৫৭ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা / ২৪ জুলাই ২০২০ / ৮ শ্রাবণ ১৪২৭
সরকারের অপদার্থতায় রাজ্যে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন
শাসকদলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বিপন্ন মানুষের পাশে বামপন্থীরা
হারাধন দেবনাথ
সিপিআই(এম)-এর উদ্যোগে আঠারোভোলায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ।
একসময়ে ‘করোনা মুক্ত ত্রিপুরা’ প্রচার করে শাসকদল বাহবা কুড়োতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ করোনা সংক্রমণ বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। তিন হাজারের ঘর ছুঁতে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। ২১ জুলাই মৃতের সংখ্যা ৭ ছুঁয়েছে। সঙ্কট যত বাড়ছে সরকারের দায়সারা ভাব ততই প্রকট হচ্ছে। চিকিৎসক, পুলিশকর্মীদের সংক্রমণ বাড়ছে। অথচ দেখা গেছে, সুস্থ ব্যক্তিকে করোনা রোগী বানিয়ে কোভিড সেন্টারে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। ন্যায্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত বীরচন্দ্র কোভিড সেন্টারের মানুষ প্রকাশ্যে ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার আসার পর কাজ-খাদ্যের যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতি তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। কান পাতলেই মানুষের হাহাকার ভেসে আসে। অথচ সরকার নির্বিকার। বামপন্থীরা খাদ্যসামগ্রী, মাস্ক, ছাত্রছাত্রীদের পাঠ সামগ্রী বণ্টনের কাজ অব্যাহত রেখেছে বাধা ডিঙিয়ে। রক্তদান করছে মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচাতে। কিন্তু মানবিক কাজে বাধা দিচ্ছে বিজেপি কর্মীরা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন বামপন্থী নেতা-কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠন আয়োজিত রক্তদান শিবির আক্রমণ করে ভেস্তে দিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। সরকার নির্দেশ জারি করেছে রক্তদান শিবির করতে হলে চিফ সেক্রেটারির অনুমোদন লাগবে। অথচ ব্লাডব্যাঙ্কগুলি রক্তশূন্যতায় ধুঁকছে।
চিকিৎসক,নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশসহ করোনা যোদ্ধারা আক্রান্ত। বেড়েছে কন্টেইনমেন্ট জোন। বর্তমানে তা ৬৯। ১৭ জুন সকাল ৭টা থেকে তিন দিক ঘেরা বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার ১ কিলোমিটার ধরে গ্রামে এবং ৫০০ মিটার শহর এলাকা ধরে শুরু হয় ৭ দিনের কঠোর লকডাউন। সীমান্ত এলাকায় গরিব শ্রমজীবী মানুষের বাস। রয়েছে বিরাট অংশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ। অভাবগ্রস্ত মানুষের পাশে সরকার সাহায্যের হাত না বাড়ানোয় তাদের রুটিরুজিতে টান পড়েছে তাই। করোনার থাবা হাসপাতাল, থানায় আরও উদ্বেগজনক। রাজ্যের সব জেলাতেই সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সিপাহীজলা এবং গোমী জেলায় স্থানীয় সংক্রমণ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। মেলাঘর পৌরনিগমের এলাকা এবং উদয়পুর শহরের বেশ কিছু এলাকায় অজানা সূত্রে আক্রান্ত অনেকেই। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের প্রতিদিনই করোনা পজিটিভ মিলছে। এজন্য বন্ধ করতে হচ্ছে হাসপাতালের পরিষেবা।
প্রশাসনের কর্তাদের মনগড়া পরিকল্পনা এবং একাংশ নাগরিকের বেপরোয়া চালচলনকে দায়ী করছেন অনেকেই। জুলাই মাসের শুরু থেকে রাজ্যে এমন পজিটিভ রোগী মিলেছে যাদের চেইন ধরে অনেকেই আক্রান্ত। এখন পর্যন্ত রাজ্যের প্রধান দুই সরকারি হাসপাতাল জিবি এবং আইজিএম-এর বেশ কয়েকজন চিকিৎসক করোনা পজিটিভ। নার্স, আয়া, স্বাস্থ্যকর্মীও রয়েছেন। যদিও তথ্য চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার।
২৬ জুন পর্যন্ত বিমানে আসা টেস্টবিহীন ৮ হাজারের বেশি বিমানযাত্রী এবং চুড়াইবাড়ি দিয়ে আসা ১০ হাজারের বেশি যাত্রী আরও বেশি উদ্বেগে ফেলেছে। ১ জুন থেকে বিমান পরিষেবা শুরু হলেও রাজ্য সরকার সবার স্যাম্পল নেওয়া শুরু করে ২৬ জুন থেকে। শুরুতে প্রতি পাঁচজনে একজনকে পরীক্ষা করা হতো। এই কয়দিনে পাওয়া করোনা সংক্রামিত রোগীদের ৫০ ভাগের বেশি বিমানযাত্রী। রাজ্যে আসা প্রায় সব বিমানেই যাত্রীদের মধ্যে কম বেশি পজিটিভ রোগী মিলেছে। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, কলকাতা, জয়পুর, পাটনা সব জায়গা থেকে আসা যাত্রীদের মধ্য থেকেই পজিটিভ মিলেছে। এখন নতুন চিহ্নিত হওয়া রোগীদের তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে হটস্পট বলে কিছু নেই। একইসঙ্গে রাজ্যের ৮ জেলাই কম বেশি আক্রান্ত। ফিরে আসা যাত্রীদের ভালো অংশ হোম কোয়ারান্টিন কঠোরভাবে পালন না করায় তাদের সংস্পর্শে আসাদেরও সংক্রমণ বাড়ছে। একইসঙ্গে চুড়াইবাড়ি দিয়ে আসা ট্রাকচালকদেরও ভালো সংখ্যায় করোনা পজিটিভ মিলেছে। পজিটিভ রোগীদের তালিকায় আছেন সড়কপথে ফেরা যাত্রীও। এখনও সড়কপথে আসা যাত্রীদের ৫ জনে ১ জনের স্যাম্পল টেস্ট হয়। শুধু সবার স্যাম্পল নেওয়া হয় হটস্পট থেকে এলেই। বাকিরা স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ি ফিরে যান। সেই হিসাবে গত এক মাসে বিমান ও সড়কপথে কম করে ১৮ হাজারের বেশি যাত্রী টেস্ট ছাড়াই বাড়ি ফিরেছেন। এই কারণেই রাজ্যে করোনা ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে গেছে। যে ২০ শতাংশ যাত্রীর টেস্ট হয়েছে তার বাইরে রয়েছে এই ১৮ হাজার।
সরকারের পরিকল্পনাহীনতার জন্য ত্রিপুরায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। মানুষের জীবনযাত্রা নির্বাহ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কাজ ও খাদ্যের অভাব তীব্র। রাজ্য সরকারের কাছে সর্বদলীয় বৈঠকে এবং বিভিন্নভাবে সিপিআই(এম) বলেছিল যারাই বাইরে থেকে বিমানে, রেলে বা সড়কপথে আসছেন প্রথমেই তাদের সবার সোয়াব টেস্ট করা হোক। এটা ঠিকমতো মানা হয় নি। প্রতি পাঁচ জনে কেবল একজনের সোয়াব টেস্ট করেছে। এরফলে সংক্রমণ বাড়ছে। পরিস্থিতি গোষ্ঠী সংক্রমণের দিকে যাচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহলের অভিমত।
দামছড়ায় অভাবী মানুষদের মধ্যে সিপিআই(এম)-এর খাদ্যসামগ্রী বিতরণ।
অভাবে আত্মহত্যা
অভাবের তাড়নায় মৃত্যুর খবর পত্রিকায় আসছে। গণ্ডাছড়াতে এক পিতা তার কন্যা সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন। এরকম আরও ঘটনা আছে। অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা হচ্ছে। গ্রাম-শহরে মানুষ যেন বাঁচতে পারেন সেজন্য সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছে না। মানুষকে বাঁচাতে তাদের হাতে পয়সা দরকার। সিপিআই(এম) দাবি তুলেছেঃ মাথাপিছু ১০ কেজি করে খাদ্য, ৭৫০০ টাকা করে নগদ দাও। শুধুমাত্র কেন্দ্র থেকে ৫ কেজি খাদ্যশস্য ও সামান্য ডাল দিলে চলবে না। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে রেলভাড়া আর কিছু সাহায্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কিছুই দিচ্ছে না। রাজ্যের তহবিল থেকে কিছুই সাহায্য করেনি। রেগা, টুয়েপ, লাইন দপ্তরের কাজ বাড়ানো, রেগায় ২০০ দিন কাজ ও মজুরি বৃদ্ধি - এসব পরামর্শ সরকার শোনেনি। ব্যাপকভাবে ছাঁটাই চলছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ১০,৩২৩ শিক্ষক ছাঁটাই হয়েছেন, তাদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেই।
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক গৌতম দাশ সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, বাজারের মধ্যে বেচাকেনা প্রায় নেই। ৪০-৫০ শতাংশ আগে কমেছিল। এখন করোনার জন্য ৭০/৮০ শতাংশ বিক্রি কম। গুরুতর এই অবস্থার মধ্যে পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে। সরকার জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভাড়া না বাড়াবার পরামর্শ দিচ্ছে! এজন্য বাস নামছে না। পত্র-পত্রিকাতে যা খবর বেরিয়েছে ৬ থেকে ১০ কিলোমিটার যেতে এখন ৫০ টাকা করে লাগে। ত্রিপুরার অর্থনীতি, জীবনজীবিকার উপরে এতটা চাপ আগে কখনও আসেনি।
বিপন্ন মানুষের পাশে বামপন্থীরা
বাধা বিপত্তির মধ্যেও ত্রাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বামপন্থীরা। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহের হিসেব হলো রাজ্যের ২,৬২৮টা স্থানে, ১ লক্ষ ২ হাজার ৪৪ পরিবারকে ত্রাণ সাহায্য দিয়েছেন লাল ঝান্ডার কর্মীরা। তারজন্য ২ কোটি ২৭ লক্ষ ৮৪ হাজার ১৪৩ টাকা ব্যয় হয়েছে। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠন প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে ত্রাণ দিয়েছে। এই ত্রাণ কাজ অব্যাহত।
রক্তদান শিবির, ত্রাণ বণ্টনের পর এমনকি মাস্ক বিতরণেও হামলা চালায় বিজেপি দুর্বৃত্তরা। গরিব কৃষকদের মধ্যে মাস্ক বিলি এবং করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে সচেতনতামূলক শিবির করতে গিয়ে সারা ভারত কৃষক সভা এবং গণমুক্তি পরিষদের নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত। ঘটনা কমলপুর মহকুমার চানকাপ বাজারে। সশস্ত্র দুর্বৃত্ত বাহিনীর আক্রমণে কম করে নয়জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে খেতমজুর ইউনিয়নের নেতা রঞ্জিত ঘোষ, গণমুক্তি পরিষদের নেতা, প্রাক্তন বিধায়ক প্রশান্ত দেববর্মা, কৃষকনেতা সৈকত আলির আঘাত গুরুতর। প্রশান্ত দেববর্মার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আহতদের জামথুম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
চানকাপের সাপ্তাহিক হাটবারে করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে বাজারে সচেতনতামূলক শিবির এবং দুঃস্থ কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিলির কর্মসূচি নিয়েছিল সারা ভারত কৃষক সভা এবং জিএমপি। এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে চানকাপ ও তার আশপাশ এলাকাগুলি থেকে বহু কৃষক জমায়েত হতে শুরু করেন। এমন সময় মাস্কসহ নানা সামগ্রী নিয়ে দুটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গাড়ি থেকে বাজারে নামতেই তাদের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিজেপি দুর্বৃত্তরা আগে থেকেই ওৎ পেতে বসেছিল। গাড়ি থেকে নামতেই অতর্কিত আক্রমণ শুরু করে। হামলাকারীদের হাতে লাঠি, রড ছিল।
রাজ্যবাসী বুঝতে পারছেন বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভয় পেয়ে, মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে বিজেপি। এজন্য শাসকদলের নেতারা কম বয়সী যুবকদের উসকানি দিয়ে, প্ররোচনা দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে, যাতে সন্ত্রাসের বাতাবরণ বজায় থাকে। করোনা সঙ্কটকালে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা যাতে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারে, ত্রাণসামগ্রী বণ্টন করতে না পারে, সেইজন্য বিতরণ করতে গেলে হামলা, হুজ্জতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এমনকি মুমূর্ষু রোগীদের প্রয়োজনে রক্তদানের মতো মহতি কাজে ওরা বাধা দিচ্ছে। যারা এধরনের কাজ করছে সবাই শাসকদলের লোক - এটাই আজকের ত্রিপুরার অভিজ্ঞতা।
সিপিআই(এম) নেতা-কর্মী, চাকুরিচ্যুত ১০,৩২৩ শিক্ষকের উপর আক্রমণের ঘটনায় সাংবাদিকরা বিরোধী দলনেতার প্রতিক্রিয়া জানতে চান। বিরোধী দলনেতা মানিক সরকার বলেন, ৮ জুলাই চানকাপ বাজারে কৃষকসভা, জিএমপি এবং খেতমজুর ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা ত্রাণ বিলির আগেই তাঁদের উপর হামলে পড়ে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে তিনি বলেন, বামপন্থী কর্মীরা মাস্ক নিয়ে গিয়েছিলেন গরিব মানুষদের মধ্যে বণ্টনের জন্য। করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে গোটা রাজ্যেই মানুষ নানাভাবে আক্রান্ত। কাজকর্ম নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। নেই রোজগার। অনাহার-অর্ধাহার চলছে। সারা রাজ্যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ১ লক্ষাধিক দুঃস্থ পরিবারকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ বণ্টন করেছে বামপন্থীরা। সাধারণ মানুষ বামপন্থীদের পাশে আছে বলেই তা সম্ভব হচ্ছে।
‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’ - বাংলার এই প্রবাদ বাক্যটি উল্লেখ করে মানিক সরকার বলেন, এই জায়গায় রাজ্য যাচ্ছে। এগুলি করে কি কেউ পার পাবে? ২৭-২৮ মাস আগে যারা বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে ছুটেছে তাদের মধ্যে আমাদের সমর্থক পরিবারের ছেলেমেয়েরাও রয়েছে, শিক্ষক-কর্মচারী, যুবসহ সাধারণ গরিব মানুষও রয়েছে। তারা এখন কপাল চাপড়ে বলছেন কী ভুল করলাম, কী সর্বনাশ করলাম? তারা এখন বুঝতে পারছেন নির্বাচনের আগে বিজেপি’র দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি সবই ছিল ভাঁওতা।