৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
দুর্নীতির পাঁকে ডুবে বেসামাল তৃণমূলীদের সততার প্রলাপ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ অভিযোগের আঙুল আগেই উঠেছিল, কিন্তু কয়লা থেকে নিয়োগ দুর্নীতির সাক্ষ্য প্রমাণ যেভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে ক্রমাগত জড়ো হচ্ছে তাতে পরিস্থিতি ঘোরালো হচ্ছে রাজ্যের তৃণমূল নেতাদের। সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায়। কয়লা পাচার কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত মন্ত্রী মলয় ঘটকের আবেদন নাকচ করে ১৮ নভেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট বলেছে, অব্যাহতি এবং রক্ষাকবচ পাবেন না মন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের মামলা চলবে। কয়লা মাফিয়া অনুপ লালার হিসাবরক্ষক নীরজ সিংয়ের ল্যাপটপে মন্ত্রী মলয় ঘটক সহ একাধিক নাম উঠে আসায় ইডি ১২ বার ডেকে পাঠালেও ১১ বার তলব এড়িয়েছেন মন্ত্রী এর আগে। পরপর ঘটা এইসব আইনি পদক্ষেপে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব ক্রমশ গ্রেপ্তারির আশঙ্কায় প্রবল চাপে। তাই নিজেকে সৎ বলে আবার দাবি করে নজর ঘোরানোর আর সহানুভূতি কুড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করলেন মমতা ব্যানার্জি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সততা প্রমাণের জন্য তাই হঠাৎই তৎপর হয়ে উঠে সম্প্রতি বলেছেন তাঁর ঘরে থাকার জায়গা নেই। ওদিকে রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে ১৪ দিন জেল হেফাজত হলেও মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে অসুস্থতার জন্য ২২নভেম্বর এসএসকেএম হাসপাতালে ভরতি করা হলো।
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম বিচারপতি দেবাংশু বসাকের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ নির্দিষ্ট করেছেন। ৯ নভেম্বর রাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতির প্রেক্ষিতে কড়া রায় দেয় দেশের শীর্ষ আদালত। তাঁর প্রেক্ষিতেই কলকাতা হাইকোর্টের এই পদক্ষেপ। রায়ে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে আগামী দু’মাসের মধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু এবং বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর ডিভিশন বেঞ্চের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এসএসসি শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত সব মামলার শুনানি হবে কলকাতা হাইকোর্টে। সেখানেই এসএসসি সংক্রান্ত মামলাগুলোর শুনানি হবে।
প্রায় এক বছর ধরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থা এই বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। এর আগে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন চাকরি প্রার্থীরা। সিপিআই(এম) সাংসদ তথা আইনজীবী বিকাশরজ্ঞন ভট্টাচার্যের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয় যাতে এই মামলাগুলোর শুনানি না পিছিয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতেই আদালতে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সিবিআই-কে।
চাকরি থেকে বঞ্চিত এসএসসি’র যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা প্রায় ১০০০ দিন রাস্তায় বসে রয়েছেন নিয়োগের দাবিতে। আদালত সহ অন্যত্র তাঁরা বার বার দাবি জানিয়েছেন তৎপরতার সাথে তদন্ত শেষ করার। কারণ নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে গেলে তারা আর কোনভাবে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকতার সুযোগ সুবিধা পাবেন না।
উল্লেখ্য এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি কান্ডে অভিযুক্ত প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য সহ শিক্ষা দপ্তরের একাধিক কর্তা জেলে।
এদিকে টাকা লেনদেন সহ রেশন দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার হওয়া জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বহর বাড়তে থাকলেও মমতা ব্যানার্জি পাশে থাকলেন তাঁর। ৮ নভেম্বর রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে মন্ত্রীসভায় রেখে। ইডি’র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ এনে মন্ত্রীসভার বৈঠকে রেশন দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মমতা ব্যানার্জি ‘বালুকে ফাঁসানোর’ তত্ত্ব সামনে এনেছেন। ফলে ইডি হেপাজতে থেকেও গ্রেপ্তার হওয়া জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বন দপ্তরের দায়িত্বেই থাকছেন। ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মমতা ব্যানার্জি ও অভিষেক সব জানেন বলে তাঁদের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন বনমন্ত্রী।
অন্যদিকে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জিকে বাঁচানোর জন্য ধৃত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে এসএসকেএম হাসপাতালে টানা ভরতি করে রেখে তাঁর কণ্ঠস্বর বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস্-এর কর্মী ছিলেন। তাঁর ‘সাহেব’ অভিষেক ব্যানার্জিকে কেউ ছুঁতে পারবে না বলে দাবি করেছিলেন। সেই তাঁকেই গ্রেপ্তারের পরে গত দু’মাসের বেশি এসএসকেএম হাসপাতালে রাখা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ইডি তাঁর কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করতে পারছে না। কেন, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। ৮ নভেম্বর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, মমতা ব্যানার্জি আরএসএস’কে ধরে পার পাওয়ার চেষ্টা করছেন। অভিষেক ব্যানার্জিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ভাইপোকে বাঁচানোর জন্য এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের গলার স্বর পালটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে বিশেষ পদ্ধতিতে।
৯ নভেম্বর ইডির নোটিশ অনুযায়ী ভাইপো সাংসদ বেলা ১১টা নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্সে পৌঁছান। বেলা ১২টার মধ্যে তাকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তৃণমূল সাংসদ দাবি করেন যে, তিনি তদন্তকারি সংস্থার সাথে সব সময় তদন্তে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু অতীতে বার বার দেখা গিয়েছে যে, ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন রক্ষা কবচের আবেদন চেয়ে। অভিষেক জানিয়েছেন যে, তিনি ইডির কাছে ছয় হাজার পাতার নথি জমা করেছেন। সেই নথি যাচাই করে ইডি তাঁকে ভবিষ্যতে ডাকলে তিনি সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। অভিষেকের হাজিরা প্রসঙ্গে সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মোদি অমিত শাহ পিসি ভাইপোকে বিব্রত করতে চায় না। আগের থেকেই ঠিক ছিল যে, তিনি আজ গিয়ে ফিরে আসবেন।...।’’
তবে এখনও পর্যন্ত তৃণমূল নেত্রী এবং সাংসদ ভাইপো সব জানেন বলে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করলেও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলি কেন তাঁদের ডাকছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।