৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
সব সাথিকে কাজে নামাও - এলাকার পর এলাকা জাগাও
মানবেশ চৌধুরি
(এক)
দু’টো দলের মধ্যে নকল যুদ্ধ চললেও, তৃণমূল এবং বিজেপি যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ তা প্রায় জনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, আমরা দুই অপশক্তিকে দূর করব কীভাবে?
আসল উপাদান হলো মানুষ। সেই মানুষের মধ্যে নিবিড় প্রচার ও তেজি লড়াই খুব জরুরি।
আগের কথার পুনরালোচনার অবকাশ এই নিবন্ধে নেই। এই সময়ে যা চলছে, তা নিয়ে ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। দুর্নীতি দুর্নীতি আর দুর্নীতি। বেসুমার দুর্নীতি। শুধু স্কুলের বিভিন্ন পদে ভুয়ো নিয়োগের দুর্নীতির খনি খুঁড়েই, এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত, সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার হদিশ মিলেছে। এ নাকি কিছুই নয়! বাপ রে বাপ! আরও কত কোটি যে বেরোবে! বাংলার মানুষ এত এত টাকা কোনোদিন চোক্ষে দেখেনি। এবং এটা বাংলার সংস্কৃতিরও বিরোধী।
যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আট হাজার স্কুল উঠে গেল, ২৫ লক্ষ ছাত্র শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে গেল। নিয়োগ দুর্নীতি ও ‘উৎসশ্রী’র কল্যাণে ঢালাও বদলি নিয়ে নেওয়ার কারণে, বিশেষ করে গ্রামীণ স্কুলগুলো শিক্ষক বিহীন হয়ে যাচ্ছে। সরকার এসবে প্রশ্রয় দিচ্ছে, কারণ ওদের মূল লক্ষ্য শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করা। যেমন মদন মোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’য় আমরা পড়েছি - ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে/ শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে’। এখন গরিব বাড়ির শিশু রাখালি করবে না, কিন্তু শিক্ষাহীন জগতের অন্ধকারের বাসিন্দা হবে তারা। শিক্ষায় চরম বৈষম্য নেমে আসছে।
বালিখাদান, কয়লাখনি লুট করে, গোরু পাচার করে তিহার জেলে বন্দি তৃণমূলী বেতাজ বাদশা। তারও যে দুর্নীতির পথে অর্জন শত শত কোটি টাকা নগদে ও সম্পদে, তাও সবার জানা হয়ে গিয়েছে।
আমরা চাষের প্রসঙ্গ এনে কী বলতে পারি? ফসলের দাম পায় না চাষি, সারের কালোবাজারিতে গম সরষে আবাদ করতে নাভিশ্বাস উঠেছিল। ফসল ওঠার পর ছয়জন আলুচাষি আত্মহত্যা করলেন। আলুর সরকারি দাম ও কেনার নীতি যা ঘোষণা হয়েছে, তা কৃষক মারার আরেক ফাঁদ। কেনা হবে, মোট উৎপাদনের মাত্র সাত শতাংশ। সরকারি ঘোষিত দাম উৎপাদন খরচের থেকে অনেক কম। পেঁয়াজের দামেও ঠকছে চাষি।
ঘর পায়নি বেশিরভাগ গরিব মানুষ। যারা পেয়েছে তাদের নগদ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তবুও কিছুটা অবধি উঠে, সেসব ঘর মুখব্যাদান করে পড়ে আছে।
পানীয় জলের সংকট সব গরিব পাড়ায়। এরকমভাবেই চিকিৎসা পায় না মানুষ, অ্যাডিনো ভাইরাসে অকাল মৃত্যু হলো শতাধিক শিশুর। জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে হাত পুড়ে যাচ্ছে মানুষের, গ্যাসের দামের তাপ গ্যাসের চুলোর আগুনের থেকেও বেশি। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পাকা রাস্তায় পিচ উঠে গিয়ে পায়ের ছাল-চামড়া উঠে গেল মানুষের।
বাংলার প্রতিটি পাড়া থেকে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী, স্বামী-স্ত্রী-সন্তান বাইরের রাজ্যে খাটতে গিয়েছে দু’টো ভাতের জন্য।
(দুই)
আমরা অনেক লড়াই দেখতে পাচ্ছি। ছাত্রদের-যুবদের- শিক্ষকদের-কর্মচারীদের ও শ্রমিকদের, কৃষকদের বাংলা কাঁপানো লড়াই দেখছি। চলতি সময়ের নির্বাচনী সংগ্রামগুলিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজয়।
আমরা ক’দিন আগেই দেখলাম - ভয়ভীতি, নানা কালা অধ্যাদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকারি কর্মচারী শিক্ষকদের ধর্মঘট। ন্যায্য ডিএ এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রায় ১৩ লক্ষ শূন্যপদে নিয়োগ দিতে হবে, এই দাবিতে।
ধর্মতলা চত্বর তো বঞ্চিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্থায়ী ধরনামঞ্চে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
এসময়ের একটা বড়ো ব্যাপার ত্রিপুরা। সেখানে ভেদবাদীদের সঙ্গে বিজেপি’র ষড়যন্ত্রে মানুষের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিহীন ফলাফল এসেছে। এত করেও মাত্র কানের কাছ দিয়ে জিতেই, বিজেপি হত্যা, দৈহিক আক্রমণ, ভাঙচুর, লুট, অগ্নি সংযোগ, চাঁদার জুলুম ইত্যাদি দুষ্কাণ্ড চালাচ্ছে। প্রতিরোধের লড়াই দিচ্ছে ত্রিপুরার বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি। বর্তমানে যে সব লড়াই পশ্চিমবঙ্গবাসী লড়ছে, সেই লড়াইয়ের সঙ্গে ত্রিপুরার জন্যও সংহতি মূলক লড়াই সংগ্রাম চলছে।
অর্থনৈতিক সহ জীবনের নানা দাবি নিয়ে শ্রেণি ও গণ আন্দোলন এবং ভাবাদর্শিক ক্ষেত্রে লড়াই গড়ে উঠছে। মানুষের ভয়ের আগল ঘুচে যাচ্ছে। একজন বলছিলেন - ভয়টা যেমন সংক্রামক, তেমনই সাহসটাও সংক্রামক। মানুষের মধ্যে সেই সাহসের উদ্ভাস দেখা যাচ্ছে।
(তিন)
কিন্তু আগের বছরগুলিতে ছল, বল, অর্থ, ভাঁওতা ইত্যাদির জোরে জনশত্রুরা ক্ষমতার এক বিকৃত স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। ওদের টিকে থাকার মূল উপাদান হিংসা, জিঘাংসা। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ও ভোট লুট করা। হিংসা-জিঘাংসা চালানোর মূল ‘কারিগর’ লুম্পেন - ওঁচা সমাজবিরোধী। তাদের ভরণপোষণের মূল উপাদান অবৈধ পথে অর্জিত লুটের বেলাগাম অর্থ। ‘রাজত্ব’ ছাড়া সেই অর্থের জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। এবারও সেই শয়তানি শুরু হয়েছে। নিজেদের বানানো বোমায় নিজের বাড়ির শিশুরা মারা যাচ্ছে।
তার জন্য গোটা সরকারি ব্যবস্থাপনায়, প্রথম পরিচ্ছদে উল্লিখিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অপরাধগুলি সংঘঠিত করা হচ্ছে। তাছাড়া কোনো সরকারি অফিস থেকে কাজ করাতেও আড়কাঠি চোরগুলোকে টাকা দিতে হচ্ছে। এব্যাপারে বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের কোনো তফাত নেই। যেমন চাকুরি চুরির ব্যাপারে বিজেপি নেতাদের নাম এসে গিয়েছে। আর বিরোধী দলনেতা তো দুর্নীতির একটা বড়ো চাঁই। তৃণমূল ও সেই নেতা একাকার হয়েই দুর্নীতি করেছে।
এখনকার একটা ভালো বিষয়, তৃণমূল ছেড়ে ইতিমধ্যে অনেক গ্রামে ঘোষণা করে দলে দলে, তৃণমূলীদের সঙ্গে হাঁটা মানুষ বামপন্থীদের পক্ষে আসছেন। লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূলের আয়ু সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছে। কিন্তু শয়তানি এক্ষুনি ছাড়বে না। না হলে দেখলেন না, ১০ মার্চের অভূতপূর্ব ধর্মঘটের পরের দিন, ওই লুম্পেনরা ভীতি প্রদর্শনের দুঃসাহস দেখালো। কিন্তু নতুন বিষয়, এবার তারা পর্যুদস্ত হলো।
তার সঙ্গে চলছে মমতার কুনাট্য। তাদেরই কৃতকর্মের জন্য চাকুরি খোয়ানোদের জন্য কুমিরের কান্না কেঁদে, তৃণদলকে, বলা ভালো শেষ পর্যন্ত তাঁকে, যারা চাকরি পাবার জন্য কোটি কোটি টাকা জুগিয়েছে, তাদের চাকুরি ছেদ না করার বায়না ধরছে। কিন্তু ইন্টারভিউয়ে পাশ করা যাঁরা দু’বছর ধরে রোদ-জল-ঝড়কে উপেক্ষা করে প্রাপ্য চাকুরির জন্য ধরনায় বসে আছেন, তাঁদের ব্যাপারে টুঁ শব্দ নেই। টুঁ শব্দ নেই, ন্যায্য চাকরি না পেয়ে যে ছ’জন আত্মহত্যা করলেন, তাঁদের ব্যাপারে। দু-এক জন কুচো চোরকে দল থেকে বের করার ভড়ং দেখিয়ে, মূল ডাকাতগুলোকে ছাড় দিয়ে রেখেছে। মানিককে ছোঁয়ার তো ক্ষমতা হলো না, ক্ষমতা হলো না তো অনুব্রতকেও ছোঁয়ার! চোর-ডাকাতির ব্যবস্থাপনার শীর্ষনেত্রী মুখ্যমন্ত্রীর সেই ক্ষমতা থাকার কথা নয়।
সেজন্য দাবি উঠছে, নাটের গুরু আপনি মুখ্যমন্ত্রী - আপনি পদত্যাগ করুন। অবৈধ চাকুরি খোয়ানোদের প্রতি আহ্বান দেওয়া হচ্ছে - ঘুষের টাকার মূল খাজাঞ্চির দপ্তর কলকাতায় গিয়ে ঘেরাও করুন। গাঁয়ে যে আড়কাঠিদের টাকা দিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করুন।
এক্ষেত্রে কিন্তু প্রগতির পথিকদের দৃপ্ত মেজাজের লড়াই চাই। ভড়ংবাজ মুখ্যমন্ত্রী যাতে কোনো সহানুভূতি কারও কাছে, কোথাও না পায়, সেই জন্য লড়াইয়ের মতো লড়াই লড়তে হবে।
আর একটা কথা, ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতিসত্তাকে অপব্যবহার করে যে বিকৃত কর্মকাণ্ড বিজেপি এবং তৃণমূল চালাচ্ছে মানুষকে বিভাজিত করতে, তার বিরুদ্ধে যুক্তিসম্মত লড়াই চাই। ধর্মভাবনা ও সাম্প্রদায়িকতা যে এক নয় তার আলোচনা বিশেষ জরুরি। অনেক মানুষের চেতনায় এ ব্যাপারে গোলমাল আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা, এক্ষেত্রে লৌকিক বা সহজিয়া ধর্মভাবনার প্রসঙ্গে আলোচনা করলে, অনেক ভুল চিন্তা দূর হয়ে যায়। বিশেষ করে গরিব মানুষের মধ্যে।
আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যে ধর্ম সাধনার মধ্যে সমন্বয়ী ভাবধারার প্রাধান্যই অধিক। সে বিরাট আলোচনা। উদাহরণ সব গ্রামে ছড়িয়ে আছে। সে সবের আলোচনা করলে মানুষের চোখ চক চক করে ওঠে। উদাহরণ, সত্যপীরের গান, মুশকিল আসানের থান পুজো বা মানত ইত্যাদি। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ধলদিঘি মেলার প্রতিষ্ঠাতা পীর করম আলি শাহ ফকির একটা ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন - মারফত বিচার - তার দু’টি লাইন এরকম - ‘আল্লাজির দুই যাইত (জাতি) হিন্দু মুসলমান/ দুই যাইতের (জাতির) দুই দলিল কোরান আর পুরান’। এধরনের বিষয়গুলি প্রচারে আলোচনায় নিয়ে এসে মানুষের মনোজগৎকে মলিনতা মুক্ত করার দায়িত্ব প্রগতিবাদীদের।
আরও বলতে হবে উদাহরণের পর উদাহরণ দিয়ে, বঞ্চিত ও ভাঁওতায় সর্বস্বান্ত মানুষের আলাদা আলাদা জাত-ধর্ম-বর্ণ থাকলেও, আসলে সবাই এক। এই দুর্নীতি অপশাসনের বিরুদ্ধে যে লড়াইগুলো হচ্ছে, সেসব তো জাত-ধর্ম- বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার লড়াই।
দশটা ভাষণ যা না করতে পারে, একটা নাটক, কয়েকটা গান তার থেকে বেশি করতে পারে। এটা আমাদের অভিজ্ঞতা। তাই প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিকে তাদের সৃজন নিয়ে জনতার সংগ্রামের পাশে চাই।
ওরা মরণকামড় দিতে কসুর করবে না। সেজন্যই এই সন্ধিকালে আমাদের দিক থেকে আরও সাহস, জঙ্গিত্ব ও প্রত্যাঘাত দরকার। দরকার আরও বেশি বেশি ধারাবাহিক লড়াই।
দরকার মানুষের কাছে যাওয়া, বার বার করে যাওয়া। এক পর্যায়ে একটা লড়াই হলো, সেখানেই থেমে না থেকে তাকে আরও টেনে নিয়ে যাওয়া। মানুষের কথা শোনা ও তারপর বলার পদ্ধতিই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। তাকে চালু করতে হবে। একটু ভারি কথাও ধীর স্থিরভাবে বোঝাতে হবে। মানুষের সঙ্গে আলাপচারি হবার সময় নমনীয়তার ভাব রাখতে হবে। সবজান্তার ভাব পরিহার করে ধৈর্য ধরে কথা বলতে হবে। মানুষের দাবি নিয়ে বিভিন্ন অফিস কাছারিতে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। তাদের হক আদায় করার সংগ্রাম চালাতে হবে। কথায় ও কাজে মানুষের আপনজন হয়ে উঠতে হবে।
লড়াই-সংগ্রাম-নির্বাচনে মানুষের সর্বজনীন ঐক্য গড়ে ওঠার কতগুলি আশা জাগানিয়া লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তাকে আরও নিশ্চিত করতে হবে প্রগতির পথিক কর্মী বাহিনীকেই। আমরা বড়ো করে বলব - ধনীদের মধ্যে যদি ঐক্য হতে পারে, তবে গরিবদের মধ্যে ঐক্য হবে না কেন! মানুষ বড়ো রতন। তাদের ঐক্য হয়ে গেলে, লম্পট রাজনীতির তল্পিবাহক তৃণমূল - বিজেপি কোন সুদূরে মিলিয়ে যাবে - দেখবেন।