E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা / ২৪ জুন, ২০২২ / ৯ আষাঢ়, ১৪২৯

ইতিহাস মোছা যাবে না

সুপ্রতীপ রায়


১১ জুন দিল্লিতে ওমেন্দ্র রন্তুর লেখা ‘মহাভারতঃ সহস্র বরস কা ধর্মযুদ্ধ’ বইটির উদ্বোধন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ‘‘মোঘলদের কথাই বেশি লিখেছেন ঐতিহাসিকেরা।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘আপনারা শুধু মোঘলদের উপর মনোযোগ দিয়েছেন এবং বেশিরভাগই তাদের সম্পর্কে লিখেছেন।’’ আসলে অমিত শাহ গেরুয়া শিবির, হিন্দুত্ববাদীদের কথা বলতে চেয়েছেন। গৈরিক বাহিনী দেশের প্রকৃত ইতিহাসের বদলে বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে চায়।

ধর্মীয় মৌলবাদীরা যুগে যুগে একাজটিই করতে চায়। সম্প্রতি তাজমহল, কোনারক, জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে আরএসএস’র মন্তব্য কিংবা নূপুর শর্মার পয়গম্বর নিয়ে মন্তব্য বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের দেশের সমন্বয়বাদের ইতিহাস, সম্প্রীতির ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না। মৌলবাদীদের ধর্মীয় বিকৃতি, ইতিহাসের বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার দায় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির। আমাদের ইতিহাস এই তথ্য মেলে ধরেছে - হিন্দু ও মুসলিম শাসকদের অনেকেই সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। শেরশাহ, বাবর, আকবর প্রমুখ হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় ও সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছেন।

আমাদের দেশের মনীষীরা, নবজাগরণের অগ্রদূতেরা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা বলেছেন। চৈতন্যদেবের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? তিনি তো মানবতার সাধনা করেছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের মূল কথা হলো – মানবতাবাদ ও প্রেমভক্তিবাদ। তিনি ধর্মের আধারে মানবতার কথা প্রচার করে গেছেন। চৈতন্যদেব জাত-পাত, কুসংষ্কারের বেড়া ভাঙবার চেষ্টা করেছিলেন। এই কারণেই তিনি চন্দ্রশেখর, মুরারি, হরিদাস, শ্রীবাস, মুকুন্দ মিশ্র প্রমুখকে বলেছিলেন – কৃষ্ণনাম প্রচারে কোনো জাতের বিচার রাখলে চলবে না।

চৈতন্যদেবের কাছে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। হিন্দুদের সঙ্গে অনেক মুসলমান তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন হরিদাস - যিনি একজন মুসলমান। যবন হরিদাস চৈতন্যদেবের নীলাচল লীলার সঙ্গী ছিলেন। সহজিয়া বাউল সম্প্রদায়ের অনেক মুসলিম চৈতন্যভাবাশ্রিত ভক্তিমার্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। চৈতন্যদেব ছিলেন উদার অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রেমিক।

সনাতন গোস্বামীর অসাম্প্রদায়িক ভাবনা কে অস্বীকার করবে? তিনি আসলে ছিলেন গৌড়ের একজন সাধক। সনাতন একটি নূতন মতবাদ সৃষ্টি করেছিলেন - যা ‘দরবেশিয়া’ নামে পরিচিত। সনাতন গোস্বামীর শিষ্যরা হিন্দু দেবতা ও মুসলমান ফকিরদের নামে সংগীত রচনা করে গান গাইতেন। এঁরা উপাসনাতেও হরি ও আল্লার নাম উচ্চারণ করতেন। সনাতনের শিষ্যরা মুসলমান ফকিরদের মতো ‘আলখাল্লা’ নামক পোশাক পড়তেন ও ‘তসবিমালা’ নামে একপ্রকার মালা ধারণ করতেন।

বিশ্বম্ভর হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় থেকেই শিষ্য করতেন। সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বম্ভর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সম্বন্বয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। দাদু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। দাদুর শিষ্যদের মধ্যে রজ্জবজি, বাকরাজি, বারাহরজি প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়। তুকারাম কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে গেছেন। তাঁর অনেক মুসলমান ভক্ত ছিল। মুকুলদাস প্রচলিত কুসংষ্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা করেছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘মানবমণ্ডলী একই পরিবারভুক্ত। সুতরাং, তাহাদের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য থাকা উচিত নয়’। সাধক তুলসীদাস হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একতা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ধর্মের মধ্যে কোনোটাকেই ছোটো বা কোনোটাকে বড়ো বলে মানতেন না।

কবির ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি হিন্দু-মুসলিমের ঐক্য চেয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুর হিন্দুয়ানি মুসলমানদের মুসলমানি দুই-ই দেখলাম। ইহারা কেহই পথের সন্ধান পাইল না। এই দুই পথকে যুক্ত করিয়া মধ্য পথই পথ। দাস কবির সেই পথই যুক্ত ও মুক্ত করিতে চাহেন’। কবিরের কন্যার সঙ্গে এক ব্রাহ্মণের বিবাহ হয়েছিল। কবিরকে ধর্মত্যাগী বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি সেকেন্দার লোদির কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের প্রধান ব্রত হচ্ছে হিন্দু ও মুসলমানকে একসূত্রে গ্রথিত করা, সুতরাং আমি কোনো অন্যায় করিনি।’

গুরুনানক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক একতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। গুরুনানকের একান্ত ইচ্ছা ছিল - এমন একটি ধর্মমত সৃষ্টি করবেন, যা হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই খুশি মনে গ্রহণ করবে। রামানন্দ সম্প্রদায়গত ও সর্বপ্রকার দলগত পার্থক্য দূর করবার জন্য সাধনা করেছিলেন।

লালন সারাজীবন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে গেছেন। লালনের গানে ধর্ম-সমন্বয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর ধ্বনিত হয়েছে, জাত ধর্মের বিরুদ্ধে লালন বলেছেনঃ ‘জাত না গেলে পাইনে হরি/ কি ছার জাতের গৌরব করি/ ছুঁসনে বলিয়ে।/ লালন কয় জাত হাতে পেলে পুড়তাম আগুন দিয়ে।’ বিভেদকামীর মনোভাবের প্রতি দৃঢ়ভাবে বলেছেনঃ ‘একই ঘাটে আসা-যাওয়া/ একই পাটনি দিচ্ছে ধেওয়া/ কেউ খায় না কারো ছোঁয়া/ বিভিন্ন জল কে কোথায় পান।’ লালন স্পষ্ট করে বলেছেনঃ ‘‘বেদ পুরান করেছেন জারি/ যবন সাঁই হিন্দুর হরি/ লানন বলে বুঝতে নারি/ এরূপ সৃষ্টি করলেন কি রূপ প্রমাণ।’’

লালন সম্পর্কে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখেছেন (১৩০২): তিনি জাতিভেদ প্রথা মানিতেন না, হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন ও শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দুর নাম, ‘সা’ উপাধি মুসলমান জাতীয় – সুতরাং অনেকেই তাঁহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি কোনো উত্তর না দিয়া স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেনঃ ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’।

মধ্যযুগে মুসলমান শাসকদের রাজসভায় অনেক হিন্দু ছিলেন। বাংলায় মুসলমান শাসকদের রাজসভায় অনেক হিন্দু ছিলেন। যা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যুক্ত সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল। নবাব সিরাজৌদ্দোলার সময় পর্যন্ত বাংলায় শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে প্রচুর হিন্দু ছিলেন।

আকবর হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের ধর্মশাস্ত্র পড়তে উৎসাহিত করতেন। তিনি বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদ করেছিলেন। আকবরের প্রচেষ্টাতেই মহাভারতের ফারসি অনুবাদ হয়েছিল। ফারসিতে এর নাম ‘রাজম নামা’। উল্লেখ্য আবুল ফজল, নাকিব খাঁ, আব্দুল কাদির, বদাউনি প্রভৃতি পণ্ডিতদের উদ্যোগে রামায়ন, অথর্ব বেদ, হরিবংশ, যোগবশিষ্ঠ প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনুদিত হয়েছিল।

মুঘল শাসকরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালনে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বিশেষত, আকবরের সময় থেকে সেই সময়কার ভারতে প্রচলিত বিভিন্ন বর্ষপঞ্জী ও যুগের ভিত্তিতে নানাধর্ম, নানা সম্প্রদায়, জাতি, অঞ্চল শ্রেণি অনুযায়ী নানা অনুষ্ঠান হতো। মুঘল আমলে প্রধানত তিন ধরনের উৎসব পালিত হতো - ইসলামিক, হিন্দু ও পারসি। মুঘল আমলে অনুষ্ঠিত হিন্দু উৎসবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল – হোলি, শিবরাত্রি প্রভৃতি।

সম্রাট আকবর রাখী বন্ধনকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছিলেন। তিনি সভাসদসহ অন্যান্যদের হাতে রাখী বাঁধাকে আবশ্যিক করেছিলেন। দশেরা বা বিজয়া দশমীকে একটি সরকারি উৎসবে পরিণত করেছিলেন। এছাড়া দীপাবলী, রামনবমী, জন্মাষ্টমি প্রভৃতি উৎসবগুলি অনুষ্ঠিত হতো।

‘‘মুসলিম ক্যালেন্ডার মূলত চান্দ্র মতে হয়, ভারতে সৌরমতে জনপ্রিয় চারটি উৎসব ছিল ঋতুভিত্তিক যেমন - বসন্ত ও হোলি ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হতো, অপর দুটি দশেরা ও দীপাবলী অনুষ্ঠিত হতো অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে। আকবর এবং জাহাঙ্গীরের সময় বসন্ত উৎসব পালিত হতো বিদ্যার দেবী সরস্বতীর উদ্দেশে নৃত্য-গীতের মধ্য দিয়ে। হোলির সময় রং খেলার পাশাপাশি মুসলিম সন্তদের তীর্থক্ষেত্রগুলিতে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সপ্তাহব্যাপী ভ্রমণ চলত। দীপাবলীর সময় জুয়া খেলা, নেশা করা ইত্যাদি কারণে জাহাঙ্গীর তিন দিন ধরে চলা এই উৎসব বন্ধ না করলেও, ঔরঙ্গজেব বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য তা বন্ধ করে দেন।’’ (পৃঃ ২৫৪-মুঘল যুগে বিভিন্ন উৎসব উদযাপন-কর্মসংষ্কৃতি ও ছুটি বিষয়ক একটি আলোচনা-তপতী দাস - ইতিহাস অনুসন্ধান – ৩৫)

আমির খসরুর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তিনি নিজে ছিলেন সৎ মুসলমান। কিন্তু গোঁড়া মুসলমান ছিলেন না। ধর্মীয় ব্যাপারে উদার ছিলেন। ভারতবর্ষকে নিজের দেশ বলে মনে করতেন। তিনি সংস্কৃত ভাষা জানতেন। আমির খসরু লিখিত ‘নূহ সিফির’ গ্রন্থে লেখা আছে, ‘‘সংস্কৃত ভাষা উজ্জ্বল মুক্তোর মতো বিশুদ্ধ।’’ মধ্যযুগের আর একজন কবি ছিলেন ‘ইসামিদ’। তিনি তাঁর কবিতায় ভারতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন।

সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫১ থেকে ১৩৮৮ পর্যন্ত শাসক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালেই হিন্দুদর্শন সহ অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসি ভাষাতে অনুদিত হয়েছিল। এই সময়েই বৃহৎ-সংহিতা নামক জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বইটি সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। এগুলিই সমন্বয়বাদী দৃষ্টান্ত।

সম্রাট আকবর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ঐক্যস্থাপনের ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিলেন তার প্রমাণ ‘দিন-ই-ইলাহি’। আবুল ফজল আকবরের রাজসভায় নবরত্নের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্দু শাস্ত্রগুলি পাঠ করেছিলেন। ‘আইন-ই-আকবরি’তে হিন্দু ধর্মের অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। আবুল ফজল উদার ছিলেন বলেই কাশ্মীরের ফলকে লেখা আছে - ‘হে ঈশ্বর প্রত্যেক মন্দিরে আমি এমন সব লোককে দেখি, যারা তোমাকেই অনুসন্ধান করে এবং প্রত্যেক ভাষাতে আমি শুনি লোকে তোমারই প্রশংসা করে। বহু ঈশ্বরবাদ ও ইসলাম তোমাকেই অনুসন্ধান করে, তোমার সমতুল আর কেহই নাই।’ আবদুল গনি বাদাউনি প্রখ্যাত সাহিত্যিক ছিলেন। বেশ কিছু সংস্কৃত পুস্তক ফারসি ভাষাতে অনুবাদ করেছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিংহাসন বতিসি, বাহরুল আসমর প্রভৃতি।

সম্রাট শাহজাহান সমন্বয়বাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ভারতীয় সাহিত্য, সঙ্গীতের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি ‘বাক্ষুর’ হাজার ধ্রুপদকে বই আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর অনুবাদক ছিলেন - তুলসী বনমালী। শাহজাহানের অনুপ্রেরণায় ফারসি লেখক ইবনে হারকরান রামায়ণ গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন। মৌলানা আবদুল রহমান ‘মিরাতুল হাকায়েত’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এটি ভগবদগীতার সারাংশ। ওই একই লেখক মহাদেব ও পার্বতীর কথোপকথন ফারসিতে অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ গ্রন্থটির নাম মিরাতুল মঘলুকাত।

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে যোগবাশিষ্ঠ গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের দরবারের একজন সভাসদ রচনা করেছিলেন রাগদর্পণ। এটি ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীতের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে আরও কতগুলি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। প্রখ্যাত পণ্ডিত বৃন্দাবন ফারসি ভাষাতে লিখেছিলেন লুবুওয়াওরিখ, ঈশ্বর দাস লিখেছিলেন ফাহহাতুল আলমগির, ভিমসেন লিখেছিলেন দিলকুশা এবং খোলসাতুত তাওয়ারিখ।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন দারা শিকোহ্। তিনিই প্রথম উপনিষদ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, উপনিষদের আলো মুসলিমদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। দারা অনুদিত ফারসি উপনিষদের নাম সিররে আকবর।

এছাড়া তিনি আরও কতগুলি সংষ্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনুবাদ করেছিলেন - ভগবতগীতা, যোগবাশিষ্ঠ প্রভৃতি। দারার অনুবাদের সূত্রেই উপনিষদ বিশ্বের দরবারে আত্মপ্রকাশ করে। দারা অনুদিত ফারসি উপনিষদ ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন আঁকোতিল। এর পর অন্যান্য ভাষাতেও এটি অনুদিত হয়। দারা লিখিত আর একটি গ্রন্থের নাম মাজাউল বাহরায়েন অর্থাৎ দুই সাগরের সংযোগ কেন্দ্র। এই বইটি তিনি ভারতীয় জাতির মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টির জন্য লিখেছিলেন।

আলবেরুনিকে কি মোদি-শাহ অস্বীকার করতে পারেন? আবু বয়হান মহম্মদ ইবনে আহমদ আলবেরুনির জন্ম মধ্য এশিয়ার খোওয়ারিজাম নামক রাজ্যে (৯৭৩ খ্রিঃ)। তিনি উদার আদর্শের কথা প্রচার করেছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন যুগের অন্যতম ভারতবিদ্। আরব ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্বন্বয়ের জন্য বিরাট অবদান রেখেছেন।

ভারতবর্ষের সত্য পরিচয় নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই আলবেরুনি লিখেছিলেন। এই বইটির নাম তহিককাতুল হিন্দ। প্রায় সাতবৎসর সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করে এবং ভারতবর্ষের পণ্ডিতদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশে তিনি যে জ্ঞান লাভ করেছিলেন তা থেকে তিনি অমূল্য গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন। তিনি বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন।

আলবেরুনির কিতাব আত্ তহকীক আল হিন্দ একটি জগৎবিখ্যাত পুস্তক। এটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে রচিত হয়েছিল। আলবেরুনি কোরান ও হাদিস-এর সমস্ত প্রচলিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র গভীরভাবে পাঠ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন-ইসলামিক দর্শন বিশেষত, সুফি মতবাদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই।

আলবেরুনি তাঁর কিতাবুল হিন্দ-এর মুখবন্ধে লিখেছেনঃ ‘‘আমি হিন্দুধর্ম ও সভ্যতা সম্বন্ধে লিখিতে অগ্রসর হইলাম। তাহাদের বিরুদ্ধে কোনো অপ্রামাণিক অভিযোগ দিব না। আমি যদিও মুসলমান, তবুও তাহাদের ধর্ম ও সভ্যতাকে যেমনভাবে দেখিয়াছি, ঠিক সেইভাবে বর্ণনা করিতে কাতর হই নাই। তাহাদের ধর্ম-নীতি যদিও ইসলামের অনুরূপ নহে। তবুও তাহা কোনোরূপ রং ফলাইয়া লিখি নাই - ইহা নিরপেক্ষ ঘটনা বর্ণনা মাত্র। ইহাতে আমার অতিরঞ্জন কিছুই থাকিবে না।’’

ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় আলবেরুনি সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘যথার্থবাদী ঐতিহাসিক বলিয়া, ভারতের প্রাচীন বিদ্যার একাগ্রচিত্ত অনুশীলনকারী বলিয়া সমস্ত পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে আলবেরুনির নাম শ্রদ্ধার সহিত উচ্চারিত হয় এবং তাঁহার বই সযত্নে পঠিত হয় ও আলোচিত হয়। বিভিন্ন জাতির মধ্যে সত্য পরিচয় স্থাপনের চেষ্টায় জ্ঞানকে নিয়োজিত করিয়াছিলেন বলিয়া আলবেরুনি সমস্ত সভ্য মানুষের সাধুবাদের যোগ্য।’’

এসব ইতিহাস সংঘ পরিবার মুছবে কী করে?