E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯

পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত গণতান্ত্রিক কাঠামো তত্ত্ব ও তথ্য (চার)

ঈশিতা মুখার্জি


পঞ্চায়েতের মূল কর্মকাণ্ড গ্রামোন্নয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। শুধুমাত্র গ্রামোন্নয়ন নয়, গ্রামের সাথে শহরের যোগাযোগও গড়ে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে; অন্তত গড়ে ওঠার কথা।শুরুর দিকে গ্রামের সাধারণ মানুষের তথ্য সংগ্রহ করার জায়গাও ছিল পঞ্চায়েত। সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র হাত ধরে। এ রাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার শ্রেণি অভিমুখ ছিল এবং শ্রেণি আন্দোলনকে ভিত্তি করেই গ্রামোন্নয়ন সংগঠিত হয়েছিল অতীতে। গ্রাম বাংলায় সম্পদ ছিল এবং জাতীয় উৎপাদনের এক বৃহৎ অংশের উৎস ছিল।

গ্রামবাংলার মানুষ কৃষিকাজ ছাড়াও ২০১১ সালের আগে অকৃষিকাজেও নিযুক্ত ছিল। ২০১১ সালের আগে থেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে মানুষ অকৃষি কাজকে বেছে নিতে শুরু করেছিল এবং জাতীয় স্তরে প্রকল্প ভিত্তিক কর্মসূচি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে রূপায়িত হতে শুরু করেছিল। ২০০৮-০৯ সাল অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই এই প্রকল্পগুলি পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই রূপায়িত হতো। সেই সময়ের আর্থিক সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, এনরেগা বা ১০০ দিনের কাজ প্রকল্প, সম্পূর্ণ গ্রামীণ রোজগার প্রকল্প, স্বর্ণ জয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা, ইন্দিরা আবাস যোজনা, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন ফান্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ পরিচালনা প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় সমবিকাশ যোজনা এরকম কেন্দ্রীয় প্রকল্প ছিল। এই প্রকল্পগুলি পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই পরিচালন করা হতো। কিন্তু জলনিকাশি, প্রাকৃতিক সম্পদ, জনস্বাস্থ্য, পানীয় জল, শিশু শিক্ষা কর্মসূচি, সামাজিক সুরক্ষা - এই ক্ষেত্রগুলি পঞ্চায়েতের হাতেই ছিল। কিন্তু পঞ্চায়েতের হাতে ক্ষমতা থাকলেও নয়া উদারীকরণের প্রকোপে পঞ্চায়েতের মূল কাজ দাঁড়িয়েছিল গ্রামবাংলার মানুষকে বেকারি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা থেকে বাঁচানো। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরে গ্রামবাংলায় এমন এক অংশের মানুষ ফিরে আসতে শুরু করে যারা ভূমি সংস্কারের ফলে প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়েছিল। এই সময় থেকেই গ্রামবাংলা থেকে ধীরে ধীরে পরিযায়ী শ্রমিকের যাত্রা শুরু হয় বেশি মাত্রায়, কারণ কৃষি থেকে আয় কমছিল। ২০১১ সালের পর এই পরিযায়ী শ্রমিকের ঢল খুব বেশি বেড়ে গেল, কারণ অকৃষি কাজে গ্রামে সুযোগ কমে গেল। তাই গ্রামের মানুষ আবার কৃষিকাজ লাভজনক না হলেও তাতেই ফিরে এলো।

২০১১ সালের আগে যে হারে কৃষি থেকে অন্য কাজে মানুষ চলে গিয়েছিল, ২০১১-র পর কিন্তু তার থেকে কম হারে কৃষি থেকে মানুষ অন্যত্র চলে গেছে গ্রামের মধ্যে। এর অর্থ গ্রামের মধ্যে কৃষি ছাড়া অকৃষি কাজের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল ২০১১-র আগে, সেই সুযোগ কমে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষি থেকে মোট আয় তো বাড়েনি। তাহলে কৃষি কাজে নিযুক্ত মানুষ বেশি হলে তাদের আয় কমেছে।কৃষিতে স্বনিযুক্তি ২০১১ সালের পর বেড়ে গিয়েছিল। ২০১৮-১৯ সালে গ্রামবাংলার একটি পরিবারের গড় ব্যয় ছিল মাসিক ৪৪১ টাকা, যেখানে সারা দেশে তা ছিল ২৩২৪ টাকা। কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এ রাজ্যে।২০১১ সালের পর থেকেই এ রাজ্যে শুরু হয় কৃষক আত্মহত্যা। গ্রামোন্নয়নের ভিত্তি ছিল কৃষি। পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই গ্রামোন্নয়নের কাজ, অকৃষি কাজ পরিচালনা করা, সংগঠিত করা হতো। কৃষিজীবী মানুষের কৃষির ভিত্তি নড়ে যাওয়া এবং এর সঙ্গে অকৃষি কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার ফলে পঞ্চায়েতের গুরুত্ব কমে গেল। গ্রামোন্নয়নের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল।

ফসলের দাম পেল না কৃষক। ২০১৭ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ফসলের দাম নিয়ে এ রাজ্যে কৃষিপণ্য বাজার সংক্রান্ত যে আইন আনে ২০১৭ সালে তার ফলে এমনিতেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চেয়ে কম পায় এ রাজ্যের কৃষকেরা। বহু কৃষি মান্ডি তৈরি হলেও তা আদৌ কোনো কাজে আসে নি।১৮৬টি কিষান মান্ডি তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল। মান্ডি তৈরিও হয়েছিল। কিন্তু ক্রমে সব জেলাতেই তা পরিত্যক্ত হয়ে যায়; এমনকী সেগুলি শাসকদলের কার্যালয়েও পরিণত হয়ে যায়। কৃষিপণ্য কেনা বেচা থেকে বিরত থাকে সাধারণত মান্ডিগুলি। কিছু গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, কয়েকটি জেলার খবর। হুগলির ১১টি ব্লকে ১০টি মান্ডির প্রতিটি অচল। পূর্ব বর্ধমানের ২৩টি ব্লকে ২০টি মান্ডি হলেও কিছুদিনের জন্য চালু ছিল ৪/৫টি মান্ডি। পূর্ব বর্ধমানের রায়নায় কৃষি মান্ডিতে রয়েছে চায়ের দোকান, গয়নার দোকান, গাড়ির অংশ সারানোর দোকান। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় গোসাবায় খোলা বাজার জমজমাট থাকলেও, সেখানে কিষান মান্ডি কিন্তু জনশূন্য থাকে। শিলিগুড়িতে শালবাড়ি কৃষক মান্ডি সাত বছরেও চালু হয়নি। মুর্শিদাবাদের সুতিতে মান্ডি কৃষি দপ্তরের অফিসারের অফিসঘর। এরকম উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। কৃষকের স্বার্থ দেখে নি রাজ্য সরকার। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অকেজো করে রেখে গ্রামের মানুষকে বাঁচার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। কৃষি এবং অকৃষি কাজ ব্যাহত হওয়ার ফলে পশুপালন গ্রামের পরিবারের কাছে বিকল্প হিসেবেও দাঁড়াতে পারল না। ২০১২-১৩ সালে গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৬৫.২ শতাংশ পরিবার পশুপালন করত। ২০১৮-১৯ সালে সেই অংশ কমে গেল ৫১.৫ শতাংশে। বর্তমানে ভারতে পশুপালন দেশের জাতীয় উৎপাদনে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৃষিতে আয় কমলেও পশুপালনে আয় কিন্তু বাড়ছে। কিন্তু এ রাজ্য এতেও পিছিয়ে রয়েছে। ২০০৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, মালদা, নদীয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ১৮টি গ্রামে সমীক্ষার ফলাফল জানাচ্ছে যে, মানুষের পঞ্চায়েতের সাহায্যে কীভাবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে গেলেও অকৃষি কাজ এবং পশুপালন কৃষি উৎপাদনের সাথে সাথে এই অঞ্চলে জোড় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থাতেও আঘাত এসে পড়ল এবং পশুপালন বর্তমানে পশ্চিমবাংলার গ্রামে বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ দেখাচ্ছে না। এখানেও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অকেজো হওয়ার নিদর্শন পাওয়া যায়।

বর্তমান সরকার গ্রামোন্নয়ন বলতে বহু প্রকল্প বোঝে, কিন্তু এই প্রকল্প রূপায়ণ করতে হলে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে প্রকল্প রূপায়ণের বাধ্যবাধকতা নেই। এছাড়াও রয়েছে পঞ্চায়েতে শাসক গোষ্ঠীর ব্যাপক পরিমাণ দুর্নীতি। প্রকল্প রূপায়ণ আর গ্রামোন্নয়ন তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে সমার্থক হয়ে গেছে। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়ন - এই কথাগুলির বিশেষ কোনো অর্থ আমাদের রাজ্যে নেই। প্রকল্পের কোনো বিকেন্দ্রীকরণ নেই। প্রকল্পের ধারণা, অর্থ এবং প্রাপকদের তালিকা - সবটাই কেন্দ্রীভূত। কোনোটাই বিকেন্দ্রীভূত নয়। তাই পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে জলাজমি, বনাঞ্চল সংরক্ষণ, সর্বজনীন শিক্ষা, শিশু শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা - এই বিষয়গুলির উপর অগ্রাধিকার বজায় রাখা ২০১১ সালের পর আর হয়নি। গোটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থেকেই বিকেন্দ্রীকরণ উঠে গেলে ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘নিজের’ (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা শুধু নিজের নাম দেওয়া) প্রকল্প বহু ক্ষেত্রেই চালু প্রকল্পগুলিকে প্রায় বন্ধ এবং অচল করে দিয়েছে।পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পঞ্চায়েতের উদ্যোগে চালু প্রকল্প নিয়ে রাজ্য সরকারি রিপোর্টে কোনো উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই পঞ্চায়েতের সম্পদ সংগ্রহেরও।

পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে অকেজো করে তোলা হয়েছে ২০১১ সালের পর ধীরে ধীরে। বিভিন্ন গবেষকের রিপোর্টে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ফাউন্ডেশন অফ অ্যাগ্রেরিয়ান স্টাডিজ-এর এক সমীক্ষা হয়েছিল বর্ধমানের কাকসা এবং রায়নায়। সেখানে দেখা যায় যে, বহু পুরনো প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি উদ্যোগ ভালোভাবে চালু করা হয়েছে। রাজ্য সরকার পঞ্চায়েতের কাজ চালানোর জন্য একজন অফিসার নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যদের এই কর্মসূচির বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে সুচতুরভাবে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তাই স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেলেছিল তৃণমূল কংগ্রেস দলের শাসনের সঙ্গে সঙ্গে। নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা প্রকল্প রুপায়ণের কাজে যুক্ত থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে - এমন ব্যবস্থাই চালু হয়ে গিয়েছিল।

২০১১ সালের আগে আমরা এই লেখার প্রথম কিস্তিতে দেখেছি, যে কোনো পেশার মানুষ বেশি পঞ্চায়েতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেখানে প্রান্তিক কৃষক থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্থাৎ গ্রামের সাধারণ মানুষেরাই পঞ্চায়েতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং এইভাবেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র বজায় ছিল। পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসার ফলে প্রকল্পের স্বচ্ছতাও বজায় থাকত। কিন্তু ২০১১ সালের পর নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনেই তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা গড় পারিবারিক সম্পদের চেয়ে ২২ গুণ বেশি সম্পদের অধিকারী ছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আমরা দেখলাম যে, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র বেশিরভাগ প্রভাবশালী প্রার্থীরা যাঁরা জিতে এলেন তাঁরা বিত্তবান এবং সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে তারা নির্বাচন করেছিল। সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে ছিল হিংসার বাতাবরণ। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট মনোনয়ন পর্ব থেকেই ছিল হিংসাত্মক এবং রক্তাক্ত। রেকর্ড সংখ্যক আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয় এবং বিরোধী দলকে মনোনয়ন পেশ করতে দেওয়া হয় নি। এই পরিমাণ হিংসা কেন? একমাত্র দুর্নীতির পাহাড় জিইয়ে রাখা ছাড়া এই মারাত্মক রেকর্ড হিংসার কোনো কারণ নেই। গ্রামে দুর্নীতি এই সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত ব্যপ্তি লাভ করেছে। বিশেষ করে খনিজ অঞ্চলে কয়লা পাচার, সীমান্ত দিয়ে গোরুপাচারকে ঘিরে দুষ্কৃতী অপরাধী চক্রকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্যই ২০১৮ সালে এই হিংসা সংগঠিত হয়েছিল।

আর্থিক দুর্নীতির সাথে সাথে গ্রামোন্নয়ন ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। মোট ঘোষিত প্রকল্পের সংখ্যা ৫৫। এর মধ্যে কর বাবদ রাজস্ব আয়ের ২৩.৮ শতাংশ চলে যায় ৪টি প্রকল্পে। এই তথ্য ২০২২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়ে বলে যে, এই প্রকল্পের ভার বহন করার আর্থিক ক্ষমতা নেই সরকারের। এই বছরে রাজ্য বাজেটে আর্থিক ঘাটতি সর্বকালীন রেকর্ড ৬৫৮৩৮.৯২ কোটি টাকা। একদিকে আর্থিক দুর্নীতির পাহাড়, অন্যদিকে একগুচ্ছ প্রকল্প যার আর্থিক সংস্থান নেই। এটাই পশ্চিমবঙ্গে গ্রামোন্নয়নের আকৃতি। এর ফলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

(ক্রমশ)