৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
আজকের প্রজন্মের চোখে সলিল চৌধুরী
অগ্নিহোত্রী
তাঁর জন্মের প্রাকশতবর্ষের সন্ধিক্ষণে একটা স্বীকারোক্তি জরুরি - এই উপমহাদেশের বঙ্গসন্তানেরা রবীন্দ্র-নজরুল-উত্তরপর্বে কালজয়ী সঙ্গীত স্রষ্টা বলতে সলিল চৌধুরীকেই বোঝেন। এ নিয়ে আজকের প্রজন্মের বড়ো অংশেরই কোনো দ্বিমত নেই।
একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝাতে এবং বুঝতে সুবিধে হবে। চলতি সময়ে প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলের শিশুঘাতী-নারীঘাতী বর্বরতা বিরোধী প্রতিবাদী মিছিলে হাঁটা কলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে প্রবীণরাও অনায়াসে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠছেন সলিল চৌধুরীর ‘আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি’ গানটি। মিছিলে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া ‘আর রক্ত নয় নয়, আর ধ্বংস নয় নয়/ আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না, রক্ত কি ধ্বংস কি যুদ্ধ আর না…’ লাইন দুটি উত্তাল স্লোগানকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে! যুদ্ধের পরিস্থিতিতে শান্তির অমোঘ বাণী হয়ে এই গানের বিকল্প আজও তৈরি হয়নি। এটাই সলিল চৌধুরীর উত্তরাধিকার। গণনাট্যের উত্তরাধিকার। চারের দশকের শেষ পর্বে লেখা এই গানটি নিয়ে ১৯৫২ সালেও ঘটেছিল একটি চমকপ্রদ ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা এই যুদ্ধ বিরোধী গানটি সাবেক রাশিয়াতেও আলোড়ন ফেলেছিল। শোনা যায়, বিশিষ্ট সোভিয়েত চলচ্চিত্র পরিচালক পুডভকিন এবং অভিনেতা নিকোলাই চেরকাসভ কলকাতায় পৌঁছেই খোঁজ করেছিলেন সলিল চৌধুরীর। ‘হোয়ার ইজ সলিল?’ কাছেই থাকা সলিল চৌধুরীকে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘উই কান্ট ফরগেট ইউর ‘আর রক্ত নয় নয় আর ধ্বংস নয় নয় সং’!’’
পৃথিবীর যে কোনো প্রতিবাদী-বামপন্থী আন্দোলনের বক্তব্যের মূল বার্তা সলিল চৌধুরীর গান শুধু বহনই করে না, সময়ের ব্যবধানকে অনায়াসে মুছে ফেলে সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু’র নিশ্চিহ্নাস্ত্রের মতো। আজকের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর দুনিয়ায় তিনি যদি টাইম মেশিনে চড়ে হাজির হয়ে যেতে পারতেন, তাহলেও বলে বলে গোল দিতেন প্রযুক্তি সর্বস্ব মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে - এমনই তাঁর সাংগীতিক মেধার মৌলিকত্ব।
সলিল চৌধুরীর নিজের সৃষ্টি নিয়ে স্বপ্ন ছিল, তিনি এমন এক ঘরানার জন্ম দেবেন যা দেশ-কালের সীমারেখায় আটকাবে না। আজ ওঁর মৃত্যুর এত বছর পর, আমাদের মতো নব্বইয়ের দশকের সন্তানেরা নানা সময়ে যখন প্রায়ই তাঁর গানের শরণাপন্ন হই, তখন স্পষ্ট হয়, তিনি তাঁর স্বপ্নের কতটা কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সব্যসাচী। গীতিকার, সুরকার, লেখক ও চিত্রনাট্যকার। সিনেমার গান থেকে আধুনিক বাংলা গান পেরিয়ে গণসংগীত - সবকিছুই সমান দক্ষতায় সৃষ্টি করে গেছেন। রেখে গেছেন মৌলিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন।
আমাদের মতো একাধিক প্রজন্ম আছে যাদের শৈশবে প্রথম মুখস্থ করা গান “বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে...” বা “এক যে ছিল মাছি...” ইত্যাদি। সেই পর্ব পেরিয়ে আমরা এসেছি ১৫ আগস্টের স্কুলের অনুষ্ঠানে “এ্যায় মেরে পেয়্যারে ওয়াতন...”গানের মুগ্ধতায়। পাড়ার মাইকে “জানেমন জানেমন তেরে দো নয়ন...” সদ্য প্রেমের নিবেদনের গানে আমদের টিন এজ কেটেছে। পরে রাজনীতির ময়দানে আসতেই, কান পেকেছে “হেঁই সামালো...”, “রানার ছুটেছে...”, “আমার প্রতিবাদের ভাষা...”গানের আবহে। তাই সলিল চৌধুরীর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। আজকের প্রজন্ম একই সাথে তাল মিলিয়ে শুনছে তার সম সময়ে নতুন তৈরি হওয়া গানগুলো। অথচ কোথাও গিয়ে কখনো মনে হচ্ছে না সলিল চৌধুরীর গানগুলো পুরোনো। একেই তো বলে যুগের আগে এগিয়ে থাকা।
আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশক জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা গানের আর এক ধারা ‘জীবনমুখী গান’। সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা, লোপামুদ্রা মিত্র এরকম একঝাঁক নতুন গায়কের জন্ম হয় এই ধারাকে কেন্দ্র করে। এই নতুন ধারার গায়কদের কাছেও সলিল চৌধুরী ছিলেন শিক্ষক স্থানীয়। বিভিন্ন সময় ওরা বলেছেনও সে কথা। এদের গানের ধরন শুনলেও বোঝা যাবে সলিল চৌধুরীর প্রভাব তাদের উপর কতটা ছিল! জীবনমুখী গানের লিরিকে এসেছে সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা ‘গানের’ মধ্য দিয়ে চাওয়ার কথা, বা ‘হেই সামালো’ গানের উল্লেখ করে ট্রিবিউট দেওয়ার মতো স্বতন্ত্র উচ্চারণ। এতটাই শক্তি তাঁর গানে। অথচ আজকাল অধিকাংশ গান মুক্তির বছর ঘোরার আগে হারিয়ে যায়। কিন্তু সলিল চৌধুরী আজও জাগিয়ে রেখেছেন আমাদের।
সলিল চৌধুরীর গানের ব্যাপ্তি বহুমুখী হলেও গণসংগীতের ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টি আলাদা করে নজর কেড়েছে। ২০২৩-এর শেষলগ্নে দাঁড়িয়েও গণসংগীত বলতে অন্য অনেকের মতো আমাদেরও একের পর এক প্রথম যে গানগুলি মাথায় আসে তার অধিকাংশই সলিল চৌধুরির সৃষ্টি। একথা বলা ভুল হবে না, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসদের তৈরি করা গণসংগীতগুলি সত্যিই জনগণের গান। ‘ও আলোর পথযাত্রী’ বা ‘লঙ্গর ছাড়িয়া দে’ শোনেন নি এমন বাঙালি খুঁজলেও পাওয়া দুষ্কর।
সলিল চৌধুরীর আগে ভারতীয় গানে সিম্ফনি সেইভাবে ব্যবহৃতই হয়নি। তিনি শিখিয়ে গিয়েছেন গণসংগীতে কোরাসের ব্যবহার, বুঝিয়ে গেছেন গান শুধুমাত্র শোনার নয় দেখারও। গায়করা শিখেছেন গানে বিভিন্ন ধ্বনির ব্যবহার, বুঝেছেন শব্দের উচ্চারণের উপর গণসংগীত কতটা নির্ভরশীল, আমরা চাইলেও এমন একজনকে খুঁজে পাব না ‘তাই আহ্বান, শোনো আহ্বান, আসে মাঠঘাট বন পেরিয়ে’ শুনে আনমনে তাল ঠোকেন না। মিছিলে এই গান বাজলে মিছিলের গতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে যায়, টের পাওয়া যায় জীবনের স্পন্দন।
মনে আছে, তৃণমূল জমানায় ছাত্র শহিদ কমরেড সইফুদ্দিনের একটি স্মরণসভার কথা। যেখানে সলিল চৌধুরীর ‘তোমার বুকের খুনের চিহ্ন খুঁজি’ গানটি এতটা একাত্ম করেছিল উপস্থিত তরুণদের যে, গাওয়ার সময় মঞ্চের নিচের কোনো আসনে একটা নিঃশ্বাস পড়ারও আওয়াজ পাওয়া যায়নি প্রায়। সেখানে বসে থাকা সইফুদ্দিনের বেশিরভাগ সাথির বয়স ৩০-এর কোঠা পেরোয়নি। সমস্যা হয়নি এই নতুন, কাঁচা চুলের ছেলেমেয়েদের সেই ব্যথা বুঝতে। সলিল চৌধুরীর সৃষ্টি যে কতটা সমসাময়িক এই ঘটনা তাঁর ছোট্ট একটা প্রমাণ।
কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি আরএসএস বাহিনী আসার পর থেকে ক্রমাগত বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করেছে। ধর্মের আর জাতের নামে হানাহানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হাতিয়ার তিনি আগেই শান দিয়ে রেখে গেছেন গণসংগীতের ভাণ্ডারে। সলিল চৌধুরী চল্লিশের দশকে লিখেছেন, ‘ও মোদের দেশবাসী রে, আয়রে পরান ভাই আয়রে রহিম ভাই কালো নদী কে হবে পার…’ এই গানটি। এই গানে শেষ স্তবকে রয়েছে, বিভেদ পেরিয়ে সমাজবাদের পথের দিশা- ‘বুকেতে বুকেতে সেতু অন্তরের মায়া দিয়ে বাঁধিরে/ কুটিলের বাধা যত ঘৃণার নিষ্ঠুরঘাতে ভাঙি ভাঙি রে/ সাম্যের স্বদেশভূমি গড়ার শপথ নিয়ে বাঁধিরে...’। এরকম অসংখ্য গান আমাদের লড়াইয়ের রসদ হিসেবে তৈরি রয়েছে। তাঁর মধ্যে যেমন, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা...’, ‘বলিষ্ঠ দুই হাতে তুলে নাও হাতিয়ার’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ঢেউ উঠছে, ‘ঝংকারো ঝংকারো রুদ্র বীণা’, ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম’ ইত্যাদি গানের উল্লেখ করাই যায়।
চিকিৎসক পিতার পুত্র সলিল চৌধুরী শুরুতে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন ও তার পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন, পুলিশের গ্রেপ্তারি এড়াতে অন্তরীণ থেকেছেন দীর্ঘদিন। জড়িয়েছেন মূলধারার বামপন্থী রাজনীতির সাথে, যুক্ত হয়েছেন গণনাট্যে, পরে বিরোধও তৈরি হয়েছে। সে বিরোধ শিল্পের পরিধিগত। কনটেন্ট আর ফর্ম নিয়ে তা যেমন ঘটেছে, তেমনই গানের লিরিকে ভাববাদী শব্দের আপাত ব্যবহার নিয়েও হয়েছে। সেসব সরিয়ে আবার সৃষ্টিতে মেতে উঠেছেন, কোনও স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটেনি। তাই বোম্বে থেকে ফিরেও গণসংগীত লিখেছেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, ওয়ার্কশপ করিয়েছেন গণনাট্য সংঘের ডাকে থেকে গেছেন গণনাট্য আন্দোলনের শরিক - আজীবন।
সলিল চৌধুরীর সৃষ্টি যে বর্তমান প্রজন্মকেও ছুঁতে পেরেছে তার কারণ তাঁর গান তৈরির ধরন - সহজ, সরল, সুর-তাল-ছন্দের অনবদ্য মিশেল। একই ব্যক্তির তৈরি করা গান মিছিল-প্রেম-বিরহ-বিদ্রোহ-শোক সর্বত্রই খুঁজে পাওয়া যায় বেশ সহজেই - এরকম উদাহরণ খুবই কম। বাংলা আধুনিক গানেও বলেছেন সমাজবাদের কথা, বামপন্থার কথা। যেমন - ‘আজ নয় গুনগুন’, ‘কে যাবি আয়’, ‘এমনি চিরদিন তো কভু যায় না’, ‘ধরণীর পথে পথে ধুলি হয়ে রয়ে যাবো’ - তালিকা শেষ হবে না।
রাজনীতির ময়দান থেকে হিন্দি তথা ওড়িয়া, মালায়ালাম, তামিল, তেলুগু প্রায় সব ভাষার বাণিজ্যিক গান তৈরি, গোটাটাই তিনি করেছেন একই সাবলীলতার সাথে। সলিল মিলেছেন ভারতের সবধরনের সংগীতের মধ্যে, মিশে গেছেন ভারতের ঘরে ঘরে। ক্লান্ত দিনের শেষে ফিরে এসে কানে যদি হালকা করে ‘কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’ বাজে তখন সত্যিই কি ক্লান্তি মুছে যায় না নতুন প্রজন্মেরও?
সলিল প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে। অথচ ২০০০ সাল পরবর্তী এখনকার যুব প্রজন্ম অবলীলায় সলিল চৌধুরীর গানে গলা মেলাতে, ইউটিউব ঘেঁটে তাঁর গান খুঁজে চালিয়ে মগ্ন হচ্ছে। বামপন্থী ছাত্র-যুবদের যে কোনো অনুষ্ঠানে মাইকে সলিল চৌধুরীর গান বাজে না এমন আয়োজন খুঁজে পাওয়া না। বছরখানেক আগে মুক্তি পাওয়া একটি ওয়েব সিরিজ ‘মন্টু পাইলট’- এর ‘থিম মিউজিক’ ও তৈরি হয়েছে ‘ও আলোর পথযাত্রী’-এর সুরে, তাঁর চাহিদা এতটাই তুঙ্গে।
মাঝেমধ্যে যখন ইতিহাস ঘাঁটতে বসি, গর্ব অনুভব হয়। কারণ গোটা ভারতের সংগীত জগতে যাকে নিয়ে আজও এত মাতামাতি, তিনি আমাদের ‘বৃহৎ’ পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন। যারা এখনো সলিল চৌধুরীর গান, লেখার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি, তাদের জন্য পৃথিবীর গতি একটু মন্থর। সলিল চৌধুরীকে শোনার,পড়ার সুযোগ করে দেওয়াটা আমাদের দায়িত্ব। তাঁর জন্মশতবর্ষকেন্দ্রীক অনুষ্ঠান আমাদের কাছে সুযোগ এনে দিয়েছে সলিল চর্চা আমাদের যাপনে মিশিয়ে নিতে। সংগীতপ্রেমীদের ‘আলোর পথযাত্রী’ আজও তিনিই। তাঁর পিছনে হেঁটে চলেছে জেন-এক্স,জেন-ওয়াই, জেন-জেড। অন্ধকার আসার কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি এখনো। যাবেও না।