৫৯ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৪ জুন, ২০২২ / ৯ আষাঢ়, ১৪২৯
শিক্ষায় নৈরাজ্য ও বাঙালি জাতিসত্তা
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতির ধারায় একটা প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক চেতনা বহমান। আর এই চেতনাই বাঙালিকে দেশের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম করে তুলেছিল। প্রাক্-স্বাধীনতাকালে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালেও বাঙালির নীতি-বলিষ্ঠ, স্বচ্ছ রাজনৈতিক অবস্থান নানা সময়ে, নানা বিষয়ে বিবিধ বিতর্কের ক্ষেত্রভূমিকে প্রসারিত করলেও কখনো বাংলার সার্বিক রাজনৈতিক কৃষ্টি-সংস্কৃতি কলুষময় রূপে চিহ্নিত হতে পারে এমন অবকাশ বিকশিত হয়নি। কিন্তু নিতান্ত লজ্জাজনক হলেও সত্য, তৃণমূলী জমানার বিগত ১১ বছরের শাসন বাঙালি রূপে আমাদের এই গৌরবকেও কার্যত ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। গো-বলীয় লুম্পেনসমৃদ্ধ বাহুবলী রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা দক্ষিণের ডোলভিত্তিক, অর্থপ্রাচুর্য নির্ভর রাজনৈতিক ধারার বাইরে এই বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতিজাত ও আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক যে ঐতিহ্য ও গরিমা সুদীর্ঘকালব্যপী সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল তা-ও আজ চূর্ণ-বিচূর্ণ। ‘আত্মঘাতী’ রূপে চিহ্নিত বাঙালি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই স্বতন্ত্র আত্মমর্যাদার বলে বলিয়ান হয়েই অনেক ব্যর্থতা, অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণাকে অতিক্রম করেছে। তৃণমূলী জমানার বিগত ১১ বছরের শাসন আজ ধীরে ধীরে বাঙালির এই মুকুটকেও হরণ করতে উদ্যত। এক দুর্বিনীত, স্বৈরাচারী, ‘মেগানোম্যালিয়াক’ শাসকের হাত ধরে বাংলার সমাজজীবনে রাজনৈতিক লাম্পট্য, দুর্বৃত্তায়ন, চূড়ান্ত অনৈতিকতা ও অসততা যে দুর্নিবার গতিতে এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সমাজ-সংস্কৃতির মৌলিক আধারকে প্রতিনিয়ত বিনষ্ট করে চলেছে তা কার্যত নজিরবিহীন। ফলত, আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে বাঙালির জাতিসত্তা। আর জাতিসত্তা, জাতিগৌরবের এ বিস্মরণে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রারই একের পর এক দৃষ্টান্ত আজ এ রাজ্যের বাস্তবতায় অতি সুলভ।
দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে জ্বলজ্বল করছে এক উক্তি - "Destroying any nation does not require the use of atomic bombs or the use of long range missiles. It only requires lowering the quality of education and allowing the students to cheat in the examinations." - ঠিক একই ধারায় আজ এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেবারও নানা পরিকল্পনা দৃশ্যমান। সমস্ত স্তরের শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধিকার, স্বতন্ত্র মর্যাদাকে কেড়ে নেবার চক্রান্তের পাশাপাশি নানা অজুহাতে শিক্ষাঙ্গনের দরজা বন্ধ রাখা সহ বিভিন্ন কৌশলে এ রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে খাদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত চলেছে। কিন্তু অবাক করার মতো ঘটনা, শিক্ষাব্যবস্থার এমন এক নৈরাজ্যজনক আবহের মধ্যেও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের ক্ষেত্রে কিন্তু এক অতিকায় সাফল্যের নজির দৃশ্যমান, যা কোনভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রের সামগ্রিক চেহারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমনকী কোভিডকালীন বা তৎপরবর্তী টালমাটাল সময়েও তা শুধুমাত্র অক্ষুণ্ণই নয় বরং নয়া নজির তৈরির ধারা অব্যাহত। গতবছর কোভিডের কারণে বিকল্প কোনো পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনা-চিন্তা না করে, পরীক্ষা না নিয়েই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল। সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের মাধ্যমিকে পাশ করে ১০০ শতাংশ আর ৬৯৭ নম্বর পেয়ে প্রথম হয় ৭৯ জন। ১০ লক্ষ ৮০ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১০ লক্ষ জনের বেশি ৬০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে পাস করে। পাশাপাশি একই পদ্ধতিতে উচ্চমাধ্যমিকেও পাস করে যায় প্রায় ৯৮ শতাংশ আর ৬০ শতাংশের বেশি উত্তীর্ণ হয় প্রথম ডিভিশনে। গতবছর পরীক্ষা না নিয়েই বোর্ডের পরীক্ষায় যে রেকর্ডের ছড়াছড়ি লক্ষ করা গিয়েছিল, বর্তমান বছরে পরীক্ষা গ্রহণ করার পরেও এমন নানাবিধ রেকর্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে যা সহজ যুক্তি, বুদ্ধিতে কোনভাবেই স্বাভাবিক নয়। উদাহরণস্বরূপ, এ বছরের উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলেই যদি আমরা চোখ বোলাই তাহলে দেখতে পাই - এ বার প্রথম দশ জনেই স্থান পেয়েছে নয় নয় করে ২৭২ জন। কোথাও একই স্কুলের ২২ জন, কোথাও বা ৮ জনের নামে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রথম ১০-এর মেধা তালিকা। ৬০ শতাংশের বেশি অর্থাৎ প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় ৭১ শতাংশ আর গোটা রাজ্যের ৬,৩৮,৮৭৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৯ জন পি (পাশ) ডিভিশন পেয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের মতো পরীক্ষায় (মাধ্যমিক স্তরের তুলনায় যা সাধারণভাবে যথেষ্ট কঠিন বলে স্বীকৃত) এমন অভাবনীয়, নজিরবিহীন সাফল্যের পিছনে সংসদ সভাপতির ব্যাখ্যা - "চাপমুক্ত ও ভয়হীন পরিবেশে আপন বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবার কারণেই নাকি আপামর ছাত্র-ছাত্রীরা এমন বিপুল সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।" সংসদ সভাপতির এহেন স্বীকারোক্তি এবং ফলাফলের বাস্তবতা থেকে আমরা সুনিশ্চিতভাবে কতগুলো নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণকে চিহ্নিত করতে পারি -
১. গত দু'বছর অধিকাংশ সময় বিদ্যালয় বন্ধ রেখে, সিলেবাস শেষ না করে, সঠিকভাবে অনলাইন শিক্ষার আয়োজন করতে না পেরেও এ রাজ্যের সমস্ত অংশের শিক্ষার্থীরা এমন অভাবনীয় সাফল্যের নজির তৈরিতে সক্ষম হবার মতো শিক্ষাগত বুনিয়াদ তৈরি করে ফেলেছে।
২. এই রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এমন এক উন্নততর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ না করেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়েই ছাত্র-ছাত্রীরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যেতে সক্ষম হচ্ছে।
৩. সরকারি স্তরে বিশেষত, গত দু'বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যে চূড়ান্ত অবহেলা তা নানা সামাজিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সেগুলো সবই কার্যত যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার বিরোধী চক্রান্ত মাত্র এমন ফলাফলে তাও প্রমাণিত।
৪. শিক্ষা ব্যবস্থাকে সচল রাখার প্রশ্নে শিক্ষক নিয়োগের থেকেও প্রয়োজনীয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি করে মোবাইল ফোনের বন্দোবস্ত করে দেওয়া।
৫. আগামীদিনেও শিক্ষার্থীদের অন্য সেন্টারে পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা হলে যে ভয় ও চাপ শিক্ষার্থীরা অনুভব করে তা থেকে তাদের মুক্ত করে নিজের বিদ্যালয়ে অর্থাৎ হোম সেন্টারে পরীক্ষা ব্যবস্থাকেই মডেল আকারে গোটা দেশে লাগু করার বন্দোবস্ত করাই বাঞ্ছনীয়।
কিন্তু এমন পর্যবেক্ষণ যা খাতায়-কলমে বা তথ্যে বাস্তব তা প্রকৃতঅর্থে যে কোন ভাবেই বাস্তব নয় তা আমরা সকলেই স্বাভাবিক বুদ্ধিতে অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছি। কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের সাফল্যের প্রতি এতটুকু কটাক্ষ বা তাদের প্রকৃত কৃতিত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা এ লেখার লক্ষ্য নয়। কিন্তু যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আজ এমন ফলাফল রেকর্ড আকারে গৌরবান্বিত, উচ্চকিত প্রচারমাধ্যমের ঝলকানিতে উজ্জ্বল - তা অনেকাংশেই কার্যত প্রহসন মাত্র। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের যে আয়োজনে গত দু'বছরে প্রশাসন নিয়োজিত থাকল এমন ফলাফলের দ্বারা আপন চূড়ান্ত ব্যর্থতা আর নৈতিক দায়কেও এক লহমায় আড়ালের বন্দোবস্তও যেন পাকা করা হলো। প্রকৃত মেধা, পরিশ্রমের স্বীকৃতিকেও যেমন এমন মূল্যায়ন সামাজিক পরিসরে অবমূল্যায়িত করে, একইভাবে একজন ছাত্র-ছাত্রীর নিজেকে মূল্যায়নের মাপকাঠিও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন ফুলের মতো নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রী হয়তো এমন মূল্যায়নে গৌরব অনুভবের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আলোড়িত হয়, কিন্তু জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার দ্বারা অর্জিত এ অভিজ্ঞতা আগামীদিনের জন্যও তাকে দুর্বলভাবে গড়ে তোলে। সার্বিক অসততা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও শৃঙ্খলার যে স্খলন আজ এ রাজ্যের সমাজজীবনে পরিব্যাপ্ত তা যদি শিক্ষাব্যবস্থার হাত ধরেও এমন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করে তাহলে এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবেই আরও কঠিন আঁধারে নিমজ্জিত হতে বাধ্য। আমাদের নির্লিপ্ততা আর রাজনৈতিক উদাসীনতার হাত ধরে সমস্ত ধরনের অনৈতিকতাকেই স্বাভাবিকীকরণের যে প্রবণতা আজকের সমাজে গড়ে তোলা হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রও যদি অবলীলায় সে তালিকায় যুক্ত হয়ে যায় তাহলে প্রকৃত অর্থেই যে বিলুপ্তি ঘটবে বাঙালির আভিজাত্যের জাতিসত্তার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।