E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯

ত্রিপুরা

জয় পেয়েও কেন হিংস্রতা! প্রশ্ন অত্যাচারিতদের


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ যারা হাতজোড় করে ভারত মাতা স্লোগান দিয়ে ভোট চাইতে এসেছিল তারাই ভোট গণনার পর আমার মাথা গোঁজার ঠাই কেড়ে নিয়েছে। পুরো ঘর ছাই। এখন আমি পরিবারকে নিয়ে কোথায় যাবো? কী খাবো? লজ্জা নিবারণের কাপড় কোথায় পাব। অশ্রুসিক্ত নয়নে এক অশিতিপর মায়ের এইসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? শুধু দোয়াই-এর এক মায়ের এই যন্ত্রণাকাতর অভিব্যক্তি নয়, হাজারো মানুষের জিজ্ঞাসা - জয় পেয়েও কেন হিংস্রতা?

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ভোটের বয়স হয়নি এমন ছাত্রদের পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর আক্রমণ করেছে গেরুয়া পতাকার নিচে আশ্রয় প্রশ্রয় পাওয়া একদল যুবক। আক্রমণকারীদের এই বয়সে পরিবারের জন্য কিছু করার কথা। না তাদের মগজ বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে মদের বোতল হাতে তুলে দিয়ে, নেশার ট্যাবলেট দিয়ে। তেল সহ বাইক দিয়ে পাঠানো হচ্ছে রাবার বাগান জ্বালিয়ে দিতে, পুকুরে বিষ ঢেলে দিতে, দোকান ঘর, পানের বরজ জ্বালিয়ে দিতে। ‘বীরপুঙ্গব’রা মোদির জয় স্লোগান দিয়ে সিপিআই(এম) সমর্থিত পরিবারের উপর চাঁদার জুলুম চালাচ্ছে। শহরে, গ্রামভিত্তিক বাজারে কাজের জন্য আসতে দেওয়া হচ্ছে না লালঝান্ডার পতাকাবাহী শ্রমিকদের। রুটি-রুজি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে পরিবহণ শ্রমিকদের। এ এক দমবন্ধকর অবস্থা।

চা শ্রমিক পরিবারে আর্তনাদ

২ মার্চ থেকে ভয়াবহ অভূতপূর্ব সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়েছে রাজ্যের চা বাগানগুলিতে। সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন গরিব মেহনতি চা শ্রমিকরা। মোহনপুর, জিরানীয়া, সাব্রুম, ধর্মনগর, কৈলাসহর মহকুমায় এখন পর্যন্ত যতটুকু খবর প্রায় তিন-চারশত চা শ্রমিক রুজি হারিয়েছেন। বিজেপি-র স্থানীয় মণ্ডলের ইশারায় ওইসব শ্রমিকের একমাত্র সম্বল কাজটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মহিলা শ্রমিকদেরও অত্যন্ত নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে। চা শ্রমিক মায়ের কোলের শিশু অভুক্ত। অপুষ্টির শিকার মায়ের মুখ। শিশুর কান্না কী করে থামবে?

সব মিলিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতি কায়েম করা হয়েছে চা বাগানগুলিতে। শুধু কাজ থেকে ছাঁটাই করেই শান্ত হয়নি বিজেপি’র বাহিনী। মেঘলিবল চা বাগানে কয়েকজন শ্রমিকের ঘর ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন চা বাগানে বেশ কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা চা শ্রমিকের কাজ কেড়ে তাদেরকে বাগানে প্রবেশ না করার ফতোয়া দিয়েছে বিজেপি বাহিনী। এখন চা বাগানগুলিতে কাজের ধুম। চা পাতা সংগ্রহ, তৈরি করা সহ নানা ধরনের কাজের সময়। এই অবস্থায় মণ্ডলের নির্দেশে কাজ বন্ধ হওয়ায় বাগানগুলিতে কর্মী সমস্যা দেখা দিয়েছে। কাজ হারিয়ে শ্রমিকরা সন্তান সস্তুতি নিয়ে পথে বসেছেন। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। চা বাগান কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত নির্বিকার, দায়হীন।

গবাদি প্রাণীরও নিস্তার নেই

কল্যাণপুর থানার অন্তর্গত দ্বারিকাপুর পঞ্চায়েতের চার নম্বর ওয়ার্ডের এলাকায় বাড়ি মলিনা দে’র। তিনি সিপিআই(এম) কর্মী। ১৫ মার্চ রাত প্রায় একটা নাগাদ শাসকদলের দুর্বৃত্ত বাহিনী হামলে পড়ে ওই বাড়িতে। অভিযোগ, কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন দেয়। এই আগুনেই একটি গোরু, তিনটি ছাগল সহ বেশ কিছু হাঁস ও মোরগ জ্বলে পুড়ে মরে যায়। গোরু ও ছাগলের পুরো শরীর জ্বলে পুড়ে ছাইয়ের মতো হয়ে যায়। আগুনে পুড়ে হাঁস মোরগগুলোকে আর চেনার উপায় নেই।

সন্ত্রাস বন্ধে প্রচার মাধ্যমের সামনে কড়া বার্তা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এখন চুপ। অবিরাম সন্ত্রাস চলছে বিভিন্ন এলাকায়। শাসকদলের পোষা বাহিনী নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে নিরীহ মানুষের বাড়িঘরে। নষ্ট করছে সম্পত্তি। রেশন সামগ্রী দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে কিছু কিছু এলাকায়। লাগামহীন সন্ত্রাস বন্ধে কোনো কার্যকর ভূমিকাই দেখা যাচ্ছে না মুখ্যমন্ত্রী কিংবা পুলিশের। মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে।

মানসিক নির্যাতন

সিপিআই(এম)-কে ভোট দেওয়ার অপরাধে রাজনগর বিধানসভার বহু মানুষকে রেশন সামগ্রী দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বিজেপি। অভিযোগ, রাজনগর বিধানসভার রাঙ্গামুড়া, ঘোষ খামার এবং রাজনগর এলাকার রেশন দোকানগুলিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিজেপি’র বাইক বাহিনী ঘাঁটি করে বসেছে। প্রতিটি রেশন দোকানের অন্তর্গত গ্রাহকদের মধ্যে যারা সিপিআই(এম)-কে ভোট দিয়েছে বলে সন্দেহ করছে, সেই ভোক্তাদের কোনো সামগ্রী না দিয়ে নানাভাবে হুমকি ধমক দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছে। শাসকদলের লাগামহীন সন্ত্রাসে বহু গরিব মানুষ ঘরবন্দি। রোজগার নেই। হাতে টাকা নেই। এই অবস্থায় রেশন সামগ্রী আনতে না দেওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ভোক্তারা।

খোয়াইয়ের সিপিছড়ায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়াত গজেন্দ্র দেবনাথের বাড়িতে হামলা চালায় শাসকদলের দুর্বৃত্তরা। নির্বিচারে ভাঙচুর চালায়। প্রকাশ্য দিবালোকে দুটি গাড়িতে করে গিয়ে আচমকা শাসকদলের দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। ঘরের ভেতর ঢুকে সোফা, শো-কেস, টিভি সেট, গ্যাসের চুল্লি, বাসনপত্র, খাট, আলনা, চেয়ার টেবিল, ফ্রিজ সহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভেঙে চুরমার করে দেয়। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালেও ভোটের ফল ঘোষণার পর বিজেপি দুর্বৃত্তরা একই বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার পরিবারের লোকজন। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন গজেন্দ্র দেবনাথ। শয্যাশায়ী অবস্থাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এই প্রয়াত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে একটি মোবাইল ফোন সহ কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় বিজেপি দুর্বৃত্তরা। তারপর আক্রমণ করেছে সিপিআই(এম) অমরপুর মহকুমা কমিটির সদস্য নিতাই সরকারের উপর। উদয়পুর মহকুমায়ও সমানতালে চলছে সন্ত্রাস। মহকুমার গঙ্গাছড়া এলাকায় বহু বাড়িতে হামলা চালায় শাসক দলের দুর্বৃত্তরা।

জনগণের স্বার্থে লড়বে সিপিআই(এম)

জনগণের স্বার্থে শাসকদল ও প্রশাসনের যে কোনো ভালো কাজে সাহায্য করবে বামফ্রন্ট। ১৬ মার্চ সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণ করার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে একথা বললেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক বিধায়ক জীতেন্দ্র চৌধুরী। পাশাপাশি তিনি এটাও বলেন, রাজ্যের জনগণের স্বার্থ-বিরোধী কোনো কাজ কিংবা সংবিধানে থাকা অধিকার হরণের চেষ্টা হলে শুধু ১১ জন বামফ্রন্ট বিধায়ক নন, সারা রাজ্যের জনগণকে নিয়ে বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে আওয়াজ তোলা হবে।

ত্রয়োদশ ত্রিপুরা বিধানসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন বামফ্রন্টের ১১ জন সিপিআই(এম) বিধায়ক। শপথ গ্রহণ শেষে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জীতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণ করে আমরা বিধায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিলাম। আমাদের কাজ হবে আগামী ৫ বছর সংবিধানের অধিকার রক্ষা করা। সংবিধান জনগণকে বাক্‌স্বাধীনতা, প্রতিবাদ করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অধিকার দিয়েছে। এগুলো এরাজ্যের মানুষ সমানভাবে ভোগ করতে পারছে না। এটা রক্ষার জন্য আমরা ১১ জন সদস্য হলেও এ রাজ্যের ৪০ লক্ষ জনগণের জন্য দায়িত্ব পালন করব।

বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে সিপিআই (এম)-র পরিষদীয় দলের নেতা জীতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, জনগণের জন্য শাসকদল ও সরকারের যেকোনো ভালো কাজে সহযোগিতা করব। এরাজ্যের শাসকদল রাজনৈতিক দিক থেকে বিরোধী হলেও তাদের ভালো কাজে রাজ্যের কল্যাণে সাধ্যের বাইরে গিয়েও সহযোগিতা করব, কিন্তু জনগণের অধিকার হরণের চেষ্টা হলে বিধানসভার ভেতরে বাইরে সমানভাবে রাজ্যের জনগণকে নিয়ে আওয়াজ তুলব।