E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২৮ সংখ্যা / ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ / ১১ ফাল্গুন, ১৪২৯

পরিবেশ আলোচনা

ভারতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব -

অভিবাসন এবং উদ্বাস্তুর সমস্যা

তপন মিশ্র


ভারতে যে বিপুল সংখ্যায় মানুষের দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অভিবাসন (immigration) ঘটছে তার কারণ কী কেবল আর্থ-সামাজিক না এর পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনেরও কিছু প্রভাব রয়েছে? বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর সংকট উৎপাদিকা শক্তির অবনমন ঘটাচ্ছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে ভিত্তল হরি এবং তাঁর সহ-গবেষকরা এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, ভারতে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে প্রায় ৪৫.৫ কোটি মানুষ বিভিন্ন সময়ে হয় পরিযায়ী হিসাবে বা উদ্বাস্তু হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ রয়েছেন গ্রামীণ এলাকার। এই অভিবাসী (immigrants)-দের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের জলবায়ু সংকটজনিত কারণে এবং উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের মতো নিম্ন আয়ের রাজ্যগুলি থেকে স্থানান্তর ঘটেছে। অথচ এই উত্তরের রাজ্যগুলি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নিবিড় কৃষি অঞ্চল অর্থাৎ গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। গবেষকরা বলছেন, ভারতে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির বৃদ্ধি যেমন খরা এবং বন্যা, তাপপ্রবাহ এবং ঘুর্ণিঝড়ের পরিমাণ ও তীব্রতার বৃদ্ধি প্রভৃতি জনগণের স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করছে। কারণ দেশের সবচেয়ে দরিদ্ররা এই কারণগুলির জন্য তাদের বাড়িঘর, জমি এবং জীবিকা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অধিকাংশ মানুষকে অভিবাসনে বাধ্য করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করে। প্রথমটি হলো ‘পুল ফ্যাক্টর’ অর্থাৎ অন্য জায়গায় বেশি মজুরি, কাজের সুযোগ, ভাল চিকিৎসা এবং শিক্ষার সুযোগ। দ্বিতীয়টি হলো, তাঁদের নিজেদের বাসস্থানের জায়গা থেকে যে ‘পুশ ফ্যাক্টর’ কাজ করে। সেগুলি হলো - খরা বা বন্যার কারণে ক্ষতি, স্বল্প মজুরি, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের সুযোগের অভাব ইত্যাদি।

আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে অভিযোজনের (climate adaptation) ব্যবস্থা থাকা দরকার তা নেই বললে চলে। এলাকাগতভাবে কৃষিক্ষেত্রে খরা, বন্যা, ঘুর্ণিঝড় বা অন্যান্য খারাপ আবহাওয়া ইত্যাদির কারণে যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে বিমার মাধ্যমে কিছু অনুদানের ব্যবস্থা থাকলেও তা অপ্রতুল এবং স্বল্পকালীন। কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে বিপদের মোকাবিলা করতে হয় তা দীর্ঘকালীন। আমাদের রাজ্যে আয়লার ক্ষত এখনও শুকায়নি। মানুষ এবং পরিবেশের মিথষ্ক্রিয়া-মূল্যায়ন সংক্রান্ত কোনো সমীক্ষা আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। এলাকাভিত্তিক হাইড্রো-মেটিরিওলজিক্যাল তথ্য সংগ্রহ এবং তার বিশ্লেষণের অভাব মানুষকে বিপদের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এক বড়ো সময়ের ব্যবধানে কৃষি বা অন্যান্য উৎপাদন ক্ষেত্রে কি কি পরিবর্তন আনা দরকার সে সম্পর্কে আমাদের সরকার একেবারেই উদাসীন।

নিঃশেষিত হচ্ছে জলের ভাণ্ডার

আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ‘নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ’ পত্রিকায় তিব্বতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মালভূমি অঞ্চলের মিঠা জলের ঘাটতি সম্পর্কিত একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ সম্পর্কিত আমাদের সিদ্ধান্তহীনতার অভাবকেই জলের ঘাটতির মূল কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয় ওই প্রবন্ধে। প্রবন্ধটির নাম ‘Climate change threatens terrestrial water storage over the Tibetan Plateau’ এবং এর লেখক আমেরিকার পেনস্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মাইকেল মান (Michael Mann)। প্রবন্ধে লেখক বলেছেনঃ “ফসিল জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বন নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ভবিষ্যতে তিব্বতের মালভূমি অঞ্চলের নিম্ন ধারায় মিষ্টি জলের প্রবাহ প্রায় শূন্য হয়ে যাবে।” চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলজিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ডি লং তাঁর গবেষণার ফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তিব্বত মালভূমি প্রায় ২০০ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় জলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করে। একারণে এই অঞ্চলকে ‘ওয়াটার টাওয়ার’ও বলা হয়। এই অঞ্চল জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষকরা জলের রিজার্ভ পরিমাপ করার জন্য ২টি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। প্রথমটি হলো উপগ্রহ-ভিত্তিক এবং দ্বিতীয়টি উক্ত অঞ্চলে সরাসরি হিমবাহ, হ্রদ এবং মাটির নিচের জলস্তরের উৎসগুলিতে জলের পরিমাণ করার মধ্যদিয়ে। এই সঞ্চিত জলের পরিমাপের সঙ্গে জলবায়ুর যে পরিবর্তনশীল শর্তগুলি যেমন বায়ুর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, মেঘের আচ্ছাদন এবং সূর্যালোকের তীব্রতার পরিবর্তনগুলির তথ্যও বিশ্লেষণের জন্য তাঁরা ব্যবহার করেন।

ইন্দো-গাঙ্গেয় অঞ্চলের বেদনা

দক্ষিণ এশিয়ায় সবথেকে বেশি কৃষি নিবিড় অঞ্চল হলো ভারতের ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি। এই অঞ্চলের বহিরাগমন (Out migration) স্থায়ী এবং সাময়িক - উভয় প্রকৃতির। অবশ্য এটা প্রমাণিত সত্য যে, এই অঞ্চলে স্থায়ী বহিরাগমনের তুলনায় সাময়িক বহিরাগমন অনেকটা বেশি। প্রধানত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ এবং যাঁরা প্রাথমিকভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল তাঁদের মধ্যে পরিযানের ঝুঁকি অনেক বেশি। অথচ এই অঞ্চলটি ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং এখানে প্রায় ৬৪ কোটি মানুষ বাস করেন যাদের মধ্যে অধিকাংশেরই দারিদ্র্য নিত্যদিনের সাথী। সাম্প্রতিক দশকে এই অঞ্চলগুলি থেকে অভিবাসনের গতি তীব্র হয়েছে এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে (FAO, 2019)।

২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে রাজ্যগুলি থেকে প্রধান অভিবাসন ঘটেছে সেগুলি হলো বিহার এবং উত্তর প্রদেশ; এবং যে শহরগুলিতে এই অভিবাসন ঘটেছে সেগুলি হলো, দিল্লি এবং মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, পুনার মতো কয়েকটি শহরে। ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ‘স্টেট অফ ইন্ডিয়া এনভায়রনমেন্ট ২০২২’-এ লেখা হয়েছে, কেবল ২০২০-২১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষ আবহাওয়াঘটিত দুর্যোগের জন্য তাঁদের ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৯-২০ সালে প্রকাশিত ভারত সরকারের ক্লাইমেট ভারনারাবিলিটি ইনডেক্স (CVI) বলছে যে, পূর্ব ভারতে ৫৯ শতাংশ জেলা এবং পশ্চিম ভারতে ৪১ শতাংশ জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তালিকায় আছে। এই কারণে গাঙ্গেয় সমতল অঞ্চলের উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে একদিকে যেমন অভিবাসন বৃদ্ধি পাবে তেমনই শিশু ও কিশোর-কিশোরী পাচার বৃদ্ধি পাবে।

বড়ো শহরে ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে

একটি বৈপরীত্য এখানে লক্ষণীয়। ইন্দো-গাঙ্গেয় অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের যে বহিরাগমন আমরা দেখতে পাই তা মূলত দেশের বড়ো শহরগুলির দিকে হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় এই অভিবাসনের পেছনে একটা কারণ সন্দেহ নেই। কিন্তু যে দিকে অভিবাসন ঘটছে তেমন কয়েকটি শহর যেমন কলকাতা, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু বা দিল্লির মতো শহরও জলবায়ু সমস্যায় জর্জরিত। এই ধরনের বড়ো শহরে কাজের জন্য অভিবাসন আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভজনক হতে পারে কিন্তু এই শহরগুলিকে বিভিন্ন সময়ে বিধ্বংসী বিপদ যেমন তাপপ্রবাহ এবং বন্যার সম্মুখীন হতে হয়।

বড়ো শহরগুলিতে স্থানান্তরিত হওয়ার একটি মুখ্য আর্থ-সামাজিক কারণ হলো সুনিশ্চিত জীবিকা। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে, এই উল্লেখিত প্রধান অভিবাসীগন্তব্য শহরগুলিতে এই অভিবাসিকদের ক্রমে একাধিক জলবায়ু সম্পর্কিত বিপদের মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। এই সমস্ত শহরে যেমন পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে তেমনই বছরে ২/৩ বার প্লাবনের সমস্যাও রয়েছে। তাপপ্রবাহ এবং বন্যা দুটি ভিন্ন কিন্তু সমানভাবে এই দুই বিধ্বংসী বিপদের মোকাবিলা করতে হলেও অভিবাসীরা বড়ো শহরে যেতে বাধ্য হন কারণ তাঁদের নিজস্ব গ্রামে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা তাদের যে ব্যাপক ক্ষতি করে, বড়ো শহরে তেমনটা হয় না।

দক্ষিণ এশিয়ায় অদূর ভবিষ্যতে মারাত্মক তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। প্রাক্ শিল্পায়নের যুগ থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি হলে তা দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রমজীবী মানুষের কর্মক্ষমতার উপর এক বড়মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এরসঙ্গে যুক্ত আছে জনস্বাস্থ্যের কয়েকটি গুরুতর বিপদ। মূলত, মেগাসিটিগুলির ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে অভিবাসীদের আগমনের কারণে তাপপ্রবাহের প্রভাবকে ভবিষ্যতে আরও বাড়িয়ে তুলবে। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লিতে পরপর বেশ কয়েক বছর ধরে রেকর্ড গ্রীষ্মের তাপমাত্রা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং একারণে হাসপাতালে ভরতি হওয়া মানুষের সংখ্যা এবং মৃত্যুর হারও ক্রমবর্ধমান। অভিবাসীদের ক্ষেত্রে শহুরে সমস্যাগুলি তাঁদের কাছে নতুন হওয়ার কারণে এঁদের উপর তাপপ্রবাহের সবচেয়ে বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে।

তরুল শর্মা এবং তাঁর সহ-গবেষকরা বলছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ধান এবং গম চাষের উপর। এই বিপদ ক্রমবর্ধমান। অবশ্য অন্য চাষের উপর যে কোনো প্রভাব পড়ে না, তা নয়। অনেক নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে প্রথমটি হলো, অভিবাসনের কারণে কৃষিশ্রমিকের অভাব। দ্বিতীয়টি আরও মারাত্মক, কারণ গমের ক্ষেত্রে ফসল বৃদ্ধির সময় যে তাপমাত্রা চাই তার থেকে বেশি তাপমাত্রা থাকার কারণে গমের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধানের ফলনের উপর এই প্রভাবটা ততটা অনুভূত না হলেও চরম আবহাওয়া অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য।

জলবায়ু পরিবর্তন-অভিযোজন এখন জরুরি

কেউ কেউ বলছেন, এই বিশাল সংখ্যায় অভিবাসন এক ধরনের অভিযোজন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই অভিযোজন অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য ভারসাম্যহানিকর। ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন প্লান’ তৈরি করেছে ঠিকই কিন্তু এ পর্যন্তই, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শস্যহানির ক্ষতিপূরণ, কৃষিক্ষেত্রে জলের ব্যবহারের পরিকল্পনা, ফসলের পর্যায়করণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সহনশীল শস্য উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। অভিবাসিকরা যেখানে আশ্রয় নিচ্ছেন সেখানে জীবন জীবিকার ন্যূনতম ব্যবস্থা ইত্যাদি নেই বললেই চলে। সরকার কোভিড অতিমারীর সময় কোটি কোটি মানুষের অভিবাসন থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি বা নিতে চায় না।

এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জাতীয়স্তরে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা গঠন করা জরুরি। রাজ্য সরকার, রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনগুলিকে যুক্ত করে জলবায়ুর প্রভাবগুলিকে জরুরিভাবে মোকাবিলা করার জন্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ এবং আর্থিক বরাদ্দ করা বর্তমান সময়ে অত্যন্ত জরুরি একটা কাজ।