৫৯ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৪ জুন, ২০২২ / ৯ আষাঢ়, ১৪২৯
দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রাখতে বিজেপি’কে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করাই মূল কর্তব্য
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিপিআই(এম)’র অবস্থান ব্যাখ্যা করে সীতারাম ইয়েচুরি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী দলসমূহের সর্বসম্মত প্রার্থী হিসেবে যশবন্ত সিনহার নাম স্থির হওয়ায় নানা মহল থেকে বামপন্থীদের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি পার্টির অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। ২২ জুন গণশক্তিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে ইয়েচুরি পার্টির অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, সংবিধান ও তার মূল্যবোধ রক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তির যথাসম্ভব ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলাই সিপিআই(এম)’র লক্ষ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি মতাদর্শগত সংগ্রামও বটে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী স্থির করাকে আমাদের দেখতে হবে।
সিপিআই(এম)’র অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতি পদ দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। বিশেষ করে ২০১৯-র পর থেকে বিজেপি সরকার ফ্যাসিবাদী আরএসএস-র হিন্দুত্ব রাষ্ট্রের কর্মসূচিকে আগ্রাসীভাবে রূপায়ণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসের উপসংহারে এবং পার্টি কংগ্রেসে সর্বসম্মতিতে গৃহীত রাজনৈতিক লাইনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং মূল কর্তব্য হলো বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করা’। এই লক্ষ্য পূরণ করতে রাজনৈতিক লাইনে একাধিক পদক্ষেপের কথা বলা হয় এবং জোর দেওয়া হয়, ‘পার্টি হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ব্যাপকতম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করার প্রয়াস চালাবে’। এই লাইনে স্পষ্ট যে, পার্টিকে বিজেপি’র প্রার্থীর বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তির সর্বোচ্চ ঐক্য গঠনের চেষ্টা করতে হবে। বিজেপি আমাদের সংবিধানকে খর্ব করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সংবিধানে স্বীকৃত সংসদ, নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থার মতো স্বাধীন সংস্থাগুলিকে খর্ব করছে। এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একজন অভিন্ন প্রার্থীর প্রশ্নে সর্বোচ্চ সম্ভব বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করার কাজ করতে হচ্ছে। এটাই পার্টির অবস্থান।
অভিন্ন প্রার্থীর প্রশ্নে বিরোধী ঐক্য কতদূর সফল হয়েছে এবং আরও কোনো দল এই প্রয়াসে শামিল হতে পারে কিনা এই প্রশ্নে তিনি বলেন, কয়েকটি আঞ্চলিক দল বাদ দিলে প্রধান প্রধান বিরোধী দলগুলি একজন অভিন্ন প্রার্থীর প্রশ্নে এক জায়গায় এসেছে। অন্যান্য আঞ্চলিক দলের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে। বিরোধীরা চেষ্টা করছে আরও প্রসারিত হতে। অভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে আরও সমর্থন সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
যশবন্ত সিনহার নাম প্রস্তাবিত হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সে সম্পর্কে ইয়েচুরি বলেছেন, যখন অভিন্ন প্রার্থী দাঁড় করানোর জন্য আলোচনা শুরু হয়েছিল তখন এই নির্বাচনকে মতাদর্শগত সংগ্রাম হিসাবেই দেখা হচ্ছিল। স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে সংবিধানকে রক্ষা করা, সাধারণতন্ত্রের চরিত্র রক্ষা করার লড়াই হিসাবেই একে দেখা হয়েছে। কয়েকটি নাম এসেছিল এবং তা নিয়ে মতৈক্যও ছিল। তিনটি নাম - শারদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লা, গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর নামে সব দলেরই সম্মতি ছিল। তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে বলা হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে পাওয়ার রাজি হননি, তারপর ফারুক আবদুল্লা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাননি, পরিশেষে একেবারে শেষ মূহূর্তে গোপালকৃষ্ণ গান্ধীও অসম্মত হন। সেই পরিস্থিতিতে আমরা এমন নামের খোঁজ করছিলাম যেখানে সর্বোচ্চ মতৈক্য হতে পারে। এই পরিস্থিতিতেই যশবন্ত সিনহার নাম আসে। যশবন্ত সিনহা বিজেপি-র প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন।। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই সেই সময়ের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পার্টির ঘোষিত লক্ষ্য পূরণের জন্য এমন ব্যক্তিদের সমর্থন করা হয়েছে যাঁরা কংগ্রেসের নেতা ছিলেন, পরে কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্দিরা গান্ধী ও জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়ে জগজীবন রাম যখন কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে এলেন, আমরা তাঁকে সমর্থন করেছি। অন্যথায় সেই সময়ে জনতা পার্টির সরকার তৈরি হতো না। তখনকার পরিস্থিতিতে সেটিই প্রয়োজন ছিল। আজ আমাদের সংবিধান ধ্বংসের অভিযানকে রুখতে হবে। এই কাজে যিনি শামিল হতে চান তিনি যদি অতীতে বিজেপি-র সঙ্গে থেকেও থাকেন তাঁকে সমর্থন করতে কোনো আপত্তি নেই। অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই পার্টি এই অবস্থান নিয়েছে। ভি পি সিং রাজীব গান্ধী সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির প্রশ্নে তিনি যখন বেরিয়ে এলেন আমরা তাঁকে সমর্থন করেছি। পার্টির আশু লক্ষ্য পূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হয়। এখন লক্ষ্য হলো সংবিধান রক্ষা করা। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য যিনি কাজ করবেন, আমাদের সমর্থন পাবেন।
দ্বিতীয়ত, আমরা পূর্বশর্ত দিয়েছিলাম যশবন্ত সিনহা তৃণমূল কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ না করলে কোনো অবস্থাতেই তাঁকে সমর্থনের প্রশ্ন উঠবে না। পরে, কংগ্রেস সহ আরও কয়েকটি দল এই শর্ত সমর্থন করে। তিনি প্রকাশ্যে ইস্তফা দেবার পরেই কেবলমাত্র তাঁর নাম আলোচনায় এসেছে, বিবেচিত হয়েছে।
বামপন্থীরা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারত কিনা এই প্রশ্ন ওঠায় সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, বাস্তবে আজকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচকমণ্ডলী বা ইলেকটোরাল কলেজে বামপন্থীদের শক্তি খুবই কম। বামপন্থী প্রার্থী হিসাবে লক্ষ্মী সায়গল যখন দাঁড়িয়েছিলেন তখন ১ লক্ষ ভোট আমরা জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওই সময়ে আমরা সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি ছিলাম, আমাদের রাজ্য সরকারগুলি ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বামপন্থীরা স্বাধীন ভাবে ভোটে দাঁড়ালে বামপন্থীদের আরও শক্তিক্ষয় হতো, বিজেপি সরকার এবং হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী ঐক্যকে ব্যাহত করা হতো। এতে বামপন্থীদের বিচ্ছিন্নতা বাড়ত। আজকের পরিস্থিতিতে তা একেবারেই সঠিক হতো না।