৫৯ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৪ জুন, ২০২২ / ৯ আষাঢ়, ১৪২৯
৪৫ বছর আগে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার স্মরণে
বিমান বসু
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের স্রোতধারায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্রথম বামফ্রন্ট সরকার। এই সরকার প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট স্মরণ করলে দেখা যাবে, ওই বছরেরই ১২ এবং ১৪ জুন দু’দফায় বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার আগে লোকসভা নির্বাচন হয় এবং সেই নির্বাচন থেকে দেশে 'জনতা সরকার' গড়ে ওঠে। জনতা সরকার বিভিন্ন পার্টির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল। ১৯৭২ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ও নির্বাচন-পরবর্তীকালে রাজ্যে গণতন্ত্র হত্যা করার উদ্দেশ্যে নানা কার্যকলাপ চলেছে, মানুষের গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছে এবং আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস কায়েম করে আন্দোলন-সংগ্রামকে স্তব্ধ করা হয়েছে, সেইসঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন - কৃষক আন্দোলন - কর্মচারী আন্দোলন এবং শিক্ষক আন্দোলন ইত্যাদি সব আন্দোলনের ওপরেই হামলা - আক্রমণ হয়েছে। এইসব ঘটনা ঘটার পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন দেশে 'অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা' জারি হয়। মানুষের জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ঙ্কর। এইসব ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং লোকসভা নির্বাচনের পর ঘোষণা করা হয় বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আগেই উল্লেখিত হয়েছে, বিধানসভা নির্বাচন দু’দফায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। তারই ফলশ্রুতিতে ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৩১টি আসনে বামপন্থীরা মিলিত হয়ে যে বামফ্রন্ট গঠন করেছিল, তারা জয়যুক্ত হয়। বামফ্রন্ট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ে তোলে। বামফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করে ২১ জুন। এরপরে ৪৫ বছর কেটে গেলো। আজ আবারও সেই ২১ জুন। ১৯৭৭ সালের এইদিনে শপথ গ্রহণ করে বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গেলেন। রাইটার্স বিল্ডিং হচ্ছে সরকারের সচিবালয়। সেখানে যাবার পথে ব্যাপক মানুষের ভিড়ে তিনি আটকে গেলেন। উপস্থিত মানুষের সঙ্গে কিছু কথা বলে তিনি রাইটার্সের দোতলায় উঠে গেলেন। দোতলার অলিন্দ থেকে বক্তব্য রাখলেন। নিচে তখন উপস্থিত বিশাল অংশের মানুষ। সেখানে তিনি একটা কথা বলেছিলেন, আমরা তো আপনাদের মতামতের ভিত্তিতে শপথ নিয়ে এলাম। আমরা নির্বাচনের আগে যে ৩৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম, তা সামনে রেখে আমরা কাজ করব। আমাদের প্রাথমিক গুরুত্ব হবে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে সমস্ত সংস্থা নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সেগুলিকে নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে তোলা।
১৯৭৭ সালের ২১শে জুন রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনে জনতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
ছবিঃ ল্যান্ড অ্যান্ড লাইফ
কমরেড জ্যোতি বসু সেদিন যা বলেছিলেন তা বাস্তবে কার্যকর করতে শুরু করলেন। তিনি সেদিন শপথ গ্রহণ করার পর ঘোষণা করেছিলেন, সরকার শুধু রাইটার্স বিল্ডিং থেকে কাজ করবে না। সরকার কাজ করবে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে। পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। পুরসভা নির্বাচন পরিচালিত হবে। সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলিকে গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে সেগুলির মাধ্যমে সরকার কাজ করবে। সরকারের চোখ শুধু রাইটার্স বিল্ডিংয়েই থাকবে না, গ্রাম পঞ্চায়েত - পঞ্চায়েত সমিতি - জেলা পরিষদ এবং পুরসভাগুলির মাধ্যমে সরকার কাজ করবে। সেই অনুযায়ী দেখা গেল ১৯৭৮ সালের জুন মাসে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো। এই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো অনেক বছর পর। হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় ১৫/১৬ বছর পর ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলো। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ছিল না আগে, একটা স্তরে মনোনীত হতো। কিন্তু সেবারেই প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে উঠলো গ্রাম পঞ্চায়েত - পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ। এই কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল যে পঞ্চায়েতের তিন স্তরে বডি তৈরি করতে এক মাস সময় লেগে গেল। জুলাই মাসের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ জেলা পরিষদ গড়ে উঠলো। কারণ গ্রাম পঞ্চায়েত গড়ে ওঠার পর পঞ্চায়েত সমিতি, তারপর জেলা পরিষদ গড়ে ওঠে। সেভাবেই জেলায় জেলায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
১৯৭৭ সালের ২১শে জুন প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসু অফিসে বসলেন।
ছবিঃ ল্যান্ড অ্যান্ড লাইফ
আজকে একথা স্মরণ করতেই হবে যে, ১৯৭৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্যে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল। তখন রাজ্যে ১৬টি জেলা ছিল, তার মধ্যে ১১টি জেলা চলে গিয়েছিল জলের তলায়। সেই বন্যায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়,আবার বহু মানুষকে বাঁচানোও সম্ভব হয়েছে। এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত,পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে। তখন মানুষকে বাঁচাতে এবং বন্যা-পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজে যেভাবে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তখনকার সময়ে যাঁরা ছিলেন, কাজ করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে এখনো যাঁরা জীবিত আছেন তাঁদের স্মৃতিতে তা আজও জ্বলজ্বল করছে। ফলে একথা বলা যায় কমরেড জ্যোতি বসু নির্বাচনের আগে দেওয়া বামফ্রন্টের প্রতিশ্রুতি এবং ৩৬ দফা কর্মসূচি রূপায়ণ করার লক্ষ্যে দৃঢ় পায়ে পথ চলেছেন।
প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে ৩৬ দফা কর্মসূচির পুরোটা কার্যকর করতে না পারলেও ২৬ দফা তিনি রূপায়ণ করেছিলেন। বাকি ১০ দফা কর্মসূচিও আস্তে আস্তে রূপায়ণের কাজ শুরু হয়েছিল। সেই লক্ষ্যেই ১৯৭৮ সালে 'দ্বিতীয় ভূমি সংস্কার আইন' গ্রহণ করা হয়। সরকারের হাতে যে জমি আসা উচিত, সরকার তা হাতে নিয়ে এসে ভূমিহীন চাষি ও গরিব চাষিদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার কাজ শুরু করে। একইসঙ্গে তখন বর্গাচাষিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলো। ভূমি সংস্কার আইন, বর্গার অধিকার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নতুন করে গ্রাম বাংলায় একটা পুনুরুজ্জীবনের উৎসাহ এবং চেহারা ফুটে উঠল। গ্রাম বাংলা সত্যিকারের নতুন জীবন পেল, যা কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার মানুষকে উপহার দিয়েছিল। আজকে ৪৫ বছর পর সেই কথাগুলো স্মরণ করা প্রয়োজন। কমরেড জ্যোতি বসু একশো বছর পেরিয়ে গেছেন। তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীরা যে নিরলসভাবে কাজ করেছেন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সদস্যরা যে উদ্যমী ভূমিকা পালন করেছেন - তা সত্যিকারের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। আজকে ৪৫ বছর আগের কিছু কথা এবং ১৯৭৭ সালের ২১ জুন যে প্রেক্ষাপটে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই ঘটনাকে স্মরণ করে কিছু ঘটনা উল্লেখ করলাম।
(২১ জুন বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর উপলক্ষ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে বিমান বসু প্রদত্ত বক্তব্য অনুসরণে লিখিত।)