৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
২৮ মার্চ বেকারি বিরোধী দিবসের আহ্বান
কলতান দাশগুপ্ত
আমাদের দেশের যুবসমাজের সামনে বেকারত্ব একটা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনে মৌলিক সমস্যাগুলোর সাথেই যুবসমাজের সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং সাধারণ মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধানের লড়াইয়ের সাথেই বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের সংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কারণ রাষ্ট্র একচেটিয়া পুঁজির শোষণকে বজায় রাখছে যে কোনো উপায়ে। পুরনো ধাঁচের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান না ঘটানোর ফলে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ছাঁটাই বাড়ছে, মুনাফা আরও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থায়ী পদে নিযুক্তিকরণ কমছে। গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন তার জন্মের সময় থেকেই বেকারত্বের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। অতীতে সরকারের কাছে তাদের দাবি ছিল - বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বেকার যুবদের কাজের সুযোগ তৈরির জন্য রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বরাদ্দের দাবি করতে হবে। বেকার যুবদের বেকার ভাতা দেওয়ার নীতি কার্যকর করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে বেকার কৃষিজীবী যুবদের চাকরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। চাকরির নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার বিরুদ্ধে সরকারকে কড়া ভূমিকা পালন করতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নাগালের মধ্যে রাখার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সত্তরের দশকের শুরু থেকে গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন বেকারত্বের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে দৃঢ় লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তোলে। যুব ফেডারেশনের দাবি ছিলঃ ‘‘সকলকে কাজ দিতে হবে অথবা বেকার ভাতা দিতে হবে।’’ সেই সময়ে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করে যে, প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি জেলায় অন্তত ১,০০০ যুবককে ১০ মাসের জন্যে কাজ দেওয়া হবে। প্রতি মাসে ১০০ টাকা উপার্জনের গ্যারান্টি থাকবে। এর জন্য অর্থ বরাদ্দ করবার কথাও বলা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার মাত্র ৩ কোটি ৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। এর পাশাপাশি ছাঁটাইয়ের মাত্রাও বাড়তে থাকে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ১,১৯,০০০ কর্মচারী ছাঁটাই হয়। এই কর্মহীনতার ব্যাপক সংকটের প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন রাজ্যজুড়ে বেকার বিরোধী কর্মসূচি পালন করতে থাকে। রাজ্যের সর্বত্র বেকারত্বের বিরুদ্ধে কনভেনশন, মিছিল, সমাবেশ সংঘটিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ নভেম্বর ২৬টি বামপন্থী গণসংগঠনের ডাকে শহিদ মিনারে বেকারদের কাজ অথবা বেকার ভাতার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় যুব ফেডারেশনের ডাকে বেকারি বিরোধী রাজ্য কনভেনশনের সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয় যে, ২৮ মার্চ কলকাতায় কেন্দ্রীয় বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান সংগঠিত হবে। পরবর্তী সময়ে রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন অফিসে, মহকুমা সদরে ও জেলা সদরে বিক্ষোভ অবস্থান হয়। ১৯৭৩ সালের ২৮ মার্চ ২৬টি গণসংগঠনের ডাকে প্রথম বেকারি বিরোধী দিবস পালন হয় কলকাতার এসপ্ল্যানেড ইস্ট চত্বরে। কমরেড জ্যোতি বসু, কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ সেই বিক্ষোভ অবস্থানে বক্তব্য রাখেন।
সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সময় বদলেছে, সরকার বদলেছে কিন্তু বেকারত্বের যন্ত্রণা বদলায়নি। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র সর্বশেষ তথ্য বলছে যে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে বেকারত্বের হার ৭.৪৫ শতাংশ। ২০২২ সালের আগস্ট, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী এই কর্মহীনতার হার ৮ শতাংশ পেরিয়ে গিয়েছিল। দেশের শহরাঞ্চলে গত একবছরে বেকারত্বের গড় হার ছিল ৮.৪৪ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে শহরের বেকারত্বের হার ছিল ১০.০৯ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের গ্রামাঞ্চলে এবছরের ফেব্রুয়ারিতে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৭.২৩ শতাংশ।
দেশে গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চাষের খরচ বৃদ্ধি একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। একদিকে চাষের খরচ বৃদ্ধি অন্যদিকে উৎপাদিত জিনিসের সঠিক দাম না পাওয়ার ফলে চাষে আগ্রহ কমছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এমএনরেগা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু শেষ কেন্দ্রীয় বাজেটে এই ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। গ্রামীণ যুবদের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এই বাজেট।কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্প যেমন অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড-ডে মিল প্রভৃতিতে বহু মহিলা কাজ করেন। এই প্রকল্পভিত্তিক শ্রমিকদের কোনো ন্যূনতম মজুরি কিংবা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি রাষ্ট্র। সারাদেশে এই প্রকল্পগুলিতে কয়েক লক্ষ শূন্যপদ থাকলেও তা পূরণের ক্ষেত্রে কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই কেন্দ্রীয় সরকারের।
রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, ডাকঘর, বন্দর ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নিজের দায়িত্ব থেকে ক্রমাগত অব্যাহতি নিতে চাইছে। একের পর এক ক্ষেত্র বেসরকারি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী চাকরি ও তার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে রাষ্ট্র। ন্যূনতম নিরাপত্তাহীন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বাধ্য করা হচ্ছে দেশের যুবসমাজকে। একের পর এক সংস্থা ছাঁটাই করে চলেছে কোনো কারণ ছাড়াই। রাষ্ট্র তার যুবদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও ছবিটা আলাদা নয়। গত ১১ বছরে রাজ্যে কোনো নতুন কর্মসংস্থান হয়নি। একটা শিল্পও হয়নি। সরকারি দপ্তরে নিয়োগে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। রাজ্য সরকারি দপ্তরগুলিতে স্থায়ী কাজের বদলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে। যুবদের ক্রমশ হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এমএসএমই অর্থাৎ মাইক্রো স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজগুলির মাধ্যমেও কাজের সুযোগ তৈরি হতে পারত। মাইক্রো এন্টারপ্রাইজে কাজ করেন প্রায় ১১ কোটি শ্রমিক। স্মল এন্টারপ্রাইজে নিযুক্ত আছেন ৩২ লক্ষের মতো শ্রমিক। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষমতা আছে মাইক্রো এন্টারপ্রাইজের, তারপরই স্মল এন্টারপ্রাইজের। মাইক্রো এন্টারপ্রাইজগুলিতে অল্প শিক্ষিত, অল্প দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা করা যায় যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে। নয়া-উদারনীতির জমানায় মাইক্রো এন্টারপ্রাইজগুলির ওপরেই সবচেয়ে বেশি আক্রমণ নেমে এসেছে। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে বড়ো করপোরেটদের সাথে লড়াইতে এরা পিছিয়ে পড়ছে, কারণ করপোরেটরা ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে মোদি-দিদির পাশে দাঁড়াচ্ছে আর এর বিনিময়ে সরকার তার ঝোলা নিয়ে করপোরেটদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
আরএসএস-বিজেপি’র শাসনে দেশের মহিলা, দলিত, আদিবাসীদের মানুষের হাল আরও খারাপ হয়েছে। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের হিসাব অনুযায়ী অন্য শ্রমিকদের থেকে দলিত শ্রমিকরা প্রায় ১৭শতাংশ কম মজুরি পাচ্ছেন। কোভিড মহামারী চলাকালীন দলিত, আদিবাসীদের মধ্যে কর্মহীনতার হার ৬-৮শতাংশ ছিল। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আরএসএস-এর নীতি অনুযায়ী দলিত-আদিবাসীদের উপর সামাজিক শোষণ চলছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর হিসাবে লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৫ তম। দেশে এখনো মহিলাদের মজুরি পুরুষের তুলনায় ৭৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে শূন্য পদ পূরণ, রেগা’য় বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকার পোষিত প্রকল্পগুলিতে প্রয়োজনীয় নিয়োগ এবং মাইক্রো এন্টারপ্রাইজগুলিকে একটু সাহায্য প্রদান করলেই কর্মসংস্থানের বাজারের হতাশার চালচিত্র বদলাতে পারত। কিন্তু মোদি ও দিদি সরকার সেপথে হাঁটবে না, এটা জানা কথা। নয়া-উদারনীতি তাদের এই পথে হাঁটাকে প্রশ্রয় দেয় না।
এটা বাস্তব যে সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়া বেকারত্বের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বেকারদের কাজ না পাওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা দেওয়ার দাবি কখনোই অবাস্তব নয়। পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরনের ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। যদি আমার দেশের সরকার বড়ো বড়ো শিল্পপতিদের প্রতিবছর নিয়ম করে ট্যাক্স ছাড় দিতে পারে তবে বেকার ভাতা দেওয়া যাবে না কেন? বেকারি বিরোধী আন্দোলন যাতে যথাযথভাবে গড়ে উঠতে না পারে তার জন্যে রাষ্ট্রের মদতে সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলি বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচার ক্রমাগত করতে থাকে। বেকারত্বের মূল সমস্যাগুলো আড়াল করে যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য নানা কৌশল গ্রহণ করতে থাকে। এই প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। যুব সমাজের রাজনৈতিক চেতনার স্তরকে উন্নত করতে হবে। কোনো হঠকারি পথ ও প্রচারের দ্বারা যুব সমাজকে আন্দোলনের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করার প্রচেষ্টা রোধ করতে হবে। একথা পরিষ্কার যে, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বেকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সরকার বদলে দিয়ে, এই ব্যবস্থাকে বদলে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে বেকারত্বের সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। সেই জন্যই বেকারি বিরোধী আন্দোলনের এই অর্থনৈতিক দাবিকে রাজনৈতিক দাবির সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে। নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার লড়াইয়ের সাথে এই লড়াইকে যুক্ত করতে হবে। মোদি ও দিদির সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোই গণআন্দোলনের সামনে আজ অন্যতম প্রধান কর্তব্য। নীতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করেই যুবসমাজ এই লড়াই জিতবে।