৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
জাতধর্মের বিরোধ নয় - স্বচ্ছ পঞ্চায়েত ও সম্প্রীতির উন্নত বাংলা গড়ে তুলুন
ডাঃ রামচন্দ্র ডোম
প্রেক্ষাপট
১৯৭৭ সালে জননেতা কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা পশ্চিমবঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও তা রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যবাহী ঘটনা ছিল। এ শুধু তথাকথিত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনা নয় - রাজ্যের গরিব-শ্রমজীবী-কৃষিজীবী ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর তৎকালীন শাসকের আর্থিক ও সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা তথা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক জন-বিস্ফোরণ। চলতি বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থবাহী বিকল্প আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি এক সুদূরপ্রসারি বার্তা বহন করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসু মন্ত্রীসভার শপথ নেওয়ার পরেই ঘোষণা করেছিলেন যে, আমাদের সরকার শুধু রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বসে সরকার চালাবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গ্রাম-শহরের মানুষকে উন্নয়নের ভাগিদার করবে।
ঐতিহাসিক সেই ঘোষণার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৭৮ সালে বাংলার বুকে প্রথম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো দেশের মধ্যে প্রথম সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বৃহত্তম পঞ্চায়েত সাধারণ নির্বাচন। ‘বাস্তুঘুঘুর’ বাসা ভেঙে গরিব-মধ্যবিত্তের ক্ষমতায়ন ঘটানোর জন্য নতুন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পথচলা শুরু হলো এবং যে ব্যবস্থার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছরকাল জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে গ্রামীণ মানুষের রাজনৈতিক-আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের এক নজিরবিহিন অধ্যায় সূচিত হলো।
পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার সামাজিক ভিত্তি
এটা বলাবাহুল্য যে, আমাদের রাজ্যের নতুন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দীর্ঘ প্রায় আঠাশ বছরের গাঁয়ের জোতদার-জমিদারদের দ্বারা পরিচালিত শোষকশ্রেণি তথা কায়েমি স্বার্থের পক্ষের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। জাতপাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি ঐক্যই ছিল নতুন পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার ভিত। সিপিআই(এম)-র নেতৃত্বে বামপন্থী ফ্রন্টের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে যা সাযুজ্যপূর্ণ। যে রাজনৈতিক দর্শন মানুষের মধ্যে জাতপাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিভাজন মানে না। যুগ যুগ ধরে সমাজে জাতপাত ও ধর্ম-সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থাকলেও, তা যাতে মানুষে মানুষে বিভেদ-সংঘাত ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে কমিউনিস্ট-বামপন্থীদের মতাদর্শগত দৃঢ় অবস্থান মানুষের ঐক্য-সংহতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে দৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছিল। শুরু থেকেই হাজারও বাধা সত্ত্বেও পঞ্চায়েত নির্বাচনকে বামপন্থীরা গ্রাম সরকার তৈরির জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসাবেই গ্রহণ করেছিল - শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলির দলহীন পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার তত্ত্বকে নস্যাৎ করেছিল এবং শুরুতেই গ্রামবাংলার মানুষ তাকে গ্রহণ করেছিল দৃঢ়তার সঙ্গে। আমাদের দেশের সংবিধানের বুনিয়াদি তত্ত্ব গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদকে আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করে বাস্তবের মাটিতে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছে সরকার প্রশাসন ও পঞ্চায়েত তথা নগরপালিকা পরিচালনার ক্ষেত্রে। একদিকে গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপক শ্রেণিভিত্তি এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শ গ্রাম সরকারের বুনিয়াদকে মজবুত করেছিল।
পঞ্চায়েত ব্যবস্থার রাজনৈতিক ভিত্তি
গ্রামবাংলার কোটি কোটি মানুষ যুগ যুগ ধরে একদিকে আধা-সামন্তবাদী ও আধা-পুঁজিবাদী শাসন ও শোষণে পিষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে জাতপাত ও লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক শোষণের শিকার হয়েছে। গ্রামীণ শ্রমজীবী গরিব মানুষ এবং মধ্যবিত্তদের ব্যাপক শ্রেণি-ঐক্যের ভিত্তিতে ধারাবাহিক জমি ও মজুরির সংগ্রাম এই শোষণ-পীড়নের খাঁড়াকে দুর্বল করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি সংস্কারের যুগান্তকারী কর্মসূচি লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন গরিবকে সম্পদের ভাগীদার করেছিল - যা গরিবের আর্থিক ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর এই প্রক্রিয়ায় ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছিল। বিকেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সক্রিয়ভাবেই গরিবের অধিকার রক্ষায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। বহুদলীয় অংশগ্রহণমূলক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল বিকল্প রাজনৈতিক ভাবনা।
নিয়মিত অবাধ পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং পঞ্চায়েত পরিচালনায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি
বামফ্রন্ট সরকার সর্বস্তরে গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার ব্যাপারে সদাসক্রিয় ছিল। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন নিশ্চিত করেছিল। পঞ্চায়েত পরিচালনায়, পরিকল্পনা ও প্রকল্প রূপায়ণে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সচেতন প্রয়াস থাকত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণভাবে পঞ্চায়েত পরিচালকদের দৃঢ় অবস্থান এবং নিচুতলায় সজাগ সচেতন মানুষের তীক্ষ্ণ নজরদারি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করত। সাধারণভাবে মানুষ এই পঞ্চায়েতকে - তাদের অধিকার রক্ষার প্রতিষ্ঠান মনে করত। গ্রামের আদিবাসী, তপশিলি জাতি-গরিব সংখ্যালঘু সহ সমাজের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার আত্মিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল - এটাই ছিল বামফ্রন্ট জমানায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বড়ো সাফল্য।
গ্রামীণ স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রতিষ্ঠান পঞ্চায়েত
গ্রামের সার্বিক উন্নয়নই ছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, আবাসন, বনসৃজন - পরিবেশ রক্ষা, সেচের সম্প্রসারণ এসব তো ছিলই, এছাড়াও গরিবের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও জনস্বাস্থ্য; পুষ্টি প্রকল্প ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও মানব উন্নয়নের কাজে পঞ্চায়েতের ছিল সক্রিয় ভূমিকা। গ্রামীণ সম্পদ সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও পঞ্চায়েতের নির্দিষ্ট নিয়ামক ভূমিকা ছিল। বিশেষত মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবারে বছরে একশো দিনের কাজ রূপায়ণে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে। নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের পরিবর্তে প্রশাসনিক আধিকারিকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে। রাজ্যের ১১ বছরের তৃণমূল কংগ্রসের শাসন সর্বস্তরে লুঠেরা পুঁজিবাদের লুঠেরা ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিজেপি এবং তৃণমূলের লুঠেরা পুঁজিবাদী-সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মকাণ্ড রাজ্যের গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। রাজ্যের শাসকরা নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন অবাধে অনুষ্ঠিত করার পরিবর্তে গায়ের জোরে ও অর্থবলে দখলদারির ব্যবস্থা কায়েম করেছে। স্বভাবতই, পঞ্চায়েত আজ গ্রামের মানুষের বিশেষত শ্রমজীবী-গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নের প্রতিষ্ঠান নয়; তা শাসকের লুঠপাট এবং দমন-পীড়নের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিকেন্দ্রীভূত গ্রামীণ উন্নয়নের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আজ বিপর্যস্ত হয়েছে।
গান্ধীজির গ্রাম স্বরাজ বা গ্রামের সরকারের ধারণা আজ বিপথচালিত হয়েছে।
জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিপদ
কমরেড জ্যোতি বসু বলেছিলেনঃ ‘‘রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের বড়ো অপরাধ বিজেপি-র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হাত ধরে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করা। পরিপূরক সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতা তথা ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে খতম করার কাজে লিপ্ত হয়েছে এই দুই শাসকদল। জাতপাত তথা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি আজ জনগণের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করেছে। একদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অন্যদিকে জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিষময় ফল রাজ্যের ঐক্য-সম্প্রীতির বাতাবরণকে কলুষিত করছে। গণসংগ্রামের ও গণতন্ত্রের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে এই বিভাজনের পশ্চাৎমুখী রাজনীতি শ্রেণি আন্দোলন ও গণ-আন্দোলনের শ্রেণি ঐক্যকে নষ্ট করছে।’’
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের গণতান্ত্রিক মানুষের কাজ
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দুই শাসক বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ধনীদের স্বার্থবাহী আর্থিক নীতি দেশের তথা রাজ্যের গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষের সর্বনাশ করছে। অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দুই শাসকের জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করছে।
আমাদের রাজ্যের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে তথা রাজ্যের গ্রামীণ উন্নয়নের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে লুঠেরাদের হাত থেকে উদ্ধার করে জনগণের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিজেপি এবং তৃণমূলকে উৎখাত করে স্বচ্ছ ও সম্প্রীতির পঞ্চায়েত গড়তে হবে। এই লড়াইয়ে আমাদের যোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। বিজেপি বিরোধী তৃণমূল বিরোধী সমস্ত বাম-গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সার্বিক ঐক্য গড়েই আগামীতে সম্প্রীতির উন্নত বাংলা গড়তে ঐতিহাসিক ভূমিকা আমাদের পালন করতে হবে।