৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
বিজেপি সরকারের হঠকারিতায় উত্তরাখণ্ডে সুড়ঙ্গে আটক ৪১ জন শ্রমিকের জীবন বিপন্ন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মোদি সরকারের একগুঁয়েমি মনোভাবে নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়ন ও হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে চারধাম যাত্রার পথকে সুগম করতে টানেল তৈরি করতে গিয়ে আজি বিপন্ন ৪১জন নির্মাণ শ্রমিকের জীবন। তাঁদের পরিবারের পাশাপাশি গোটা দেশের মানুষ চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। সবারই আশঙ্কা সুরঙ্গে আটকে পড়া এই ৪১জন শ্রমিক সুস্থ ও নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারবেন কিনা। গত ১২ নভেম্বর দীপাবলির দিন ভোর ৬টা নাগাদ সুড়ঙ্গ ভেঙে পড়ায় আটকে পড়েন ৪১জন শ্রমিক। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ১২ দিন অতিক্রান্ত হলেও শ্রমিকদের বের করে আনতে পারেনি কেন্দ্রের মোদি ও উত্তরাখণ্ডের পুষ্কর সিং ধামি সরকার। মোদির বিজ্ঞাপনের ঢাক পেটানো তথাকথিত উন্নত ডিজিটাল ভারতের সমস্ত প্রযুক্তিই আপাতত ব্যর্থ। তাঁর ‘নতুন ভারত’র সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করেও বিপন্ন শ্রমিকদের সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধার করা যায়নি। বেপরোয়াভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে উগ্র ধর্মীয় ভাবাবেগে মোদির এই তথাকথিত মন্দির রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতিতে চরম মাশুল দিতে হচ্ছে ৪১ জন নির্মাণ শ্রমিককে। তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের ফেলে দিয়েছে চূড়ান্ত উৎকণ্ঠা ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দেশবাসীর চরম দুর্ভাবনা। অথচ নির্বিকার প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উদ্ধারকাজ খতিয়ে দেখার সময় হয়নি তাঁর। তিনি আপন মনে মগ্ন থেকেছেন ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে ভোট প্রচারে। তারপর আহমেদাবাদে উড়ে এসে নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে বসে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ উপভোগ করেছেন। সঙ্গী তাঁর অন্যতম সহচর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এটা কি কেবল নির্লজ্জতা, উদাসীনতা; চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা নয়?
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো ২০ নভেম্বর এই ঘটনায় ক্ষোভ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, শ্রমিকদের টানেলের ভেতর থেকে বের করে আনা গেল না এখনো। উদ্ধার কাজ পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সরকার কেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বা সংস্থার সাহায্য নিচ্ছে না? শ্রমিকদের উদ্ধারে কোনোরকম ব্যবস্থাতেই ঢিলেমি দেওয়া উচিত নয়। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে উদ্ধারকার্যে আরও জোর বৃদ্ধির কথা বলেছে পলিট ব্যুরো।
উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চার হিন্দু তীর্থক্ষেত্র গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রীনাথকে একসঙ্গে সড়ক পথে জুড়ে দেবার লক্ষ্যেই এই চারধাম প্রকল্প। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই যাতে চারধাম যাত্রা সম্ভব হয়, সেজন্য বিজেপি সরকার ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে এই সড়ক পরিকল্পনা নিয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে আধ্যাত্মিক পর্যটন সার্কিট। এই প্রকল্পের জন্য একাধিক বড়ো বড়ো টানেল তৈরি হচ্ছে। এই টানেল এই প্রকল্পেরই অংশ। এরই ফলে একের পর এক বিপর্যয় ঘটছে।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দু ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটের রাজনৈতিক ফায়দা তোলা। এতদিন এই সমস্ত তীর্থস্থানে পর্যটকরা যেতেন কিছুটা সড়ক পথে গাড়িতে, আর কিছু দুর্গম পথ পাঁয়ে হেঁটে। মোদি সরকার চাইছে সড়ক পথে সরাসরি মানুষ এসব স্থানে পৌঁছে যাক। শুধু তাই নয়, বছরের যে কোনো সময় এই চারধামে পৌঁছানোর উপযোগী পাহাড় কেটে গর্ত করে কংক্রিটের রাস্তা তৈরির উদ্যোগ চলছে। আর তা করার জন্য প্রায় এক হাজার কিলোমিটার রাস্তাকে পাহাড় কেটে দ্বিগুণ-তিনগুণ চওড়া করা হচ্ছে। তেমনি দূরত্ব কমানোর জন্য পাহাড়ের ভিতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য সুড়ঙ্গ। এই বিশাল নির্মাণ কাজের জন্য জঙ্গল-গাছপালা কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। পাহাড় ফাটানোর জন্য ডিনামাইট ফাটানো হচ্ছে, বিশাল বিশাল ভারী অতিকায় যন্ত্র ব্যবহারের ফলে পাহাড়ের শক্ত জমাট বাঁধন অনেকটাই শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধসের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এই নির্মাণ কাজের ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিপজ্জনকভাবে বদলে যাচ্ছে।
মোদি সরকারের এই প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন উঠেছে। পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বারে বারেই বলেছেন, পাহাড় ও জঙ্গল কেটে বা তার পেটচিরে যেভাবে এই রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তাতে পরিবেশগত দিক ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়ছে হিমালয় পার্বত্য এলাকায়। সাম্প্রতিককালে হরপা বান থেকে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই চারধাম প্রকল্পের দায় যে অনেকটাই তা বারে বারেই বলে চলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সমস্ত অভিমতকে অবজ্ঞা করেই শুধুমাত্র ক্ষমতার নেশায় হিন্দু ভাবাবেগের রাজনীতিকে উসকে দিতে এই নির্মাণের মধ্য দিয়ে মারাত্মক বিপর্যয়কে ডেকে এনেছে মোদি সরকার।
এই সুড়ঙ্গটি তৈরি করছে ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেট (এন.এইচ.আই.ডি.সি.এল.), উত্তরকাশী থেকে যমুনেত্রীর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার কমাতে পাহাড় কেটে এই সুড়ঙ্গ বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে মোদি সরকার। চারধাম যাত্রার এই রাস্তা তৈরির ধাক্কায় উত্তরাখণ্ডকে বারবারই প্রকৃতির রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। এবারে এই প্রকল্পে ব্রহ্মকাল-যমুনেত্রী জাতীয় সড়কে সিলকিয়ারা ও ডান্ডালগাঁওয়ের মাঝে একটি নির্মীয়মান সুড়ঙ্গ গত ১২ নভেম্বর ভেঙে পড়ে। তার ভিতরেই আটকে পড়েন ৪১জন পরিযায়ী শ্রমিক। এই শ্রমিকদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ৩ জন সহ ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, বিহার, উত্তরাখণ্ড, আসাম ও হিমাচলের শ্রমিক রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের তিনজন শ্রমিক হলেন কোচবিহারের মনির তালুকদার, হরিণাখালির সৌভিক পাখিরা এবং হুগলীর জয়দেব প্রামাণিক।
উত্তরকাশীর এই সিলকিয়ারা টানেলে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট রয়েছে এল এইচ আই ডি সি এল-এর পাশাপাশি রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড (আরভিএনএল), শতদ্রু জল বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড (এসজেভিএনএল), তেহরি হাইড্রোইলেকট্রিক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (টিএইচডিসি) এবং অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন (ওএনজিসি)। ১২ নভেম্বর সুরঙ্গে ধসের ফলে আটকে যাওয়া শ্রমিকদের দু’দিনের মধ্যেই বের করে আনা হবে বলে জোর গলায় দাবি করেছিল বিজেপি সরকার। এরপর আমেরিকা থেকে অত্যাধুনিক ড্রিলিং মেশিন এনে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন, শ্রমিকদের দ্রুত বের করে আনা হবে। সেই মেশিনও ১৮ নভেম্বর বিকল হয়ে যায়। এর আগেরদিনও একটি মেশিন বিগড়ে গিয়েছিল। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী ধামি প্রায় প্রতিদিনই মন্ত্রোচ্চারণের মতো আওড়ে যাচ্ছেন - প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ রাখছেন।
সুরঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে সুড়ঙ্গ কেটে পাইপ বসানোর কাজ চলছে। দুর্ঘটনাস্থলে শ্রমিকদের উদ্ধারে এসেছেন আন্তর্জাতিক সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স। পাইপের সাহায্যে শুকনো ও গরম খাবার, ওষুধপত্র, ফলমূল পাঠানো হচ্ছে। এন্ডোস্কোপিক ফ্লেক্সি ক্যামেরার সাহায্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের ছবিও দেখা গেছে। অনেকেই ভয়েস রেকডিং-এ বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব যাবতীয় উদ্যোগ এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আধিকারিকদের মুখে ‘ঈশ্বরের করুণার ভরসা’র বাণী শোনা সত্ত্বেও সুরঙ্গে আটকে থাকা ৪১ জন শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কিন্তু এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছে।