৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
রাজ্যে কার্যকর জাতীয় শিক্ষানীতি - সম্পূর্ণ হলো একটি অনৈতিক আঁতাতের ইতিবৃত্ত
নিলয়কুমার সাহা
অবশেষে ঝোলা থেকে বেড়িয়ে পড়ল বিড়াল! পরিকল্পিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালিত নাটকের অবসান হলো গত ১৭ মার্চ, ২০২৩ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর কর্তৃক প্রচারিত এক আদেশনামায়। জনৈক সহকারী সচিব স্বাক্ষরিত ওই আদেশনামায় রাজ্য পোষিত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক মহোদয়কে আগামী শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী স্নাতকস্তরে ‘নিউ কারিকুলাম অ্যান্ড ক্রেডিট ফ্রেমওয়ার্ক’ চালু করার বিষয়ে কার্যক্রম স্থির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভয়াবহ অতিমারীর আবহে ২০১৯ সালে ঘোষিত খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি অবশেষে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের ফলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০’তে রূপান্তরিত হয়। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারিকরণ বাণিজ্যিকীকরণ এবং গৈরিকীকরণের লক্ষ্যে অবিচল কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত কেন্দ্রীভূত এই জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপাতবিরোধী অবস্থান এবং নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এক গভীর রাজনৈতিক সমঝোতাকেই নির্দেশ করে।
২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজ্যপাল, শিক্ষামন্ত্রীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত শিক্ষানীতি সংক্রান্ত এক ভিডিয়ো-আলোচনায় তদানীন্তন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ ‘‘এই শিক্ষানীতিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্রীকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষানীতিতে পরিকাঠামোগত বদল এবং শিক্ষা পদ্ধতি বদলের কথা বলা হয়েছে, অথচ বোঝা যাচ্ছে না এর আর্থিক দায়িত্ব কতটা কেন্দ্রের, আর কতটা রাজ্যের।’’ ওই সভায় তিনি দাবি করেনঃ ‘‘জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা করার সময় দেওয়া হোক। যাতে আমরা সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।’’ পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি পর্যালোচনার জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে এবং শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানান, ২০২০ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে ওই বিশেষজ্ঞ কমিটি জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে রাজ্য সরকারকে রিপোর্ট পেশ করবে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ২০২১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার বিপুল জনাদেশ নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, শিক্ষামন্ত্রীর পদে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তৃণমূল সরকারের প্রথম পর্বের শিক্ষামন্ত্রী, কোটি কোটি টাকার নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী-সহ রাজ্যের প্রায় গোটা শিক্ষা প্রশাসনই এখন জেলে। বঞ্চিত যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা ন্যায় বিচারের দাবিতে দুই বছরেরও বেশি সময় মহানগরীর রাজপথে আন্দোলনরত, মহামান্য আদালতের হস্তক্ষেপে প্রতিদিন নিয়োগ দুর্নীতির জালে ধরা পড়ছে শাসকদলের নেতৃবৃন্দ। রাজ্যের প্রায় সমস্ত সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ এবং পুনর্নিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত মহামান্য আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে। এমতাবস্থায়, রাজ্যে নজিরবিহীন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত শাসকদল কী আরও বড়ো কোনো বিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষার পূর্ব শর্ত হিসেবে নিঃশব্দে কার্যকর করলো জাতীয় শিক্ষানীতি, নাকি কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত - এই সব প্রশ্নের উত্তর আজ আর রাজ্যবাসীর অজানা নয়।
জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে কেরল, মহারাষ্ট্র এবং অন্যান্য কয়েকটি রাজ্য যেভাবে নিজ নিজ রাজ্যের শিক্ষানীতি প্রণয়নে উদ্যোগী হয়েছিল, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তর মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল দশ সদস্যের একটি শিক্ষা বিষয়ক কমিটি গঠন করে। এই প্রসঙ্গে রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বলেনঃ ‘‘কেন্দ্রের জাতীয় শিক্ষানীতির নানা জায়গায় আপত্তি আছে আমাদের। শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত একটি বিষয়। অথচ আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই সব কিছু করা হয়েছে। রাজ্যের নতুন শিক্ষানীতির লক্ষ্যে তাই বিশেষ কমিটি গঠন করা হলো। এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির আপত্তিকর জায়গাগুলি মানবে না রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতিক্রমেই রাজ্যের নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করা হবে।’’ তিনি আরও জানান, এই কমিটি দু’মাসের মধ্যে মতামত-সহ রিপোর্ট দেবে সরকারকে। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে বিকল্প শিক্ষানীতির খোঁজে রাজ্য সরকার কর্তৃক দু’দুবার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন, রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীদ্বয়ের গণমাধ্যমে বিবৃতি পরিবেশন ইত্যাদি যেমন রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমনি প্রত্যক্ষ করলেন তাঁদের করের টাকায় পরিচালিত বিশেষজ্ঞ কমিটির বন্ধ্যাত্ব এবং রাজ্য সরকারের কেন্দ্র বিরোধী কৃত্রিম রাজনৈতিক অবস্থান! স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের শিক্ষানীতির এত ব্যাপক এবং মৌলিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের এহেন শিশুসুলভ আচরণের মধ্যে যে গভীর রাজনৈতিক অভিসন্ধি বর্তমান তা অনুধাবন করতে গবেষণা নিষ্প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন, দেশের প্রধানমন্ত্রী এই জাতীয় শিক্ষানীতিকে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে উপস্থাপন করলেও প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষানীতি কি দীর্ঘ সময় সযত্নে লালিত ভারতীয় বহুত্ববাদের আত্মহননের পথকেই প্রশস্ত করছে না? ঘোষিত এই শিক্ষানীতির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে শিক্ষাব্যবস্থাকে গৈরিকীকরণের কৃত কৌশল, যা হিন্দুত্বকেই একমাত্র ভারতীয়ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ় প্রতি। এই লক্ষ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ ভারতীয় শিক্ষাক্রমে বিদেশি পড়ুয়াদের আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বৈদিক গণিত, যোগ, আয়ুর্বেদ সহ বিভিন্ন বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে জনমত যাচাইয়ের খেলায় প্রবৃত্ত হয়। পাশাপাশি ইতিহাস চেতনা এবং বিজ্ঞান সংস্কৃতির উপর পরিকল্পিত আক্রমণ মুক্তশিক্ষার পরিসরকে কতটা সংকুচিত করবে তা মোটেও কষ্টকল্পিত নয়। উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং পরিকাঠামো ছাড়া প্রস্তাবিত এই শিক্ষানীতি নির্দেশিত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল কাঠামোগত পরিবর্তন প্রকারান্তরে শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রকেই উন্মুক্ত করবে। আর সেই পথ ধরেই দ্রুত বাস্তবায়িত হবে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতে ক্যাম্পাস খোলার অনুমতির বাস্তবায়ন, যা কার্যত দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ বা ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’-এর পথই প্রশস্ত করবে। এহেন এক সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পোষিত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালিত হচ্ছে অস্থায়ী উপাচার্যের নেতৃত্বে। ইউজিসি নির্দেশিত সার্চ কমিটি গঠন করে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টিও দীর্ঘসূত্রিতায় আবদ্ধ। এহেন এক বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার কর্তৃক আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার ঘোষণায় অত্যন্ত সচেতন বঙ্গবাসী কতটা বিপন্ন তা সহজেই অনুমেয়।