৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ-এ-আজম ভগৎ সিং-এর ভূমিকাঃ সন্ত্রাসবাদ থেকে মার্কসবাদে উত্তরণের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড
সুস্নাত দাশ
রাজগুরু, ভগৎ সিং, সুকদেব।
।। এক ।।
শহিদ-এ-আজম ভগৎ সিং ফাঁসিকাষ্ঠে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন লাহোর কারাগারে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ। অনেকে ঠিক অবগত নন যে, তিনি ছিলেন এক ঐতিহাসিক বিপ্লবী পরিবারের সন্তান। ভগৎ সিং-এর যখন মাত্র তিন বছর বয়স তখন ১৯১০ সালে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেন তাঁর এক খুড়ো স্বর্ণ সিং। বস্তুত ভগৎ সিং-দের পরিবারের পরম্পরাগত ঐতিহ্যই ছিল সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম। বাল্যকালে প্রথমে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহ দর্শন এবং কিছু পরে পিতৃব্যর আপসহীন বৈপ্লবিক গণ-আন্দোলনের রাজনীতি ভগৎ সিং-কে প্রভাবিত করে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, (১) ভগৎ সিং সন্ত্রাসবাদকে লক্ষ্য অর্জনের চরম ও একমাত্র পন্থা রূপে কখনোই গ্রহণ করেননি। (২) তাঁর মধ্যে জাতীয় আন্দোলনের সবগুলি ধারাই কোনো না কোনো পর্যায়ে সক্রিয় ছিল - যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছিল মার্কসবাদী চেতনা ও জীবনদর্শনে উত্তরণের মধ্য দিয়ে। (৩) আদতে ভগৎ সিং শুধু একজন বিপ্লবীমাত্রই ছিলেন না, তাঁর ছিল লেনিনের মতোই ‘‘বুদ্ধিজীবী বিপ্লবী’’ সুলভ নেতৃত্বদানের অসামান্য প্রতিভা যদিও মাত্র ২৩ বছরের অসম্পূর্ণ জীবন হয়তো বা পরবর্তীকালের লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী নায়ক চে গুয়েভারার মতনই পূর্ণ রূপে প্রস্ফুটিত হতে পারল না, কিন্তু আলো জ্বালিয়ে গেল লক্ষ প্রাণে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ভগৎ সিং ও তাঁর সাথিরা দিল্লির ফিরোজ শা কোটলা মাঠে সমবেত হয়ে (১৯২৮-এর ৯-১০ সেপ্টেম্বর) গড়ে তোলেন ‘হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (আর্মি)’। এই সংগঠন তখন থেকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট নীতিগুলি প্রচারের জন্য সচেষ্ট হয়। ‘শ্রমিক-কৃষকদের সংগঠিত করে সশস্ত্র বিপ্লব’ ঘটানো এবং ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সকল উৎপাদনের উপকরণ জাতীয়করণের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে থাকে। এই সংগঠনের প্রভাব সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও পড়েছিল। ১৯২৮ সালে যখন হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্র আগ্রায় স্থানান্তরিত হলো, ভগৎ সিং তৎক্ষণাৎ একটি ছোটো গ্রন্থাগার স্থাপন করেন। এখানে তিনি অর্থনীতি চর্চার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। তখনকার একজন পঞ্চদশ বর্ষীয় বালককে কীভাবে ভগৎ সিং কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল গ্রন্থটি পাঠে উৎসাহিত করেন তা পরে জানা গেছে। নবগঠিত দল ‘হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (আর্মি)’ তার পরিবর্তিত লক্ষ্যের কথা এবং জনগণের বিপ্লবে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত নিল। ‘জন নিরাপত্তা বিল’ ও ‘শিল্প-বিরোধ বিল’ অর্ডিন্যান্স রূপে পাশ করানোর বিরুদ্ধে ১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা ফেলার দায়িত্ব নিলেন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত। এই দু’টি বিল নাগরিকদের ও বিশেষভাবে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করত। হত্যা করা এই বোমা ফেলার উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ এগুলি ছিল অত্যন্ত কম শক্তির পটকা মাত্র। প্রসঙ্গত, এই বোমা তৈরির উদ্দেশ্যেই কলকাতা থেকে যতীন দাসকে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আইনসভায় ছড়ানো প্রচারপত্রটি লেখেন ভগৎ সিং, যাতে বলা হয়, এর উদ্দেশ্য ছিল ‘বধিরকে শুনতে বাধ্য করা।’ (It takes a loud voice to make a deaf hear; Special Evening edition, Hindustan Times; 8 April, 1929, Delhi) একাজের আসল উদ্দেশ্য ছিল গ্রেপ্তার হয়ে বিচার আদালতকে প্রচারের মঞ্চে পরিণত করা।
এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাজের পূর্বে অবশ্য ভগৎ সিং ও তাঁদের সহকর্মী রাজগুরু ১৯২৮-এর ১৭ ডিসেম্বর লাহোরে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে পুলিশকর্মীকে গুলি করে হত্যা করে ব্যক্তিসন্ত্রাসের শেষ ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন। সাইমন কমিশন বিরোধী বিক্ষোভের সময় পুলিশ সুপার স্কট এবং সন্ডার্সের লাঠির আঘাতে (৩০ অক্টোবর, ১৯২৮) গুরুতর আহত হয়ে ১৭ নভেম্বর হাসপাতালে মারা যান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি ও পাঞ্জাবের সর্বমান্য শ্রদ্ধেয় নেতা লালা লাজপত রায়। শিববর্মা লিখেছেনঃ জাতির অপমানের প্রতিশোধের জন্য লালাজির হত্যাকারীর নিধন প্রস্তাব দিল ভগৎ সিং। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে বাধ্য হওয়ার জন্য তিনি অত্যন্ত দুঃখী হয়েছিলেন। কারণ ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি তিনি তখন মানসিক ও আদর্শগতভাবেই পরিত্যাগ করেছিলেন। এই বক্তব্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় ছড়ানো ইশ্তেহারেও মুদ্রিত ছিল। কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা ফাটানোর সময় ভগৎ সিং-এর কোনো অস্ত্র আর ছিল না। আত্মরক্ষার চেষ্টাও তিনি করেননি। শুধু ধ্বনি তুলেছিলেন ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। ১৯২৯-এর ৮ এপ্রিল থেকে ২৩ মার্চ ১৯৩১-এ ফাঁসির দিন (ভগৎ সিং-এর দাবি ছিল তাঁদের গুলি করে মারা হোক, কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁরা ভারতীয় সৈনিক যুদ্ধবন্দি-মর্যাদাকর মৃত্যু তাঁদের প্রাপ্য) পর্যন্ত নানা কারণে বহু রচনা লেখেন, যাতে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তায় ও বৌদ্ধিক উৎকর্ষতার মহত্ত্বও পরিপক্কতা সুস্পষ্ট। বোঝা যায়, কেন ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র ভগৎ সিং-কে একজন বড়োমাপের বুদ্ধিজীবী রূপে চিহ্নিত করেছেন।
।। দুই ।।
পাঞ্জাবের লায়লপুর জেলার বগাঁ গ্রামের সেই ছেলেটা বদলে গিয়েছিলেন অনেকটা। সংস্পর্শে এসেছিলেন কানপুরের গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থীর। পাঞ্জাবের কুকা বিদ্রোহ, গদর পার্টির কার্যকলাপ, কর্তার সিং, সুফী অম্বাপ্রসাদ প্রমুখের জীবনকথা তথা বব্বর-অকালীদের বীরত্ব কাহিনি তাঁকে জাতীয় বিপ্লববাদের দিকে টেনেছিল। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (যাতে ভগৎ সিং নামের দু’জন শহিদ হন।) তাঁকে উত্তেজিত করতো। ১৯২৩ সালে তিনি গৃহত্যাগ করেন। এই সময় তাঁর পিতা সর্দার কিষণ সিং ভগৎ-এর বিবাহ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পিতাকে প্রণাম জানিয়ে যে পত্র রেখে তিনি বাড়ি ছাড়েন প্রায় ১৭ বছর বয়সে, তাতে লেখেন, ‘‘আমার জীবন এক সুমহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য উৎসর্গীকৃত। তাই জাগতিক সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা, আরাম-আয়েসের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই।’’ লাহোরে ১৯২৬ সালে ভগৎ সিং, সুখদেব, ভগবতীচরণ ভোরা, যশপাল প্রমুখ ‘নওজওয়ান ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল কার্যত গুপ্ত বিপ্লবী আন্দোলনের প্রকাশ্য মঞ্চ। জনসভা, বক্তৃতা, ইশ্তেহার প্রভৃতি মারফত বিপ্লববাদের প্রচারই ছিল এর প্রধান কাজ। ভগৎ সিং ছিলেন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের গান্ধীবাদী সংস্কারবাদী নীতির সমালোচনা করে জনগণকে বিপ্লবী-উগ্র রাজনীতিক কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করা। উত্তর ভারতের বিপ্লবীদের হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন-এর দ্বারা (অক্টোবর ১৯২৪ সালে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত) ইতিপূর্বে ১৯২৫-এর ৯ আগস্ট লক্ষ্ণৌর কাছে কাকোরি নামক গ্রামের কাছে দুঃসাহসী রেল-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রামপ্রসাদ বিসমিল, আস্ফাকুল্লা খাঁ, রোশন সিং ও রাজেন্দ্র লাহিড়ীর ফাঁসি হয়। চন্দ্রশেখর আজাদ গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। ভগৎ সিং, জয়দেব, শিব বর্মারা একাধিকবার চেষ্টা করেও রামপ্রসাদকে জেল থেকে বার করে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সাম্যবাদ তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ভগৎ সিং-এর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল অক্লান্ত পড়াশোনার মাধ্যমে। ইংরাজি, ফরাসি, রুশ চিরায়ত ও বিপ্লবী সাহিত্যপাঠ ছিল ভগতের দৈনন্দিন কার্যেরই অঙ্গ। একটি পুস্তক ও একটি পিস্তল ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। এইভাবে ভিক্টর হুগো, ডিকেন্স, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, গোর্কি, বানার্ড শ, মার্কস-এঙ্গেলস, বাকুনিন, লেনিন সবরকমের রাজনৈতিক বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। বক্তৃতা ও কলমের জোর দুই-ই ছিল তার। হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি ও ইংরেজি ভাষাতেও তাঁর ছিল সমান দখল। সোহন সিং যোশের ‘কীর্তি’ (অমৃতসর), ‘প্রতাপ’ ও ‘প্রভা’ (কানপুর); ‘মহারথী’ (দিল্লি) ও চাঁদ (এলাহাবাদ) প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য রাজনৈতিক ও বিপ্লবী রচনা ভগৎ সিং লেখেন। আর ইংরেজিতে রচিত তাঁর রচনা, আদালতে পেশ করা বক্তব্য, চিঠিপত্র, ইশতেহার প্রভৃতি একইভাবে ভগৎ সিং-এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রকাশ-শৈল-উৎকর্ষতার প্রমাণ। প্রচার ও জনসংযোগের কাজে এত নিষ্ঠা ও গুরুত্ব প্রদর্শন সমসাময়িককালে কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহ্মদ ছাড়া আর একমাত্র ভগৎ সিংয়ের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল। এই দু’জনের মধ্যে অদ্ভূত মিল ছিল - উভয়েই আদালতকে মতবাদ প্রচারের মাধ্যম রূপে গ্রহণ করেছিলেন।
বস্তুত ১৯২৮ সালে যখন হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রেভেলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্র আগ্রায় স্থানান্তরিত হল, ভগৎ সিং তৎক্ষণাৎ একটি ছোটো গ্রন্থাগার স্থাপন করেন। এখানে তিনি অর্থনীতি চর্চার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন।
মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী রূপে ভগৎ সিং-এর পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কারা-জীবনের দিনগুলিতে। আদালতে শুধু বোমা মামলা নয়; কাকোরি, লাহোর সহ নানা সাজানো মামলায় ভগৎ নেতৃত্বের ভূমিকায়। কারাবন্দিদের মানবিক সুযোগ-সুবিধাদানের আন্দোলনে, অনশনে, আদালতকক্ষে - সর্বত্রই তাঁর পরামর্শে সকলে চলেন। আদালতে তাঁদের নির্ভীক লড়াইয়ের সংবাদ বাইরে প্রকাশ হতো এবং জনগণ উত্তাল হয়ে উঠত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতায়। কিন্তু তাঁদের মুক্তির জন্য জাতীয় নেতা রূপে গান্ধীজির যে সক্রিয়তা প্রয়োজন ছিল - তা মিললো না। কংগ্রেসের সরকারি ইতিহাস-রচয়িতা পট্টভি সীতারামাইয়া না বলে পারেননি, ‘‘ভগৎ সিং-এর আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শ্রেণি সংগ্রামের লাইন গান্ধীজির আপসমুখী রাজনৈতিক জোর ধাক্কা দিয়েছিল এবং গান্ধী ভগৎ সিং-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন।’’ বস্তুতই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভগৎ সিং-এর আদর্শ ও চিন্তার মধ্যে বলশেভিজমের মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা দেখে যেমন ভীত হয়ে উঠেছিল, গান্ধীজিও এক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব শ্রেণিচিন্তার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন।
ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডগণ প্রতিদিন আদালতে প্রবেশ করতেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’; ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘প্রলেতারিয়েত বিপ্লব জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনি দিতে দিতে। গাইতেন ‘সরফরোসি কি তমন্না অব হামারে দিল মে হ্যায়। দেখলেনা জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মে হ্যায়।’ (আমাদের হৃদয় এখন আত্মত্যাগের আকাঙ্খায় পরিপূর্ণ। দেখে নেব খুনিদের হাতে কত জোর আছে), ‘রঙ দে বাসন্তী চোলা’ প্রভৃতি গান। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মডার্ন রিভিউ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটিকে ‘হিংসা ও অরাজকতার’ প্রতীক রূপে বর্ণনা করা হয়েছিল। এর জবাবে ভগৎ সিং একটি রচনা (২৩ ডিসেম্বর, ১৯২৩) সহযোদ্ধা বটুকেশ্বর দত্তের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। তিনি লিখেছিলেনঃ ‘‘স্লোগান আমি সৃষ্টি করিনি। রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনে এই স্লোগান উঠেছিল। বিখ্যাত সমাজবাদী লেখক আপটন্ সিনক্লেয়ার তাঁর বোস্টন এবং অয়েল উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের মুখে এই স্লোগান দিয়েছেন। এই স্লোগানের অর্থ এই নয় যে সশস্ত্র সংগ্রাম চিরকাল চলতেই থাকবে এবং দেশ ও সমাজের বুকে অরাজকতা চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার হতে হতে এই স্লোগান বিশেষভাবে অর্থবহ হয়ে উঠছে।... বিপ্লবীদের কাছে এটি একটি পবিত্র বাক্য। ট্রাইব্যুনালের সমক্ষে আমার বক্তব্যে এই কথাই পরিষ্কার করে বলবার চেষ্টা করছি যে বিপ্লবের (ইনকিলাব) অর্থ সশস্ত্র আন্দোলন হতেই হবে এমন নয়। কখনো কখনো বোমা-পিস্তল বিপ্লব সফল করার উপায় মাত্র হতে পারে। এতেও কোনো সন্দেহ নেই।... কিন্তু কেবল মাত্র এই কারণেই বোমা-পিস্তল ও বিপ্লব সমার্থক হতে পারে না।... এই স্লোগানে বিপ্লব শব্দের অর্থ হলো প্রগতির জন্য পরিবর্তনের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা। মানুষ সাধারণত প্রচলিত গতানুগতিকতার সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায় যে পরিবর্তনের কথা ভাবামাত্রই কাঁপতে থাকে। এ হলো একধরনের জড়ত্বের মানসিকতা, একে উৎখাত করে বিপ্লবী মানসিকতা জাগিয়ে তোলা আজ দরকার।’’
ভগৎ সিং ও তাঁর কমরেডরা যে মার্কসবাদকে জীবনের ধ্রুবতারা করে নিয়েছে, তার নিদর্শন কারাগার ও আদালতকক্ষ থেকে প্রচারিত ভগৎ সিং-এর জবানবন্দি ও ইশ্তেহারগুলি। ‘স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার’ শীর্ষক জবানবন্দিতে বলা হয়ঃ ‘‘সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক - সমস্ত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে, তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি, গোটা সমাজব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায়, তবে মানব সভ্যতার পরিণতি বড়ো ভয়ানক।’’
।। তিন ।।
ভগৎ সিং-এর জীবনের শেষ দুই বছর কেটেছিল বন্দি রূপে কারান্তরালে। লাহোরের জেলখানায় তিনি নিজস্ব সময়গুলি বৃথা বয়ে যেতে দেননি। তাঁর জেল-নোটবুক অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, যাতে দেখা যায় তা তাঁর বৈদগ্ধ্য ও অমূল্য চিন্তাদর্শ সমন্বিত মণিমুক্তাখচিত। কার্ল মার্কস, লেনিন, ট্রটস্কি, বাকুনিন, বার্টান্ড রাসেল, ইংরেজ কবি টেনিসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ অজস্র চিন্তাবিদ, কবি, দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম ও বাণী খোদিত রয়েছে; পাশাপাশি ছিল ভগৎ সিং-এর নিজের করা নানা প্রাসঙ্গিক মন্তব্য। রয়েছে জ্যাক লন্ডনের বিখ্যাত উপন্যাস আয়রন হিল-এর মতো অনেক ক্লাসিক সাহিত্যের বড়ো বড়ো উদ্ধৃতি। জানা যায়, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর হাতে ছিল লেলিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লবগ্রন্থ। কমরেড জয়দেব গুপ্তকে কারাগারে পাঠানোর জন্য যে বই-এর তালিকা তিনি দিয়েছিলেন (২৪ জুলাই, ১৯৩০) তার সবগুলিই ছিল মার্কসবাদকে-লেনিনবাদকে ভাল করে রপ্ত করার কাজে লাগে এমন সব গ্রন্থ। সুতরাং একজন বিপ্লবী-বুদ্ধিজীবী রূপে ভগৎ সিং-এর স্থান নিসন্দেহে অনেক ঊর্দ্ধে যার সম্পূর্ণ মূল্যায়ন আজও হয়নি বলেই মনে হয়। বিশেষ করে জেলে বসে লেখা তাঁর দু’খানি অনবদ্য সন্দর্ভঃ ১) তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি (To Young Political Workers) ও ২) কেন আমি নাস্তিক (Why I Am An Atheist)? - তাঁকে সমসাময়িক ভারতীয় সশস্ত্র-বিপ্লবীদের মধ্যে অতুলনীয় স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
‘তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি’ শীর্ষক ইশ্তেহার (২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১) ছিল ভগৎ সিংদের মার্কসবাদী অঙ্গীকারের চরমতম নিদর্শন। এতে বলা হয়ঃ ‘আমরা চাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’।
‘কেন আমি নাস্তিক’ রচনায় মার্কসবাদী তথ্যানুসারেই তিনি ধর্মের উদ্ভব নিয়ে ব্যাখ্যা দেন এবং সকল ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, অস্পৃশ্যতা দূর করা প্রকৃত বিপ্লবীর অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেন। ‘‘মানুষের দূর্বলতার আধারেই ধর্মীয় দর্শনের জন্ম ‘‘এই মার্কসবাদী প্রত্যয়ে ভগৎ সিং দৃঢ় আস্থাশীল ছিলেন।
শহিদ ভগৎ সিংরা চেয়েছিলেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ রণধ্বনি তাঁদের মাধ্যমে পৌঁছে যাক দেশের প্রতিটি প্রান্তে। সন্দেহ নেই সে কাজে তাঁরা সম্পূর্ণ সফল হন। ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ডিফেন্স কমিটি’র কাছে পেশ করা এক পত্রে (১৯ মার্চ, ১৯৩১) ভগৎ সিং মুক্তকণ্ঠে বলেনঃ ‘‘আমি এই কথা বলতে চাই, যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং যতদিন ভারতীয় জনগণ এবং শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার উপায়গুলির ওপর ক্ষমতাশালী ব্যক্তির একাধিপত্য কায়েম থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে, তা সে ক্ষমতাশালী ইংরেজ পুঁজিপতি শাসকই হোক অথবা পুরোপুরি ভারতীয় হোন। যদি বিশুদ্ধ ভারতীয় পুঁজিপতিদের দ্বারাই গরিবের রক্ত শোষণ চলতে থাকে, তাহলেও পরিস্থিতি অধিক পরিবর্তন হবে না।’’ বিপ্লবী সাথিদের উদ্দেশে লেখা ভগৎ সিং-এর শেষ চিঠির শেষাংশ ছিল এরকমঃ
‘সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল একথা গোপন করতে আমি সানন্দে, হাসিমুখে এমনভাবে ফাঁসির রজ্জুকে বরণ করতে চাই, যা দেখে ভারতের ঘরে ঘরে মায়েরা প্রার্থনা করবে তাঁদের সন্তান যেন ভগৎ সিংয়ের মতো হয়ে ওঠে। আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মদান করতে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ এগিয়ে আসবে যে সাম্রাজ্যবাদ তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও বিপ্লবের অগ্রগতিকে রুখতে পারবে না।’’
ভগৎ সিং-এর ফাঁসির সংবাদে তাঁর বীরাঙ্গনা মাতা বিদ্যাবতীর প্রতিক্রিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি লাহোরের এক জনসভায় উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনঃ ‘‘...ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আমি বলতে চাই, আমার আর যে দু’টি পুত্র আছে, তাঁদেরও দেশের সেবায় আমি উৎসর্গ করলাম। শয়তান, তোমাদের লালসা যদি আজও তৃপ্ত হয়ে না থাকে, তবে এই দুই পুত্রকেও তোমরা শেষ করো।’
আমরা আশ্চর্য হই না, যখন দেখি ভগৎ সিং-এর মৃত্যুদণ্ডের পরেও ওই একই নামের অন্তত আরও পাঁচজন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে শহিদ হয়েছেন।