৫৭ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ২৪ জুলাই ২০২০ / ৮ শ্রাবণ ১৪২৭
অপরিকল্পিত লকডাউনে সুরাহা হবে কি না সেটাই প্রশ্ন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ করোনা সংক্রমণ নিয়ে দিশেহারা রাজ্য সরকার অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ২০ জুলাই নবান্নে জানিয়ে দেন যে, রাজ্যের কিছু জায়গায় গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে লকডাউন নিয়ে ভোলবদল করে রাজ্যে এবার থেকে সপ্তাহে দু’দিন লকডাউন ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। সেই হিসেবে চলতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) এবং শনিবার (২৫ জুলাই) পুরোমাত্রায় লকডাউন হবে। পরের সপ্তাহে বাকি দিন ঠিক করতে ২৭ জুলাই বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্য সরকার। ২০ জুলাই রাজ্যে গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে স্বীকার করা হলেও ২২ জুলাই বিকেল পর্যন্ত সরকার জানায়নি কোন্ কোন্ এলাকায় বা অঞ্চলে গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটছে। এরফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে চলেছে। চিকিৎসকরাও প্রশ্ন তুলছেন।
২১ জুলাই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা যাচ্ছে, রাজ্যে মোট সংক্রমিত হয়েছেন ৪৪,৭৬৯। আর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১,১৪৭ জনের। এই প্রতিবেদন লেখার সময়ে গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২,৩০০ জন মানুষ রাজ্যে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের।
রাজ্যে এখন ৭৩৯টি কনটেইনমেন্ট জোন এলাকায় লকডাউন চলছে। কলকাতা মহানগরীতে এই জোনের সংখ্যা ৩২। এর আগে নবান্নে এক বৈঠকে রাজ্যে কনটেইনমেন্ট এলাকার তালিকা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি স্বয়ং প্রশাসনের দেওয়া তালিকা ছেঁটে দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বহীন আচরণের খেসারত দিয়ে এবার বর্ধিত কনটেইনমেন্ট জোনের সঙ্গে গোটা রাজ্যেই লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হলো সরকার।
সরকার ও প্রশাসনের এই খেয়ালখুশি মতো আচরণ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ২০ জুলাই সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেনঃ যেদিন খুশি লকডাউনের নামে রাজ্য সরকার যা করছে তা খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে কোনো বিজ্ঞান নেই, সংক্রমণ রোখার নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনাও এভাবে হয় না। এতে সাধারণ মানুষ আরও বিপদে পড়বেন। এর পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা - এ নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।
সূর্য মিশ্র বলেছেন, এভাবে হঠাৎ করে একেক দিন লকডাউন হলে মানুষ সমস্যায় পড়বেন। অনেক কর্মসূচিও এই সময়ে রয়েছে। তা কারও ব্যক্তিগত পারিবারিক হতে পারে, আবার রাজনৈতিক-সাংগঠনিক হতে পারে। জীবন-জীবিকার প্রশ্নে, জনস্বাস্থ্য, দুর্নীতি-লুট এসব নিয়ে মানুষ মুখ খুলছেন। দেশে এবং রাজ্যে জীবন নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, তার প্রতিবাদে মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন। সেই সময়েই এরকম হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণা। তাই এর পিছনে অন্য উদ্দেশ্য কী আছে সেটাই দেখতে হবে। এরকম খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে রাজ্যে সংক্রমণের দাপট ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর ঘটনা। রাজ্যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কোনো সদর্থক ভূমিকা দেখা যায়নি। ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। সরকারের চূড়ান্ত অপদার্থতা ও গাফিলতির ফলে ইতিমধ্যে তিন ছাত্র শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়, মনীষা দাস, অশোক রুইদাস সহ বেশ কয়েকজন মানুষের চিকিৎসার সুযোগের অভাবে মৃত্যু হয়েছে। রাজ্য সরকারের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচারে খামতি নেই। এদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়েও একধাপ এগিয়ে গত ১৯ জুলাই রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, করোনার চেয়েও রাজ্য সরকারের কাজের স্পিড বেশি। কিন্তু তার পরদিনই রাজ্যে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন প্রায় ২৩০০ জন। ঝাড়গ্রাম ছাড়া রাজ্যের ২২টি জেলা থেকেই এই সংক্রমণের খবর এসেছে।
রাজ্যে সংক্রমণের মাত্রা ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় চিন্তিত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক ‘কমপ্লিট লকডাউন’-এর পরামর্শ দিয়েছিল ১৭ জুলাই। সেই চিঠিতে রাজ্যে করোনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণও ছিল তার মধ্যে অন্যতম। তা সত্ত্বেও রাজ্যের মুখ্যসচিব ১৪ জুলাই নবান্ন থেকে জানিয়ে দেন, ব্যাপকভাবে লকডাউনের কোনো পরিস্থিতি এখনও আসেনি। সরকারের পরিকল্পনাও নেই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় তার দু’দিনের মধ্যেই রাজ্য সরকারকে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে হলো। এর মধ্য দিয়েই রাজ্য সরকারের দিশাহীন মনোভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
এ রাজ্যে এখন এটাই বাস্তব যে, প্রতিদিন যে হারে রোগী বাড়ছে তাতে সকলের চিকিৎসা ও ভর্তির সুযোগ নেই। একের পর এক বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনায় এই বাস্তবতাই প্রকট হয়েছে যে, সরকার কোনো দায় নেবে না। আক্রান্ত মানুষকে বাড়িতেই মৃত্যু মুখে চলে যেতে হবে। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর চটকদারি বুলি, বাগাড়ম্বর থামছে না। তিনি এমনভাবে বক্তব্য হাজির করছেন, তাতে মনে হবে যেন তিনিই একমাত্র মুশকিল আসান। এছাড়াও অবিমৃশ্যকারি-অমানবিক মন্তব্যও তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, রোগীরা নাকি সুস্থ হলেও বাড়ি যাচ্ছেন না। বেড আঁকড়ে থাকছেন। ২১ জুলাই দলীয় সভায় তিনি বলেছেন রাজ্যে নাকি ১৮ হাজার কোভিড বেডের ব্যবস্থা হয়েছে। এ নিয়ে রাজ্যবাসী অনেকের মনেই বিস্ময় তৈরি হয়েছে। আসলে প্রয়োজনীয় বেড বা চিকিৎসার ব্যবস্থা রাজ্যে না থাকায় তিনি অবলীলায় রোগীদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। অন্যদিকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে দোষ চাপাচ্ছেন কেন্দ্রের ওপর। এর আগে তিনি এমনও মন্তব্য করেছিলেন যে, করোনাকে পাশ বালিশ করে নিন। অর্থাৎ তাঁর কথায় করোনাকে প্রতিরোধ করা নয়। করোনাকে নিয়েই ঘরে করতে হবে। রাজ্যে এখন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, করোনায় মৃত্যু হলে তথ্য গোপন করা ইত্যাদি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের এমন অবিবেচক, সংবেদনহীন, দিশাহীন কার্যকলাপের পরিণতিতে যে কী অবস্থা হতে পারে তা বর্তমান রাজ্যের পরিস্থিতিই জানান দিচ্ছে।