৬০ বর্ষ ৩২ সংখ্যা / ২৪ মার্চ, ২০২৩ / ৯ চৈত্র, ১৪২৯
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (তিন)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● বেদ - মানব মননের প্রাচীনতম দলিল হিসাবে বেদকে ব্যাখ্যা করা হয়। বৈদিক সভ্যতার আদি ইতিহাসের কোনো লিখিত ভাষ্য এখনও পর্যন্ত আমাদের জানা নেই। বেদ বলতে কোনো একটি গ্রন্থবিশেষ বোঝায় না। প্রায় শতাধিক গ্রন্থের সমষ্টি বোঝায়। বেদকে প্রধানত চারটি শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১। ‘সংহিতা’ বা সংগ্রহ - গান, স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতির সংকলন।
২। ‘ব্রাহ্মণ’ - গদ্যে রচিত একজাতীয় যাগযজ্ঞ বিষয়ক সুবিশাল সাহিত্য।
৩। ‘আরণ্যক’ - অরণ্যে রচিত একজাতীয় সাহিত্য, বিশ্ব রহস্যের সমাধান অন্বেষণই তার প্রধান উদ্দেশ্য।
৪। ‘উপনিষদ’ - আক্ষরিক অর্থে তথ্যজ্ঞান, দার্শনিক তত্ত্বের বিচারই উপনিষদের প্রধান বিষয়বস্তু। অতএব, ‘আরণ্যক’ ও ‘উপনিষদ’-এর মধ্যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে পার্থক্য সুস্পষ্ট নয়; কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক না কেন, বেদান্ত-সম্প্রদায়ের পরবর্তী দার্শনিকরা ‘আরণ্যক’-এর বদলে ‘উপনিষদ’-এর ওপরই অনেক বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
● লিখিত ভাষার অনুপস্থিতির ফলে বেদের স্তোত্রগুলি বংশ পরম্পরায় মৌখিকভাবে প্রসারিত হয়েছিল। এই কারণে বেদকে ‘শ্রুতি’ নামে অভিহিত করা হয়। বেদের লিখিত রূপ অনেক পরে সংকলিত হয়। এই সংকলনের অন্য নাম ‘সংহিতা’।
● অনেকেই মনে করেন বেদ সর্বজ্ঞানের আধার। বিদেশিরা এই সমস্ত আমাদের থেকে অর্থাৎ বেদের থেকে গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বেদকে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বাণী বলে ব্যাখ্যা করেন। বেদ বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত বেদের বিষয়বস্তু থেকে বোঝা যায়, এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। চারটি বেদ হলো যথাক্রমে ঋক্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। চারটি বেদের মধ্যে অথর্ববেদ-এর রচনাকাল অনেক পরে। ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ-এর বিন্যাস ও ভাষাশৈলীসহ এগুলি বিষয়গতভাবে এক এবং প্রায় সমসাময়িককালের।
● ঋক্ বেদ - বেদগুলির মধ্যে ঋক্ বেদই প্রধান। এতে ১০,৫৫২টি স্তোত্র রয়েছে। এগুলিকে ‘ঋক্’ বলা হয়। ঋক্গুলি আবার ১০২৮টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। এগুলিকে ‘মুক্ত’ বলা হয়। এই অধ্যায়গুলি আবার ১০টি ‘মণ্ডল’-এ বিভক্ত। প্রথম মণ্ডলে রয়েছে ২০০০টি স্তোত্র। এগুলি কমবেশি পনেরো জন ঋষি রচনা করেছেন বলে মনে করা হয়। বলা যায়, সমগ্র ঋক্ বেদ শতাধিক ঋষির যৌথ রচনা। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মতে ঋক্ বেদের দশম মণ্ডল মূল ঋক্ বেদের অংশ নয়।
● সাম বেদে রয়েছে ১৭৯১টি ঋক্ বা স্তোত্র। এর মধ্যে ১৭১৫টি স্তোত্র, ঋক্ বেদ থেকে পুনর্লিখিত হয়েছে। এমনভাবে পুনর্লিখিত হয়েছে যে, সেগুলি গীত-বাদ্যসহ সুর করে গাওয়া যেতে পারে। সাম বেদকে সঙ্গীতের প্রাচীনতম আধার বলেও অভিহিত করা হয়। সাম বেদের প্রধান কথা গান, সাহিত্য নয়। ‘The text is only a means to an end. The essential element is always the melody.’ - বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে রচনা থেকেই প্রসূত হয়।
● যজুর্বেদ কথাটি যজ অর্থাৎ ‘নৈবেদ্য’ বা ‘বলি’ শব্দ থেকে। ঈশ্বরকে তুষ্ট করতেই যজ্ঞ করা হয় এবং যজ্ঞের মাধ্যমে নৈবেদ্য বা বলি প্রস্তুত করা হয়। বৈদিক যুগের আগে বা পরে অন্যত্রও ‘বলি’ ধারণা প্রচলিত ছিল। এখনও বিভিন্ন উৎসবে, বিশেষকরে গ্রাম্য উৎসবে নানাভাবে গ্রামদেবতার উদ্দেশে ‘উৎসর্গ’ বা ‘বলি’ দেখতে পাওয়া যায়। যজুর্বেদ হলো যজ্ঞে বলি উৎসর্গ করার মন্ত্রের সংকলন। মন্ত্র হলো দেবতাকে তুষ্ট করা তথা দেবতাকে প্রশংসার বাণী। যজ্ঞ সম্পাদনের নিয়মকানুনও এতে লিখিত রয়েছে। আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলে হ্যান্ডবুক বা ম্যানুয়েল (Handbook or Manual), যজুর্বেদ হলো যজ্ঞ সম্পাদনের হ্যান্ডবুক-এর রচনাকাল সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থাগুলি ক্রমান্বয়ে কঠোর হচ্ছিল, বৃদ্ধি পাচ্ছিল সমাজে শ্রেণিভেদ। তাই যজুর্বেদ আরও কঠোর ও অলঙ্ঘনীয় হয়ে পড়েছিল।
● অথর্ব বেদে রয়েছে ২০টি অধ্যায় ও ৭৩১টি সূক্ত। ৭৩১টি সূক্তর অধীনে রয়েছে ৫০০০-এর বেশি ঋক্ বা স্তোত্র। অথর্ব বেদ পরলোকের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তব জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। স্বভাবতই সমসাময়িক বস্তুজগৎ ও তার মধ্যে নিহিত দ্বন্দ্বগুলির প্রতিফলন অথর্ব বেদের মর্মবস্তু। হয়তো এই কারণেই অথর্ব বেদ কৌলিন্য বঞ্চিত। দীর্ঘকাল পর অথর্ব বেদকে চতুর্থ বেদের মর্যাদা দেওয়া হয়।
বেদের সময়কাল
● বেদের প্রবর্তক ছিলেন এই উপমহাদেশে আগত ইন্দো-আর্য জাতি। চারটি বেদের প্রাচীনতম ঋক্ বেদ খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-১৫০০ সময়কালে রচিত। ঋক্ বেদ রচনার শেষ পর্যায়ে ইন্দো-ইরানী পশুপালক উপজাতি গবাদি পশুর চারণভূমির সন্ধান করতে করতে এই উপমহাদেশে প্রবেশ করে। অথর্ব বেদের সময়কাল হলো খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-১০০০। এর অর্থ হলো মধ্যবর্তী এই সুদীর্ঘ সময়কালে আর্যরা এদেশে প্রবেশ করেছিল। তবে বেদ রচনার সময়কাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাক্স মুলার (Max Mueller) সহ প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদের মতে ঋক্ বেদ সংহিতার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-১০০০। জ্যাকবির মতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ থেকে ঋক্ বেদের রচনাকাল শুরু। তবে বিশেষজ্ঞরা একটি ব্যাপারে সকলে সহমত যে, মহাবীর জৈন ও গৌতম বুদ্ধের আগেই সমগ্র বৈদিক সাহিত্য পূর্ণাঙ্গ রূপ গ্রহণ করেছে। সেইজন্যই বহু গবেষক জোর দিয়ে বলেন যে, খুব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বা ২৫০০-তেই এর রচনাকাল শুরু হয়েছিল। এই সময়কালে এদেশের আদিবাসীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মিলনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছিল। এই সময়কালে ভারতীয় সমাজে শ্রেণি-বিভেদের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল।
● এটা ঠিকই সমগ্র বৈদিক সাহিত্য কম করে ১০০০ বছর নিয়েছিল সম্পূর্ণ হতে। এই সময়কালে ক্রমান্বয়ে ভারতীয় সমাজে সেই স্তর উপনীত হয়েছিল যখন মানুষ নিজের প্রয়োজনের বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হলো। এর ফলে মানবসমাজের একাংশ তাদের টিকে থাকার জন্য কায়িক শ্রমের প্রয়োজন থেকে বিযুক্ত হলো। অন্যের দ্বারা উৎপাদিত উদ্বৃত্ত তাদের দৈহিক অস্তিত্বের প্রয়োজন মেটাল। এর ফলে তারা চিন্তা-ভাবনা নির্ভর কাজের দক্ষতা গড়ে তোলার সুযোগ পেল। চেতনার গঠনমূলক কার্যধারা অর্থাৎ যুক্তির শক্তিকে উপলব্ধি করা ও স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হলো। বেঁচে থাকার সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকা থেকে মুক্তি, তাত্ত্বিক কার্যধারার পূর্ণ রূপে শুরু সম্ভব ছিল না।
বেদের বিষয়বস্তু
● পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে ঋক্, সাম ও যজুর্বেদ, এই তিনটি বেদের বিষয়বস্তু এক। মহাকবি কালিদাসসহ আধুনিক সংস্কৃত ভাষায় লেখকদের ভাষার সঙ্গে বৈদিক ভাষার অনেক পার্থক্য। কিছু বৈদিক স্তোত্রে এমন শব্দ রয়েছে যা লিখিত আকারে প্রকাশ করা যায় না। বেদের বিষয়বস্তু নিয়ে নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের মতে, ‘‘বিভিন্ন মতামত... ঋক্ বেদের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতির ইঙ্গিত দেয়।’’ এটি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মননের ফসল বলেই চিন্তার বিভিন্ন স্তর লক্ষ করা যায়। তাই বলা যায়, ঋক্ বেদ ধর্ম ভাবনার এক অপরিশীলিত সময়ের পরিণাম। সহজ-সরল স্তোত্র ভারাক্রান্ত ঋক্ বেদ আসলে পরিশীলনহীন। কিছুটা শেষ পর্যায়ে, বিশ্ব প্রকৃতি ও মানুষের অবস্থানের সচেতন বিশ্লেষণ মার্জিত ভাবনার প্রতীক।
● বৈদিক স্তোত্রগুলির বৈশিষ্ট্য হলো বহু দেব-চরিত্রের উপস্থিতি ও তার উপাসনা। এক্ষেত্রে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ডঃ রাধাকৃষ্ণণের মতে, ‘‘মানুষের মনের গভীরে এত ঈশ্বরের উপস্থাপনা ঋক্ বেদ ছাড়া অন্যত্র দেখা যায় না। ...প্রকৃতির নানা শক্তির সাথে সাযুজ্য রেখে ধীরে ধীরে বৈদিক দেবতারা নৈতিক ও অতিমানবীয় স্তরে উন্নীত হয়েছিল। বৈদিক স্তোত্রগুলির আদি স্রষ্টারা প্রকৃতিকে ভালবেসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বিস্ময়ে অভিভূত হতে জানতেন। তাঁরা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতেও জানতেন।’’ প্রকৃতির এই উপাসনাই বৈদিক ধর্মের প্রাচীনতম রূপ। বায়ুর দেবতা হিসাবে বরুণকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ধরিত্রীও দেবতা; সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রও দেবতা হিসাবে স্বীকৃত। পর্বত, নদী, অগ্নি সকলেই দেবতার স্বীকৃতি পেয়েছিল। ইন্দ্র অবশ্য দেবতা হিসাবে অনেকপরে সংযোজিত হয়েছিল।
● চিন্তা বা ধ্যানের আয়োজন ছিল, তবে মূর্তি পুজো ছিল না। প্রথমদিকে ‘বলি’ বা ‘উৎসর্গ’র প্রচলন ছিল না। মন্দির বা পুরোহিতের কর্তৃত্ব প্রয়োগের অবস্থা তখনও তৈরি হয়নি। প্রকৃতি জগৎ, মানুষ ও দেবতা নিয়ে ব্যবস্থাটা এক সার্বজনীন নিগমের অধীন, যা পালন করা মানে ব্রত পালন, আর ব্যতিক্রম মানেই ধ্বংস।
● বর্ণ - কারও কারও মতে ঋক্ বেদের দশম অধ্যায়ে পুরুষ সূক্তে জাতি/বর্ণ প্রথার উল্লেখ রয়েছে। অন্য মত হলো, এটা পরবর্তীকালের সংযোজন। বৈদিক আর্যরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। উৎসাহের সাথে নিজেদের সাহিত্য ও সমাজ রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত থাকতে গিয়ে একদল মানুষ ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত নামে পরিচিত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া চালু রাখার প্রয়োজনে তারা স্থানীয় পরাজিত জনগোষ্ঠীকে মূল ধারা থেকে ঠেলে নামিয়ে ‘শূদ্র’ হিসাবে চিহ্নিত করে।
● বৈদিক সমাজ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি আদিম শ্রেণিহীন সমাজ থেকে শ্রেণি সমাজে রূপান্তরিত হয়েছিল। অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্য রচনার সমগ্র যুগ ধরে আগাগোড়াই আদিম সাম্য সমাজ ছিল না। যাযাবর পশুপালক জীবন থেকে গ্রামভিত্তিক কৃষি সমাজে বিকশিত হয়েছিল। স্বভাবতই, এই রূপান্তরে পরস্পর-বিরোধী দার্শনিক ভাবনা বিকশিত হয়। মনে রাখা দরকার যে, এই দার্শনিক ভাবনাগুলি বাস্তব জীবন ও জীবন সংগ্রামের বাস্তবতাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিল। সুতরাং এটা আশ্চর্য নয় যে বেদ-এ বিমূর্ত ভাববাদের চেয়ে বস্তুবাদী ভাবনা কম নেই। বেদ-এর ভাববাদের ধারণাগুলি পরবর্তী সময়ে সমাজে শ্রেণি বিভাজন ও নিপীড়ন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বিকশিত হয়।
নাস্তিক দর্শন
● আস্তিক ও নাস্তিক দর্শনের বিভাজনের মানদণ্ড সম্পর্কে আলোচনা প্রথমে প্রয়োজন। ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে, বেদ-এর কর্তৃত্বে আস্থা স্থাপন করাই হলো আস্তিক দর্শন এবং বেদ-এর কর্তৃত্বে অনাস্থাই হলো নাস্তিক দর্শন। বেদ-এর বিষয়বস্তু ভাববাদের তুলনায় বস্তুবাদী হওয়া সত্ত্বেও বেদ-এ কর্তৃত্বের ওপর জোর কেন - এই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। অবশ্যই আর্যদের জাত্যভিমানী অংশ শ্রেণিকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সাথে তাকে সংহত করার লক্ষ্যে, আধিপত্য বিস্তারের বাসনায় নৈতিক ও ধর্মীয় অনুমোদনে আগ্রহী ছিল। বেদ-এর আচার-অনুষ্ঠান, যজ্ঞ ইত্যাদি কার্যধারা যা আর্যদের জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য তা ভারতের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে ছিল অপরিচিত। বেদ-এর কর্তৃত্বর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল একদিকে এখানকার অধিবাসী ও অপরদিকে পরাজিত জনগোষ্ঠীকে। বশীভূত করার জন্য এই আত্মসমর্পণ করানোর প্রয়োজন ছিল। বেদ-এর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার পথ ছিল প্রভাবশালী শ্রেণির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো। যা শুধুমাত্র নিন্দনীয়ই নয়, বর্ণব্যবস্থা সংবলিত সমাজের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ। এই জন্যই লোকায়ত, বৌদ্ধধর্ম, জৈন দর্শনগুলিকে নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ধর্ম তথা দর্শনগুলি বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানকে যেমন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, সাথে বৈদিক জাত ও বর্ণব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল।
● নাস্তিক দর্শনের আলোচনায় আমরা প্রথমে লোকায়ত দর্শন নিয়ে আলোচনা করব।
● লোকায়ত দর্শন - ভারতীয় দর্শনে বলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো লোকায়ত দর্শন। প্রাক্ বৌদ্ধ যুগে লোকায়ত দর্শনের অস্তিত্ব ছিল। লোকায়ত দর্শনে সাংখ্য, যোগ ও অন্যান্য দর্শনের উল্লেখ করা হয়েছিল। আবার উপনিষদ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) এবং মহাভারতেও লোকায়ত দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
যে মাধবাচার্যের কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর সর্বদর্শন সংগ্রহ-তে লোকায়ত দর্শনকে অত্যন্ত খাটো করে উপস্থিত করেছেন। লোকায়ত বা দর্শনে (চার্বাক দর্শন-এর অন্তর্ভুক্ত) যে নীতিকথার পরিচয় পাওয়া যায় তার সাথে মাধবাচার্য বর্ণিত ঋণং-কৃত্বা-ঘৃতং-লিবেৎ জাতীয় স্থূল ভোগলিপ্সার লেশমাত্র সম্পর্ক নেই।
● আমাদের দেশে জনসাধারণের দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শন এই দুটি কথা বোঝার জন্য একটি নামই ব্যবহার করা হয়েছে - লোকায়ত। লোকায়ত মানে জনসাধারণের দর্শন, লোকায়ত মানে আবার বস্তুবাদী দর্শন। তবে জনসাধারণের দর্শন কথাটার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের লোকায়ত দর্শনকে খাটো করে দেখাবার মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। যে মানসিকতায় বলা হোক না কেন, জনসাধারণের দর্শন কথাটির মধ্য দিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে বস্তুবাদের সম্পর্ক যে এত নিবিড় তারও ইঙ্গিত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে রয়েছে। ‘লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ’ - অর্থাৎ কীনা, সাধারণ লোকের মধ্যে পরিব্যপ্ত বলেই দর্শনের এইরকম নাম।
(ক্রমশ)