৫৯ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৪ জুন, ২০২২ / ৯ আষাঢ়, ১৪২৯
টেক্সটাইল এবং পাওয়ারলুম শ্রমিকদের জাতীয় কনভেনশন
কনভেনশনে বলছেন কে হেমলতা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১৭ মে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোরে অনুষ্ঠিত হলো টেক্সটাইল (বস্ত্র বয়ন) এবং পাওয়ারলুম শ্রমিকদের জাতীয় কনভেনশন। সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা কনভেনশনের শুরুতে পতাকা উত্তোলন করেন। কেরালা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, সহ দেশের দশটি রাজ্য থেকে ২৪১ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। সিআইটিইউ’র সহ-সভাপতি একে পদ্মনাভন সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। কনভেনশন থেকে আর কারুমালাইয়ানকে আহ্বায়ক করে টেক্সটাইল মিল এবং পাওয়ারলুম শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত ২৮ সদস্যের একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়।
ভারতের শতাব্দীপ্রাচীন টেক্সটাইল (বস্ত্র বয়ন) শিল্প হলো আমাদের অর্থনীতির প্রাচীনতম শিল্পগুলির অন্যতম। নিয়োগের দিক থেকে এই শিল্পের স্থান এখনও কৃষির পরেই - দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান ক্ষেত্র। প্রত্যক্ষভাবে ৪.৫ কোটিরও বেশি লোকের এবং পরোক্ষভাবে ৬ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই শিল্পক্ষেত্রে। এই শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে সুতি বস্ত্র, তাঁত, পাওয়ারলুম এবং পশমি বস্ত্র, সিল্ক, পাটজাত বয়ন সহ প্রস্তুতকারক, সরবরাহকারী, পাইকারী বিক্রেতা এবং রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম, কাঁচামাল, উৎপাদিত কাপড় এবং পোশাক পরিবহণে নিযুক্ত ব্যাপক সংখ্যক মানুষ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে টেক্সটাইল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের একটি গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। এত বিশাল সংখ্যক শ্রমিক থাকলেও এই শিল্প নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বস্ত্র বয়ন শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন স্পিনিং মিলগুলিতে সুতো উৎপাদিত হয়, কাপড় প্রধানত পাওয়ারলুম এবং হ্যান্ডলুমে উৎপাদিত হয়। এসবই বড়ো মিলগুলিতে ছোটো ছোটো বিভাগে উৎপাদিত হয়। টেক্সটাইল ক্ষেত্র জিডিপি-তে পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ শতাংশ এবং সরাসরি প্রায় ২.২ শতাংশ অবদান রাখে। জাতীয় পরিসংখ্যান ২০১৮ অনুসারে ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদনখাতে জিডিপি-তে টেক্সটাইল ক্ষেত্রের পরিমাণ ছিল ১২.২ শতাংশ।ভারতীয় বস্ত্র শিল্প থেকে (মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে) শিল্প উৎপাদনের ৭ শতাংশ এবং ভারতের রপ্তানি থেকে আয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ আসে। ২০১৯-২০ সালে ভারতের মোট বহির্বাণিজ্যে বস্ত্র ও পোশাক ক্ষেত্রের পরিমাণ ছিল ৫.৩৮ শতাংশ।
ভারতীয় টেক্সটাইল শিল্প বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম। মূল্য শৃঙ্খল অনুযায়ী ভারতের এই শিল্প কাঁচামাল অর্থাৎ উৎপাদিত তুলো এবং ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন শক্তির নিরিখে সুবৃহৎ ভিত্তি সম্পন্ন। এই শিল্পের স্বাতন্ত্র্য হলো হাতে বোনা ক্ষেত্রের পাশাপাশি পুঁজি নিবিড় মিল সেক্টরের সহাবস্থান। টেক্সটাইল মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিল সেক্টর, ৩ হাজার ৪০০টি টেক্সটাইল মিলের সাথে ৫০ মিলিয়নেরও বেশি স্পিন্ডেল এবং ৮ লক্ষ ৪২ হাজার রোটার স্থাপন করার ক্ষমতা রয়েছে যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। তাঁত, হস্তশিল্প এবং ছোটো আকারের পাওয়ারলুম ইউনিটের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্রগুলি গ্রামীণ এবং আধা-শহর এলাকায় লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড়ো উৎস।
কনভেনশনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের একাংশ।
শিল্পের বার্ষিক (২০১৬-২০১৮ সাল) সমীক্ষা অনুসারে, সমগ্র সংগঠিত উৎপাদন ক্ষেত্রে নিয়োজিত ১ কোটি ৪৯ লক্ষ ১১ হাজার ১৮৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ২৬ লক্ষ ৯৭ হাজার ১২৩ জন টেক্সটাইল এবং পরিধেয় পোশাক ক্ষেত্রে নিযুক্ত এবং নিয়োজিত আছেন। তার মানে টেক্সটাইল শ্রমিকরা আমাদের দেশের উৎপাদন খাতে নিয়োজিত মোট কর্মশক্তির ১৮.০৯ শতাংশ। শুধু মিল সেক্টরেই প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন।
বিকেন্দ্রীভূত পাওয়ারলুম ক্ষেত্র কাপড় উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বস্ত্র শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০১৩ সালে নিয়েলসন পরিচালিত বেসলাইন পাওয়ারলুম সমীক্ষা অনুসারে এটি ৪৪.১৮ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান করেছে। কিন্তু বস্ত্র মন্ত্রকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৫-১৬ বর্ষে প্রায় ৬২.৭৮ লক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত হয়েছেন। রপ্তানির প্রয়োজনীয় ৬০ শতাংশের বেশি ফ্যাব্রিক পাওয়ারলুম ক্ষেত্র থেকে আসে। তৈরি পোশাক এবং দেশীয় টেক্সটাইল ক্ষেত্র তাদের ফ্যাব্রিকের জোগানের জন্যও পাওয়ারলুম সেক্টরের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
৩১ অক্টোবর, ২০১৭ পর্যন্ত দেশে আনুমানিক ২৭.০১ লক্ষ নিবন্ধীকৃত পাওয়ারলুম রয়েছে। সমান সংখ্যক অনিবন্ধীকৃত পাওয়ারলুম থাকার সম্ভাবনা। এগুলির বেশিরভাগই মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং গুজরাটে কেন্দ্রীভূত। এই সেক্টরের প্রযুক্তিগত স্তর সাধারণ তাঁত থেকে উচ্চ প্রযুক্তির যা শাটল বিহীন তাঁতে পরিবর্তিত করা হয়েছে। এই সেক্টরে আনুমানিক ১.৫০ লক্ষ শাটল বিহীন তাঁত রয়েছে।
মহারাষ্ট্রে ১৩ লক্ষ পাওয়ারলুম রয়েছে অর্থাৎ আমাদের দেশের মোট পাওয়ারলুমের প্রায় ৫০ শতাংশ। এগুলি থানে জেলার বিওয়ান্দি, সোলাপুর, কোলহাপুর জেলার ইচলকরঞ্জি, নাসিক জেলার মালেগাঁও এবং সাংলির মতো বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকায় অবস্থিত। শ্রমিকরা বেশিরভাগই কাজের ক্ষেত্রে তীব্র অনিশ্চিত পরিস্থিতির শিকার। সিআইটিইউ এই শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সিআইটিইউ সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ইউনিয়নগুলির নেতৃত্বের সাথে দু’বার আলোচনা করে। সিআইটিইউ কেন্দ্র এই আলোচনার ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয় এবং কোয়েম্বাটোরে এই জাতীয় কনভেনশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৭ মে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোরে অনুষ্ঠিত টেক্সটাইল এবং পাওয়ারলুম শ্রমিকদের জাতীয় কনভেনশনের প্রকাশ্য অধিবেশনের উদ্বোধনী পর্বে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রতিনিধিসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তামিলনাডু টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতি ও অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান সি পদ্মনাভন উপস্থিত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান। সিআইটিইউ’র সহ-সভাপতি একে পদ্মনাভন সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। রাজ্য সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক জি সুকুমারন এবং শ্রমিক নেতা সিপিআই(এম) সাংসদ পি আর নটরাজন সম্মেলনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
কেরালা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গ এবং পুদুচেরি - এই দশটি রাজ্য থেকে ২৪১ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। সংগঠিত স্পিনিং মিল সেক্টরের প্রায় ১১৩ জন প্রতিনিধি এবং বিকেন্দ্রীভূত পাওয়ারলুম সেক্টরের ১২০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নেন। কনভেনশনে সিআইটিইউ’র সম্পাদক কারুমলাইয়ান খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনের উপর আলোচনায় ১৪ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। দাবি সনদ ও প্রস্তাবিত আগামীদিনের কাজসংক্রান্ত খসড়া সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কনভেনশন সর্বসম্মতিক্রমে দাবির সনদের পক্ষে প্রচার সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে টেক্সটাইল শিল্পকে এবং এই শিল্পের শ্রমিকদের বাঁচান- এই স্লোগানকে সামনে রেখে গত ১৫ জুন দেশব্যাপী অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।