৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
'কারার ঐ লৌহ কপাট': বিকৃতিতে বিরক্তি ও বিতর্ক
সুদিন চট্টোপাধ্যায়
এ আর রহমানের তৈরি নতুন সুরে গাওয়া কাজী নজরুল ইসলামের 'কারার ঐ লৌহ কপাট' গানটি আমার শোনা ছিল না। কিন্তু গানটি প্রকাশ্যে আসার পর তুমুল বিতর্ক ও বিরক্তি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় একজন সংবেদনশীল সংগীত প্রেমী হিসেবে আলোড়িত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটি করে গানটি শুনি এবং বলাই বাহুল্য ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ হই। আমাদের মানসিকতা ও আচরণ থেকে 'শ্রদ্ধা' শব্দটি অনেক আগেই সমাহিত, 'ঐতিহ্য' ও 'ইতিহাস'-এর বোধ অবলুপ্ত। 'পরম্পরা' আমাদের উদ্ধত স্পর্ধায় পদানত। সহজেই আমরা তাই রবীন্দ্রনাথের গান, বঙ্কিমের উচ্চারণ নিয়ে সুর, তাল লয়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা করি। 'শিল্পীর স্বাধীনতা'র নামে স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে বিবেক বিরুদ্ধতা করে না, অন্তর ব্যথিত হয় না। অথচ কাঁপবে পাশ্চাত্যে বাক, বিটোফেনের সৃষ্টিতে সামান্য আঁচড় কাটতেও বুক। এ আর রহমান যত বড়ো সুরকারই হোন না কেন, ভুবন ভরা তাঁর স্বীকৃতি ও লোকপ্রিয়তা থাকলেও, 'ইতিহাস'কে অস্বীকার এবং 'ঐতিহ্য'কে অগ্রাহ্য ও অশ্রদ্ধা করার অধিকার তাঁর নেই... এই প্রারম্ভিক মন্তব্য সহ পরবর্তী আলোচনায় আসি।
গানটির বিষয়ে মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছেন... তখন কাজী নজরুল ইসলাম ২২ বছরের যুবক। উন্নত গ্রীবা, শক্ত শিরদাঁড়া, মাথা না নোয়ানো নির্ভীক এক যুবক। সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রক্তে তাঁর প্রবহমান প্রতিবাদ। সময়টা ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাকে বাংলার জীবন ও যৌবনের একটা বড়ো অংশ তখন কারাগারের লৌহকপাটের অন্তরালে অন্তরীণ, অবরুদ্ধ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও বাদ যাননি। কিছুদিন আগেই তাঁর সম্পাদনায় শুরু হয়েছে 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার পথযাত্রা, যার পাতায় পাতায় পরাধীনতার বিড়ম্বনার কাহিনি ও স্বাধীনতার আকুতি। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর আবেদনে সাড়া দিয়ে নজরুল লেখেন 'ভাঙার গান'। ১৯২২-এর ২০ জানুয়ারি প্রকাশিত হলো আগুন ঝরানো এই কবিতাটি।
"কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা" বইয়ে মুজফ্ফর আহ্মদ লিখেছেনঃ "আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রীকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গালার কথা'র জন্যে একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। ...অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। কুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল। ...নজরুল 'ভাঙার গান' লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে। 'ভাঙার গান' 'বাঙ্গালার কথা'য় ছাপা হয়েছিল।"
১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে, বঙ্গাব্দ ১৩৩১'র শ্রাবণ, মোট ১১টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হলো কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহাত্মক কাব্যগ্রন্থ 'ভাঙার গান'। গ্রন্থের প্রথম কবিতা বা গানটিই ,"ভাঙার গানঃ কারার ঐ লৌহ-কপাট"। বাকি দশটি বিভিন্ন সময়ে 'বঙ্গবাণী', 'ধূমকেতু', 'সাপ্তাহিক মোহাম্মদী' ইত্যাদি প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে আলোড়ন ফেলে দেয়। 'জাগরণী', 'ঝোড়ো গান', 'দুঃশাসনের রক্ত-পান', 'শহীদী-ঈদ',... এ সবই উন্মাদনার গান... পাঠ, আবৃত্তি বা গাওয়ায় চঞ্চল, অস্থির হয়ে ওঠে বাংলার জীবন যৌবন। বিশেষ করে 'কারার ঐ লৌহ-কপাট' সমর সংগীতের মতো আছড়ে পড়ে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তিভূমি প্রকম্পিত করে দেয়, দুন্দুভি বেজে ওঠে যুব মানসে। সত্যাগ্রহীদের কণ্ঠে, বিপ্লবীদের আন্দোলনে, কারারুদ্ধ দেশপ্রেমীদের স্বতঃস্ফূর্ত কলতানে ধ্বনিত হতে থাকে 'কারার ঐ লৌহ-কপাট' ভেঙে ফেলার দুর্জয় সংকল্প। শোনা যায়, হুগলির জেলে দেশবন্ধু ও অন্যান্য বন্দিরা একসঙ্গে চিৎকার করে গাইতেন এই গান। তাঁদের 'তরুণ ঈশান'-কে প্রলয়-বিষাণ বাজানোর ডাকে কেঁপে উঠতো কারাগারের লৌহ-কপাট। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে তৎকালীন বাংলা প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ সরকার শীর্ণকায় গ্রন্থটির প্রলয়ঙ্করী শক্তি ও সম্ভাবনায় সন্ত্রস্ত হয়ে ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর তারিখের একটি নির্দেশে 'ভাঙার গান' নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নিষেধাজ্ঞা স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিন পর্যন্ত সরকার প্রত্যাহার করেনি। ১৯৪৯ সালে 'ভাঙার গান'-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৯ সালে 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' ছায়াছবিতে প্রথম গাওয়া হলো 'কারার ঐ লৌহ কপাট' গানটি। গানের প্রথম রেকর্ডও বেরোলো ১৯৪৯-এ, কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে, রেকর্ড নম্বর জি ই ৭৫০৬, শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী। ততদিনে নজরুল ব্যাধিতে বিপন্ন, চৈতন্য হারিয়ে জীবন্মৃত অবস্থায়।
এ আর রহমানের আরোপিত পরিবর্তিত সুরে গানটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত 'পিপ্পা' ছবিতে সংযোজিত হয়ে প্রকাশ্যে আসার পর উভয় বাংলায় যে প্রশ্ন, পরিপ্রশ্ন ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে তারই প্রেক্ষিতে গানটি বার দুয়েক শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি! কোথায় সেই আগুনের ঝলক, সেই রৌদ্ররসের দাহ, মরণপণ সংকল্পের বজ্র নিনাদ? তার বদলে কিছুটা লোকগীতি, কিছুটা হাল্কা রোমান্টিক গানের এক অদ্ভুত হযবরল সম্মিলনে নিভে যাওয়া বারুদহীন দেশলাই কাঠির মতোই মনে হবে। ছবির পরিচালক রাজকুমার মেননের মতামত বা প্রযোজকদ্বয়, অভিনেত্রী বিদ্যা বালনের স্বামী সিদ্ধার্থ রয় কাপুর এবং ইউটিভি মোশন পিকচার্সের প্রধান রনি স্ক্রুওয়ালার মতামত জানা নেই। তাঁদের পছন্দমাফিক এ আর রহমান এমন কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন কিনা তাও জানা নেই। তবে অস্কার জয়ী, খ্যাতিমান সুরকার এ আর রহমানের কাছে এমন অর্বাচীন চটুলতা প্রত্যাশিত নয়। বিখ্যাত রচয়িতার গান এবং তাঁর দেওয়া সুরে গাওয়া শতবর্ষ প্রাচীন এই সংগীতের খোলনলচে পালটে দেওয়ার আগে তাঁর তুল্য শিল্পীর উচিত ছিল গানটির সুর, গায়কি ও ইতিহাসের সবটুকু জেনে নেওয়া। যে গান ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাড় পাঁজর ভেঙে দেওয়ার সংকল্পিত সাহসে শত লক্ষ কণ্ঠে গীত হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রক্ত প্লাবিত প্রান্তর ভেদ করে রণ দামামায় বারংবার ধ্বনিত হয়েছে, যে গান শুনে অত্যাচারী শাসক সেদিন ভয়ে কেঁপেছে আর আজও যে গান শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়, সে গানের গায়ে স্থূল হস্তক্ষেপের স্পর্ধা প্রয়োগের আগে তাঁর শতবার ভাবা উচিত ছিল, না হলে তিনি কীসের বড়ো সুরকার? পরিচালক, প্রযোজকের নির্দেশ থাকলেও, 'কারার ঐ লৌহ-কপাট'কে আহত, আক্রান্ত করার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি নতুন নজির তৈরি করতে পারতেন, নিজের বিবেচনা ও বিচক্ষণতার সার্থক পরিচয় পেতাম। তা না করে বাজারি হাওয়ায় ভেসে গিয়ে একটি ঐতিহাসিক গানকে তিনি যে উপহাসের স্তরে নামিয়ে আনলেন তার কোনো ক্ষমা নেই। বাংলার এবং বাঙালির আবেগে, অনুভবে, চেতনায় তিনি যে আঘাত হানলেন, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে যেভাবে অবনমিত করলেন, তার বিরুদ্ধে সরকার, সাধারণ মানুষ ও সংস্কৃতি কর্মীরা প্রবল প্রতিবাদে এগিয়ে আসুন এবং এই গানটিকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করুন।