৫৭ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ২৪ জুলাই ২০২০ / ৮ শ্রাবণ ১৪২৭
অনলাইন শিক্ষা নির্ভরতা শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত করবে
সেখ সাইদুল হক
বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা বিষয়টি সারাদেশের সাথে আমাদের রাজ্যেও ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে। করোনাজনিত সর্তকতার কারণে দেশের ১৫ লক্ষাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ঘরে বসে ২৫ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী। এদের বৃহৎ অংশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে-পড়া পরিবারের। আমাদের বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রটি বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্ববৃহৎ। ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রাথমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর ১৮.৩ শতাংশ ভারতে। মাধ্যমিকস্তরের ক্ষেত্রে এই হার ২০ শতাংশ। ডাইস রিপোর্ট অনুযায়ী সারা দেশের কমবেশি ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার বিদ্যালয়ে ২০ কোটির বেশি ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে। এর মধ্যে ১১ লক্ষ সরকারি বা সরকারপোষিত বিদ্যালয়, যেখানে প্রায় ১৫ কোটি শিক্ষার্থী। বাকি সাড়ে তিনলক্ষ ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যালয়। যেখানে প্রায় ৫ কোটি ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে সারা দেশে ৭৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় ৪২ হাজার মহাবিদ্যালয় এবং ১২ হাজারের মতো প্রযুক্তি, কারিগরি বা ওই ধরনের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। সব মিলিয়ে উচ্চ শিক্ষায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটির বেশি ছেলেমেয়ে পড়াশুনা করে। করোনাজনিত কারণে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা বন্ধ আছে। আর তাই অনলাইনে শিক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছে। এবং এর প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এবং চাহিদা বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় তাই অভিভাবকদের ও শিক্ষার্থীদের এই আবেগটিকে বিবেচনার মধ্যে রেখে অনলাইন শিক্ষার ক্ষেত্রটিকে পর্যালোচনা করতে হবে এবং ব্যাখ্যা করতে হবে কেন সরকার এবং ব্যক্তি মালিকেরা এই ব্যবস্থাকে বর্তমানে আপৎকালীন হিসাবে না দেখে একে স্থায়ী রূপ দিতে চাইছে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রটিকে বাজারের উপর ছেড়ে দিতে চাইছে। প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে তার প্রতিফলন দেখা গেছে।
বহু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই অনলাইন শিক্ষা চালু করে দিয়েছে। সরকারও চাইছে অনলাইন পড়াশুনা চালু রাখা। আমরা অনলাইন প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু তার উপরই নির্ভরতার পক্ষে নয়। কেন না অনলাইন শিক্ষা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিকল্প বা পরিপূরক হতে পারে না। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদানপ্রদান, পারস্পরিক সম্পর্ক ভাবনা-চিন্তার এবং মনের পরিধিকে শুধু বিস্তৃত করে না, তা সংস্কৃতি, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, মানবিকতাবোধকে বিস্তৃত করে। সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ে এবং বহুত্ববাদের ধারণাকে গ্রথিত করে। কোঠারি কমিশন বলেছে শ্রেণিকক্ষ পাঠদানের কোনো বিকল্প নেই। সব ধর্মের, বর্ণের, জাতের, অর্থনৈতিক বর্গের শিক্ষার্থীদের মিলনক্ষেত্র শ্রেণিকক্ষ। মিনি ভারত। শ্রেণিকক্ষেই ভবিষ্যৎ ভারত রচিত হয়, অথচ এখন এমন প্রচার চলছে যে, অনলাইন-পাঠদান শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের একমাত্র বিকল্প ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। এতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত হবে এবং শিক্ষায় বৈষম্য বাড়বে।
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি
এটা নয় যে করোনাজনিত কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেহেতু দীর্ঘ দিন বন্ধ আছে তাই অনলাইন শিক্ষাকে চালু করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। কার্যত করোনা প্রাদুর্ভাবের বহু পূর্ব হতেই সরকার অনলাইন শিক্ষার কথা বলেছে এবং তার উপর জোর দিতে চেয়েছে। আমরা যদি প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিকে ব্যাখ্যা করি তাহলে দেখতে পাব ওই শিক্ষানীতিতে বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অনলাইন পদ্ধতির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে মাধ্যমিককে (IX –X) ও উচ্চমাধ্যমিক (XI-XII) স্তরে কোনো বোর্ড পরীক্ষা হবে না। National Testing Agency মডেলে ৪টি শ্রেণিতে ছয় মাস অন্তর ৮টি সেমেস্টার হবে। একটি উচ্চ বিদ্যালয়কে নিয়ে তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধে যত ধরনের সরকারি বিদ্যালয় আছে তাদের নিয়ে বিদ্যালয় কমপ্লেক্স হবে। ত্রিভাষা সূত্র লাগু করা হবে। এখানেই বলা হয়েছে বিদ্যালয়স্তরের দীক্ষা প্রকল্প চালু হবে। এই দীক্ষা প্রকল্প হলো প্রধানমন্ত্রীর ই-লার্নিং কর্মসূচি অর্থাৎ On line digital Education। বলা হয়েছে, বিদ্যালয়স্তরের পাঠক্রম পরিবর্তন হবে। ২০০৫-র জাতীয় পাঠক্রমকে যুগোপযোগী করে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা অর্থাৎ বৈদিকদর্শন, বৈদিক গণিত, বৈদিক যোগ শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হবে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তিন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে: (১) Research Type University, (2) Teaching University, (3) Autonomous College। অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ থাকবে না। নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হবে অথবা নিজেরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। অটোনমাস কলেজগুলি নিজেরা ডিগ্রি দিতে পারে। শিক্ষকশিক্ষণকে যুক্ত করে স্নাতক স্তর চার বছরের হবে। শিক্ষাসূচি হবে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি। লিবারেল আর্টস কলেজ গড়ে তোলা হবে। এখানেই বলা হয়েছে MOOC (Massive Open Online Course) চালু করা হবে। আর শিক্ষার এই সামগ্রিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত আরএসএ বা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা নিয়ন্ত্রক। প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষা নীতি দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ (Commercialisation), কেন্দ্রীকরণ (Centralisation) এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ (Communalisation)-এর ভিতের উপর। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও ক্যাট চুক্তি শর্ত মোতাবেক শিক্ষানীতি রচিত হয়েছে।
কোন্ পটভূমিতে অনলাইন শিক্ষা
অনলাইন লার্নিং-র কথা প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিদ্যালয় স্তর ও উচ্চ শিক্ষাস্তর উভয়ক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে। এই শিক্ষা নীতি নিয়ে সঙ্গতভাবে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এবং এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে জনমত জোরালো হচ্ছে। শিক্ষার দাবি জাতীয় দাবি। শিক্ষা এখন মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। অথচ সেই শিক্ষাতে এখন সরকার দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। শিক্ষায় জিডিপি’র ৬ শতাংশ বা বাজেটের ১০ শতাংশ সরকার কখনও ব্যয় করেনি। Mid Day Meal-এর অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। সরকার চাইছে তার উদারীকরণ নীতির লক্ষ্য হিসাবে শিক্ষাকে বেসরকারি ক্ষেত্রে ছেড়ে দেওয়া। আমাদের দেশের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ দেশের ৫০ শতাংশ সম্পত্তির মালিক। ১০ শতাংশ সবচেয়ে ধনী ৭৩ শতাংশ সম্পত্তির মালিক। সেন্টার অব মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে লকডাউনের আগেই বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে। লক ডাউনের পর তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন শিক্ষিত বেকার। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১০ কোটির বেশি। প্রায় ১২ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক চরম দুর্দশার মধ্যে আছেন। অক্সফাম রিপোর্ট বলছে ৬ লক্ষ কোটির বেশির NPA অর্থাৎ তামাদি বা খেলাপিঋণ, যার সিংহভাগই সব বড়ো ধনীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২৮জন বেনিয়া ১০ লক্ষ কোটি লুট করে পালিয়েছে। কৃষিক্ষেত্র সঙ্কটে। আর কৃষিক্ষেত্রে ৩টি নতুন অধ্যাদেশ লক ডাউনের মধ্যেই এনেছে। এতে চুক্তি চাষ বাড়বে। কৃষিব্যবস্থা চলে যাবে কর্পোরেটদের হাতে। ১৫-১৬ সালের কৃষি সেন্সাসে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রান্তিক চাষির সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪৩ শতাংশ মানুষ যুক্ত। কৃষির এই দুর্দশার ফলে কৃষক সমাজের ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষা বিলাসিতায় পর্যবসিত হবে। তারা ছিটকে যাবে। অথচ দেশের ৬৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গ্রামীণ শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। ৪১টি কয়লা খনি, রেল সহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বিক্রি করতে সরকার বদ্ধপরিকর। ব্যাঙ্ক, বিমা, বিমানবন্দর বেসরকারি হাতে দিতে তৈরি। একই লক্ষ্য শিক্ষাক্ষেত্রে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে, আর দৃষ্টি ফেরাতে বালাকোট, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, কাশ্মীর ৩৭০, NRC, NPR, CAA। এখন চীন নিয়ে পড়েছে। উগ্রজাতীয়তা গড়ে তোলা হচ্ছে। এই পটভূমিতে অনলাইন শিক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
কেন অনলাইন শিক্ষা?
সরকার যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করতে চাইছে না, তেমনি বড়ো কর্পোরেট বিনিয়োগকারীরা শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তারা চাইছে শিক্ষার বাজার কবে দখল করে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা করা। এই জন্যই তারা (Massive Open Online Course-এর উপর জোর দিচ্ছে)। ব্যাপকভাবে অনলাইন কোর্স চালু করতে পারলে এবং সেই ভিত্তিতে নিজেরা ডিগ্রি দিতে পারলে তাদের শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যে মুনাফার পথ প্রশস্ত হবে। জমি কিনতে হলো না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ করতে হলো না, চেয়ার-বেঞ্চ লাগবে না। ল্যাবরেটরি বানাতে হবে না। একটা অফিস। কিছু কম্পিউটার এবং চুক্তিভিত্তিক কিছু বিষয়ে শিক্ষক। আর সরকারের মান্যতা নিয়ে সার্টিফিকেট বিক্রি। শিক্ষায় পণ্যকরণ এর চেয়ে আর কি হতে পারে। সরকার এটাই চাইছে। নয়া-উদারবাদের পথ ধরে বাজারমুখী শিক্ষা। ফলে সরকার তিন ধরনের আক্রমণ শিক্ষার উপর নামিয়ে আনছে: (১) কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, (২) শিক্ষার উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকে বাড়াতে শিক্ষার কেন্দ্রীয়করণ, (৩) পাঠ্যসূচিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তিকরণ - যাতে উগ্রজাতীয় ভাবাবেগ গড়ে তোলা যায় এবং সহমর্মিতা, মানবিকতা ও সম্প্রীতি বোধকে বিনষ্ট করা যায়। এই জন্যই শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষায় জোর। যাতে শিক্ষার্থীরা সমষ্টি চেতনা অপেক্ষা ব্যক্তি এককে পরিণত হয়। ব্যক্তি আমির ভাবনা মন্ত্রে দীক্ষিত হয়।
রাজ্যে শিক্ষা
রাজ্যে এখন শিক্ষায় নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, দলীয় নিয়ন্ত্রণ, দিদিতন্ত্র, গণটোকাটুকি, ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি, পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতি, টেট কেলেঙ্কারি, এসএসসি না হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অর্থাৎ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা। এর মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকার চায় বেসরকারিকরণের গণভিত্তিকে গড়ে তোলা। সারা দেশের সাথে আমাদের রাজ্যে বিদ্যালয় ছুট ও শিশু শ্রম এবং নারীদের প্রতি বঞ্চনা ক্রমবর্ধমান। আমাদের রাজ্যে শিক্ষা নিয়ে সরকারের না আছে কোনো নীতি না আছে কোনো পরিকল্পনা।
অনলাইন শিক্ষার হাল হকিকৎ
এই পটভূমিতে সারা দেশে ও আমাদের রাজ্যে On line learning বিষয়টি ভাবতে হবে। UGC–Classroom Teaching 75 শতাংশ+online teaching 25 শতাংশ হবে লক ডাউনের আগেই বলেছে। AICTE professional এবং technical course বিষয়গুলি শিক্ষার্থীদের ওপর Online-এর মাধ্যমে দিতে চাইছে। Online teaching কারা নিতে পারবে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে। Computer or Smart Phone বা Android আছে। National Statistics Authority জাতীয় নমুনা সমীক্ষা করে দেখিয়েছে, শহরে মাত্র ২৩.৪ শতাংশ এবং গ্রামে মাত্র ৪.৪ শতাংশ মানুষের কম্পিউটার আছে। Internet সুবিধা ভারতে মাত্র ২৩.৮ শতাংশ (শহরে ৪২ শতাংশ, গ্রামে ১৪.৯ শতাংশ)। ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করেছে জনসংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশ, (পুরুষ ২৫ শতাংশ, মহিলা ১৫ শতাংশ)। আমাদের দেশের সাক্ষরতার হার ৭৭ শতাংশ, নারী সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ। স্কুল ছুটের হার প্রাথমিকে ১০ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৩৩ শতাংশ। তাহলে কোন্টা অগ্রাধিকার পাবে? শিক্ষার সম্প্রসারণ বা শিক্ষার সংকোচন। অনলাইন নির্ভর শিক্ষার সংকোচন বাড়াবে। কোয়াক্যেরেলি সাইমন্ডস নামক লন্ডনের কোম্পানি সম্প্রতি ভারতে অনলাইন শিক্ষা নিয়ে সমীক্ষা করেছে ৭৬০০ জনের মধ্যে। ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করছে হটস্পট থেকে ইন্টারনেট ধার নিয়ে। তবু সিগন্যাল, নেটওয়ার্ক সমস্যা। বাকিরা ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই হতে। হাল তথৈবচ। যে অ্যাপ্লিকেশন বা Online platform-অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্লাস হচ্ছে তার ডেটা ব্যয় প্রচুর, নেট ব্যবহারের খরচ বেশি। বহু শিক্ষক, শিক্ষার্থী অনলাইন কায়দা কানুনে ঠিক মতো অভ্যস্ত নন। All India Institute of Hygienic and Public Health সমীক্ষা করেছে, কলকাতা বা তার কাছাকাছি ভাল ৫টি কলেজের ২০৮৮ জন পড়ুয়াকে নিয়ে। যারা অনলাইন শিক্ষা নিচ্ছে তাদের মধ্যে দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যার কথা বলছে ৭৮ শতাংশ। ১৪ শতাংশ পড়ুয়ার টাকা নেই। ৮ শতাংশ ঠিকমতো Follow করতে পারে না। কেননা তাদের কোনো Digital Literacy নেই। বর্তমানে সারা দেশে ৪০ শতাংশ বিদ্যালয়ে কোনো রান্নাঘর নেই। ৬.৫ মিলিয়ন শিশুর জন্য কোনো বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই। ১ লক্ষ ৫ হাজার বিদ্যালয়ে ১ জন শিক্ষক। এগুলির কি হবে? শিক্ষার বরাদ্দ বৃদ্ধি ও শিক্ষার সর্বজনীন করার কি হবে? কে দায়িত্ব নেবে? কর্পোরেট সে দায়িত্ব নেবে না। আর সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে।
সম্প্রতি রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের পুস্তিকা Education First-এ রাজ্য সরকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কি ব্যবস্থা করেছে তার সাফল্য খতিয়ান দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে সেটা কি সফল? কারা উপকৃত? এ বিষয়ে একটি বাংলা দৈনিক গত ৬ জুলাই একটি রিপোর্ট বের করেছে। ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে: (১) প্রত্যন্ত এলাকায় অধিকাংশ পুড়ুয়া অনলাইনে শিক্ষার সুফল পাচ্ছে না। (২) শহরাঞ্চলের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা কেবল উপকৃত হচ্ছে। (৩) অনলাইন পাঠে সঙ্কটে মধ্যমানের পড়ুয়ারা। (৪) জঙ্গলমহলের স্কুলগুলি অনলাইন ক্লাস হতে বঞ্চিত।
অপরদিকে লক ডাউন পিরিয়ডে দেখা যাচ্ছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলি ইচ্ছামতো ফি বাড়াচ্ছে। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত যারা বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করিয়েছিলেন তারা সমস্যায় পড়ছেন। ফলে Online class-এ বৈষম্য আসছে শিক্ষায়। বৈষম্য আগেই ছিল। এখন তা আরও প্রকট হচ্ছে। পুনরায় All India Institute of Hygienic and Public Health সমীক্ষা উল্লেখ করছি। ওই সমীক্ষা বলছে ৫২ শতাংশ পড়ুয়া অনলাইন পড়াশুনায় খুশি নয়। ৭৪ শতাংশ পড়ুয়া পাঠক্রম শেষ হবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত। ৬০ শতাংশ চিন্তায় আছে পারিবারিক আর্থিক অবস্থা নিয়ে। শহর ও শহরতলির যে সব পড়ুয়া সমীক্ষার আওতায় ছিলেন তাদের পরিবারগুলির ৪০ শতাংশের সংসার চলে নিয়মিত বেতনে। ৪৫ শতাংশ পরিবারের ব্যবসা আছে। মাত্র ১৫ শতাংশ পরিবার শ্রমজীবী। নিয়মিত বেতন পান এমন ৪০ শতাংশের মধ্যে ১০শতাংশ কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে অথচ নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না ১৩ শতাংশ পরিবার। চাকরি থাকলেও কম বেতন পাচ্ছেন ১৭ শতাংশ পরিবার। যে ৪৫ শতাংশ পরিবারের ব্যবসা আছে তাদের ৪২ শতাংশের ব্যবসা মার খাচ্ছে আর ১৮ শতাংশ মাসে ৭৫০০ টাকা বা তার কম রোজগার করেন।
কি করণীয়
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? কারা অনলাইন টিচিং-এর সুযোগ পাচ্ছে? যাদের ভালো আর্থিক সংস্থান আছে। এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ শতাংশের মতো। বাকিদের কি হবে? লক ডাউনে অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক এবং কিছু সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক এখন কর্মহীন। এদের খাবার সংস্থান নেই। বেঁচে থাকার রসদ নেই। তাহলে কি হবে এদের সন্তানদের শিক্ষা? এরা অনলাইন শিক্ষার ব্যয়বহন করতে পারবে? তারা কোথায় পাবে অর্থ? এদের বেশিরভাগ দলিত আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অংশের জনগণ। এখন তো Survival of the Fittest নয়। Survival of the Richest। ফলে শিক্ষায় শ্রেণিবৈষম্য যেমন বাড়বে তেমনি জাতিবৈষম্যও বাড়বে। তাই দরকার দারিদ্র্য মোচন কর্মসূচিগুলিকে ওই সব পরিবারের জন্য সুনিশ্চিত করা। কর্মসূচিগুলি রূপায়ণে মধ্যস্বত্বভোগীদের কমিশন নেওয়া তোলাবাজদের হঠানো। মিড-ডে-মিল প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়িয়ে তার সঠিক রূপায়ণ। শিক্ষার বরাদ্দ বাড়ানো। শিক্ষার জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। এ কাজ কর্পোরেট করবে না। সরকারকেই এই দায় নিতে হবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দরিদ্র পরিবারের সব পিতামাতাই চান তাদের ছেলেমেয়েরা অন্তত অষ্টম মানের শিক্ষা সমাপ্ত করুক। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সব শিশুর শিক্ষা দেবার দায় সরকারের। শিক্ষার অধিকার বিল ২০১০-এর এপ্রিল হতে লাগু হয়েছে। ১০ বছর হলো। কার্যকর কি হয়েছে? হয়নি। বরং শিক্ষার দ্বৈত ধারা আরও প্রশস্ত হয়েছে। একটি ধনীদের জন্য শিক্ষা, অপরটি গরিবের জন্য শিক্ষা। অনলাইন ব্যবস্থা নির্ভরতা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পথকেই প্রশস্ত করে শিক্ষার এই দ্বৈতব্যবস্থাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এটা ঠিক করোনাকালীন সময়ে বিদ্যালয় খুলে শিক্ষার্থীদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। আবার পঠন-পাঠন একেবারে বন্ধ করাও ঠিক হবে না। বিশেষ করে যারা উঁচু ক্লাসের ছাত্রছা্ত্রীরা। তাই করোনাকালীন সময়ে অনলাইন শিক্ষার সুযোগ যাতে সব অংশের ছাত্রছাত্রীরা পায় সেটা দেখতে হবে। আর সে দায়িত্ব সরকারের। অভিভাবকদের ঘাড়ে দায় চাপালে চলবে না। করোনার বিপদ কেটে গেলে বা প্রশমিত হলে পুনরায় শ্রেণিকক্ষের শিক্ষায় ফিরে আসতে হবে। কেননা এর কোনো বিকল্প নেই। কচিকাঁচারা মুখিয়ে আছে আবার কবে বন্ধুদের সাথে মিলিত হতে পারবে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে মুখরিত করতে পারবে। শিক্ষকমণ্ডলীর সান্নিধ্য পাবে। এইভাবেই মিনি ভারত গঠনের কাজ এগিয়ে যাবে। এরইমধ্যে দাঁড়িয়ে কিছু বিকল্প ভাবতে হবে।
বিকল্প কি?
(১) শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের ক্ষেত্র ও পরিস্থিতি তৈরি করা। প্রয়োজনে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বাড়িয়ে উঁচু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ভিত্তিক সিফটিং করে লক ডাউন বিধি মেনে ও মাস্ক-স্যানিটাইজার বিলি করে শ্রেণিশিক্ষা চালু করা যায় কিনা ভাবতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকস্তরে Subject Note, Syllabus Notes and Suggestion Notes দেওয়া। (২) শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। (৩) মিড ডে মিল বরাদ্দ বাড়ানো। (৪) সবার জন্য ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবস্থা করা। প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে ডিজিটাল পঠন-পাঠনের সামগ্রী সরকারি উদ্যোগে পৌঁছে দেওয়া। কেরালার বাম সরকার এই বিষয়ে নজির তৈরি করেছে। (৫) ছোটো ছোটো আকারে কোচিং ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা। টিউটোরিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা করা। এই কাজে সরকার ও শিক্ষক সংগঠনগুলির দায়িত্ব সর্বাধিক। (৬) সরকারি ও বেসরকারি সব ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ফি কমানো। কোনোভাবেই তা বাড়ানো চলবে না। (৭) আর্থিক দুর্বল পরিবারগুলিকে মাসে ৭,৫০০ টাকা করে ৬ মাস দেওয়া। এই সাথে ১০ কেজি চাল ও গম দেওয়া। সামাজিক সুরক্ষা বিধি রূপায়িত করা।