ ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা।
১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমগ্র পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে আক্রমণ শুরু করে জার্মান বাহিনী।এই বিদ্যুৎগতির আক্রমণ যা ‘‘অপারেশন বার্বারোসা’’ নামে পরিচিত ছিল, তাতে জার্মানি ও তার মিত্রশক্তির ১৯০টি ডিভিশন অংশগ্রহণ করে যাদের হাতে ছিল ৪,৩০০টি ট্যাঙ্ক, ৪৯৮০ টি বিমান সহ অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর সময়কালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য শত্রুপক্ষ আক্রমণ করার আগে পর্যন্ত সেই কাজ পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি। নাৎসি জার্মানির আকস্মিক আক্রমণের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে লাল ফৌজ। ১৯৪১ সালের ৫-৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত বাহিনীর পালটা আক্রমণ শুরু হয় ২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত রণাঙ্গনে। হিটলারের ধারণা ছিল যে, তার মস্কো বিজয় সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু মস্কোর উপকণ্ঠে সেই সময় লাল ফৌজ ও সোভিয়েত জনগণ বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে তা ছিল নাৎসি বাহিনীর কল্পনার অতীত। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করে দেয় যে, এই দেশ জার্মানির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।
এবার স্ট্র্যাটেজি বদলালো জার্মান বাহিনী। রাশিয়ার দক্ষিণ অংশে তেলের খনি, কয়লা খনি, উর্বর গমের খেতের উপর কবজা করে লাল ফৌজকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার কৌশল নিলো তারা। আর এই লক্ষ্যকে সফল করবার জন্য ভোলগা নদীর তীরে অবস্থিত শিল্পনগরী স্তালিনগ্রাদ দখল করতে অগ্রসর হলো জার্মান বাহিনী। ১৯৪২ সালের ১২ জুলাই শুরু হলো নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্তালিনগ্রাদের লড়াই। স্তালিনগ্রাদ রক্ষার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার, লালফৌজ ও জনগণ। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষার লড়াই চলে।
যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও সুপরিকল্পিতভাবে সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ১৯৪২ সালের ১৯ নভেম্বর আরও বেশি সংখ্যক অস্ত্র,ট্যাঙ্ক, বিমানের সাহায্যে পালটা আক্রমণ শুরু করে লাল ফৌজ। ফ্যাসিস্ট জার্মানির ৩ লক্ষ ৩০ হাজার সৈন্যকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে প্রত্যাঘাত শুরু হয়। স্তালিনগ্রাদ শহরে প্রতিটি রাস্তায়, অলি-গলিতে, ধ্বংসস্তূপের আড়াল থেকে ফ্যাসিস্তদের নিকেশ করার জন্য লড়াই করে লাল ফৌজ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সহ শহরের আমজনতা। শেষ পর্যন্ত ৯১ হাজার জার্মান সৈন্য ও অফিসার বন্দি হয়। কেবল স্তালিনগ্রাদের উপকণ্ঠের লড়াইয়ে মারা যায় ৮ লক্ষাধিক ফ্যাসিস্ত সেনা।
স্তালিনগ্রাদের লড়াই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-রাজনৈতিক ঘটনা। ২০০ দিন ধরে চলে স্তালিনগ্রাদের মহাযুদ্ধ। স্তালিনের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট স্তালিনগ্রাদের লড়াইকে ‘‘মহাকাব্যোচিত সংগ্রাম’’ বলে অভিহিত করেন। উইনস্টন চার্চিলও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ও মার্কিন প্রশাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর জন্য দক্ষিণপন্থী ইতিহাসবিদদের ব্যবহার করেছে। এই সমস্ত অপপ্রয়াস সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, স্তালিনগ্রাদে লালফৌজ ও রুশ জনগণের মরণপণ সংগ্রাম গোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিতে আমূল পরিবর্তন সূচিত করে এবং ফ্যাসিস্ট জার্মানির পতন ডেকে আনে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পর হতোদ্যম হয়ে যেতে থাকে ফ্যাসিস্ত শক্তি। ক্রমশ বার্লিনের দিকে এগোতে থাকে লাল ফৌজ। একটার পর একটা রণাঙ্গনে বিজয় অর্জন করে তারা। ফ্যাসিস্ত কবল থেকে শুধু সোভিয়েত ভূমি নয়, অন্যান্য দেশগুলিকেও মুক্ত করতে থাকে লালফৌজ। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল আতঙ্কিত হিটলার আত্মহত্যা করে। ২মে বার্লিনের পতন হয়।
স্তালিনগ্রাদের বিজয় কেবল লালফৌজের সামরিক দক্ষতা ও উন্নততর স্ট্র্যাটেজির জন্য ঘটেনি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমস্ত জাতির মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য যে প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছিল তা সৈনিক ও জনসাধারণকে যেকোনো মূল্যে মাতৃভূমিকে রক্ষার সংকল্পে বলীয়ান করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এই যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে জনযুদ্ধে পরিণত হয়। হিটলার ও তার বাহিনী কেবলমাত্র একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তাদের যে সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর কাছে এ ছিল অস্তিত্বের সংগ্রাম, যেখানে ফ্যাসিবাদ মানবতার শত্রু হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল। ফ্যাসিস্তদের নারকীয়তার যোগ্য জবাব দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ। আত্মসমর্পণ নয়, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে বার্তা দিয়েছিল স্তালিনগ্রাদ তা দৃপ্ত আশাবাদে উদ্বুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিটি মানুষকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট তাই স্তালিনগ্রাদের মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম। এই বিজয় কেবলমাত্র সামরিক জয়লাভ নয়, এই জয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের মতাদর্শগত বিজয় যা এখনও বিশ্বের দেশে দেশে স্বৈরাচার, শোষণ ও জাতি-ধর্মগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।