৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
তৃণমূল জমানার পঞ্চায়েতে চুরি দুর্নীতিই বৈশিষ্ট্য - যা গরিব আদিবাসী সংস্কৃতির পরিপন্থী
ডাঃ পুলিনবিহারী বাস্কে
ভূমিকাঃ
দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত। সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উল্লেখ রয়েছে।
দেশের কেন্দ্রীয় সরকার ধনতান্ত্রিক পথে, নয়াউদারীকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ, বেসরকারিকরণ, জাতীয় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, বিভাজনের রাজনীতি সৃষ্টিকারী করপোরেটদের স্বার্থবাহী সরকার। ফলে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, দলিত-আদিবাসী সংখ্যালঘু মহিলাদের ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সরকার শিক্ষা বিরোধী ও সংবিধান বিরোধী। এরা দলিত, আদিবাসী প্রান্তিক মানুষের ওপর অবৈজ্ঞানিক মনুবাদী ভাবনা চাপিয়ে দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করছে।
দেশের সরকারের এই বছর সাধারণ বাজেট জনস্বার্থ বিরোধী, কৃষক বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী। এরা দলিত, আদিবাসীদের প্রাপ্য বরাদ্দ থেকে (সাব প্ল্যান) বঞ্চিত করছে, রেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
কেন্দ্রে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার ও রাজ্যে তৃণমূল সরকারের আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই।
● দেশের সরকারের আর্থিক নীতির প্রতিফলন রাজ্যে সরকারের নীতিতে পড়ছে, আবার রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পঞ্চায়েতগুলির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
● বাম আমলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল, তাই জমির কেন্দ্রীভবন ভেঙে গরিব কৃষক, ভূমিহীন, আদিবাসী, তপশিলি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের মধ্যে জমি বিলিবণ্টন করা হয়েছিল পঞ্চায়েতের মাধ্যমে।
● বনাঞ্চল এলাকায় আদিবাসী মানুষের আয়-উপার্জন বাড়ানোর জন্য বনজ সম্পদ ব্যবহার করে ল্যাম্পস (LAMPS) -এর মাধ্যমে কাজকর্ম চালু ছিল। বর্তমানে সব বন্ধ হয়ে রয়েছে। নির্বাচনও বহুদিন হয়নি।
● বনাঞ্চলে আদিবাসী মানুষের অধিকার, বনাঞ্চল অধিকার-আইন (২০০৬) সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়
রাজ্যে তৃণমূল সরকারের নেতৃত্বে আর একটি পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। এবারে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আসনগুলিতে তপশিলি উপজাতি, তপশিলি জাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর অংশ এবং মহিলাদের আসন সংরক্ষণ রয়েছে। ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পঞ্চায়েতের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম বেড়েছে। ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যথেষ্ট সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে পঞ্চায়েতে কী দেখতে পাচ্ছি? ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সবার স্মরণে আছে - গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কীভাবে কলুষিত করে এবং আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিরোধী শূন্য করা হয়েছিল। বাম আমলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল গ্রামে গ্রামে সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং মানব সম্পদের উন্নতিসাধন করা, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা।
আর এখন পঞ্চায়েতের কাজ হলো দুয়ারে সরকার, চুরি, দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ। পঞ্চায়েতে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো গরিব আদিবাসী তপশিলি প্রান্তিক অংশের মানুষ যারা সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রধান কর্মকর্তা হয়েছেন, তারা চুরি, দুর্নীতি রপ্ত করে ফেলেছেন। যা কিনা গরিব আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। বর্তমানে চুরি, দুর্নীতি, কাটমানি, তোলাবাজি সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। তাছাড়া গ্রামীণ গরিব শ্রমজীবী, আদিবাসী তপশিলিদের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, এই পঞ্চায়েত তাদের না। তাদের কোনো কাজ পঞ্চায়েতে হবে না। তাই তারা ১০০ দিনের কাজ পান না। যারা কাজ করেছেন তারা মজুরি পাননি। অথচ যারা পঞ্চায়েত প্রধান, কর্মকর্তা বা শাসকদলের স্থানীয় নেতা, অনুগত তারা ১০০ দিনের কাজ (রেগার কাজ না করে) না করে দিব্যি ১০০ দিনের মজুরির টাকা পকেটে পুরেছেন। রেগায় কাজের হিসাব পঞ্চায়েত দিতে পারছে না। টাকা আসা বন্ধ হয়েছে, এখন রেগার কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গ্রামে গরিব পাড়ায় বিশেষ করে আদিবাসী তপশিলি যাদের কাঁচাবাড়ি, ঝুপড়িবাড়ি, যারা প্রকৃত, প্রাপক ইন্দিরা আবাস যোজনার তালিকায় তাদের নাম বাদ গিয়েছে। তৃণমূলের পছন্দমতো তৈরি ‘ভিলেজ রির্সোস পারসন’ (ভিআরপি) যেভাবে সমীক্ষা করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
আবার যারা ৬০ বছর বয়স অতিক্রম করেছেন, বার্ধক্যভাতা প্রাপক, তাদের ভাতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডে অসঙ্গতি দেখানো হয়েছে।
● মাসে ১,০০০ টাকা ভাতা, যা কিনা এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে কমপক্ষে ৩,০০০ টাকা বাড়ানো দরকার। সেইভাবে রেগার ক্ষেত্রে ২০০ দিন কাজ দেওয়া, ন্যূনতম মজুরি ৬০০ টাকা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
গ্রামীণ রাস্তাঘাটের খুবই করুণ দশা - কিছু এলাকায় ঢালাই রাস্তা, পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকলেও গরিব আদিবাসী তপশিলি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পাড়াগুলি রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত।
মহিলা স্ব-সহায়ক দলগুলিকে আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে স্ব-সহায়ক দলগুলিকে (এসএইচজি) ব্যবহার করে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির সরকার জপয়লাভ করতে চায়। অন্যদিকে পাঁচ শত টাকার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাফল্য আনতে চায়।
কিন্তু সরকারের ঋণ ৬ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। রাজ্যের মানুষের মাথাপিছু ৬০ হাজার টাকা করে দেনা। কীভাবে সরকার চলবে আর কীভাবেই বা পঞ্চায়েতগুলি চালাবে তার সঠিক রূপরেখা বাজেটেও লক্ষ করা গেল না।
গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি, মানব সম্পদের বিকাশ, সম্পদ সৃষ্টি, সামাজিক উন্নতি, কৃষির বিকাশ, প্রাণী সম্পদের বিকাশ এই সমস্ত উন্নতির ছাপ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়নি। এই সরকারের অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি শুনেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে দেখছি, প্রাকৃতিক সম্পদের বেহিসেবি লুট, পাচার, (বালি, মাটি, কাঠ, কয়লা, মোরাম, বোল্ডার) ঢালাও মদের লাইসেন্স দিয়ে সরকারের আয়বৃদ্ধি, সমাজে অরাজকতা, অপসংস্কৃতি ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দিতে চাইছে সরকার। স্কুল তুলে দিতে চাইছে সরকার। আদিবাসী তপশিলি ছাত্রছাত্রীদের ড্রপ আউট সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। স্কুল হোস্টেলগুলি সরকার বন্ধ রেখেছে। এই সরকার জোর করে আদিবাসীদের জমি ও অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। এই সরকারের আমলে জাল জাতিগত শংসাপত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ প্রশাসন দিয়ে এই সরকার সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনও সেইভাবে করার অপেক্ষায় রয়েছে।
মানুষের হাতে অসীম ক্ষমতা। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা, প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ সচেতন মানুষের জোট গড়ে তোলার পাশাপাশি আমাদের লড়তে হবে দুষ্কৃতীরাজ, দুর্নীতিরাজ, তোলাবাজি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
উপসংহারঃ
আদিবাসী, তপশিলি, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষের সামাজিক আন্দোলন বিকশিত করে, গণআন্দোলন ও শ্রেণি আন্দোলনে শামিল করে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, সংবেদনশীল জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার অঙ্গীকার আমাদের করতে হবে।