৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর 'লোকায়ত দর্শন'
জ্যোতির্ভূষণ দত্ত
ভারতীয় দর্শনে মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ অন্যতম প্রধান পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন, এ ব্যাপারে একমাত্র ডি ডি কোশাম্বীর সাথেই তাঁর তুলনা করা চলে।
এ বছর ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর তাঁর জন্মের ১০৫ বছর পূর্ণ হবে। তাঁর জন্ম ১৯১৮ সালের ১৯ নভেম্বর বাঁকুড়ার ঘটকপাড়ার এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে। দেবীপ্রসাদের পিতা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম অডিটর জেনারেল। দেবীপ্রসাদ দর্শন শাস্ত্রে বি.এ. এবং এম.এ. উভয় পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছিলেন।
বর্তমান সময়কালে বিশ্বায়িত পুঁজি ও করপোরেট শক্তির স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়োজনে মার্কসবাদী মতাদর্শ যখন ধর্মীয় মৌলবাদ, পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক আক্রমণের শিকার, তখন বিশ্বখ্যাত এই মার্কসবাদী দার্শনিককে স্মরণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অবদান সম্পর্কে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের একটি উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ১৯৯৩ সালে দেবীপ্রসাদের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে তিনি বলেছিলেনঃ
‘‘তাঁর সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন তার সারমর্ম হলো - কুসংস্কার, জ্ঞানচর্চার অগ্রগতিকে বাধা দেওয়া, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাকার অপকর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওই রচনাগুলি এক একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।...’’
‘‘হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের হাত ধরে এই অপশক্তি আমাদের সাধারণ মানুষকে নিয়ে চলেছে অবনত অতীতের দিকে, ‘বৈদিক যুগের গৌরবোজ্জ্বল সূচনাকাল’ বলে সেই অন্ধ অতীতকে তারা অভিহিত করছে। এই সেই সূচনাকাল যাকে দেবীপ্রসাদ অভিহিত করেছিলেন ‘কর্তৃত্ববাদী ও পবিত্র শক্তিগুলি’র যূথবদ্ধ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সময়পর্ব। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের রচনাগুলি এই পশ্চাদগমনের বিরুদ্ধে আমাদের সাধারণ মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেবে। সুতরাং গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের জন্য যে মরণপণ সংগ্রাম তার শক্তিশালী অস্ত্রসম্ভার হয়ে উঠবে এই সমস্ত রচনা।’’
দেবীপ্রসাদ প্রাচীন ভারতের দর্শন, ইতিহাস ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনেকগুলি মূল্যবান বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রথম বই কিন্তু কবিতার। বইটির নাম ‘কয়েকটি নায়ক’। বন্ধু সমর সেন এবং তাঁর লেখা কবিতা নিয়ে ১৯৪২ সালে ওই কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তিনি এবং বন্ধু সমর সেন এমএ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যে দুটি সোনার মেডেল পেয়েছিলেন সেগুলি বিক্রয় করে গ্রন্থটি প্রকাশের অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু এর পর দেবীপ্রসাদ আর কবিতা লেখেননি।
ওই সময় শিশু-কিশোরদের উপযোগী একটি জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল, নাম ‘রং মশাল’। দেবীপ্রসাদ এবং তাঁর ভাই কামাক্ষাপ্রসাদ জীবনের প্রথম পর্বেই পত্রিকাটি সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেছিলেন। ওই পত্রিকায় অনেক খ্যাতমান লেখক লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সুকান্ত ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী এবং বুদ্ধদেব বসুর নাম। ১৯৪৭ সালে ‘রং মশাল’ বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমান প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য দেবীপ্রসাদের সর্বাপেক্ষা বেশি আলোচিত ও প্রশংসিত গ্রন্থ ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থটির বিষয়বস্তু এবং বর্তমান সময়ে তার প্রাসঙ্গিকতা সংক্ষেপে তুলে ধরা।
গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। প্রকাশক কলকাতার নিউ এজ পাবলিকেশন। ১৯৫৯ সালে গ্রন্থটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে নিউদিল্লির People’s Publishing House।
গ্রন্থটির বাংলা সংস্করণে ‘প্রস্তাব’ এই শিরোনামে লেখক বলেছেনঃ ‘‘সমাজ-বিকাশের পটভূমিতে ভারতীয় সংস্কৃতির একটি দিক এই গ্রন্থে বিচার করবার চেষ্টা করেছি। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ইতিহাস - বিশেষত মাতৃপ্রাধান্য সংক্রান্ত গবেষণা আজও অনেকাংশে অসম্পূর্ণ।’’ বৃহৎ এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় সাতশত। গ্রন্থটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডঃ পটভূমি, দ্বিতীয় খণ্ডঃ বস্তুবাদ এবং তৃতীয় খণ্ডঃ ভাববাদ। এছাড়া গ্রন্থের একটি দীর্ঘ ভূমিকা আছে। ভূমিকার শিরোনাম দেওয়া হয়েছেঃ ‘লোকায়ত, মাধবাচার্য ও আধুনিক গবেষণা’।
লোকায়ত দর্শনের ইতিহাস বলতে বোঝায় ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদের ইতিহাস। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, লোকায়তিকদের নিজস্ব কোনো গ্রন্থাদি পাওয়া যায় না। তাঁদের লেখালেখি ছিল কীনা, এ প্রশ্নে গবেষকদের দুটি মত। এক দল ওই ধরনের লেখার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ গবেষক বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে বলেছেন যে, এককালে লোকায়তিকদের লেখালেখি ছিল। বিপক্ষের লোকেরা সেগুলি ধ্বংস করেছে। তাই লোকায়ত দর্শন সম্বন্ধে জানতে গেলে আমাদের লোকায়ত খণ্ডনের ওপর নির্ভর করতে হয়। লোকায়ত বিরোধীদের অনেকগুলি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মধ্যে দেবীপ্রসাদ তিনটি গ্রন্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেনঃ (১) সর্বদর্শন সংগ্রহ - মাধবাচার্য, (২) সর্বসিদ্ধান্ত সংগ্রহ - শঙ্করাচার্য, (৩) ষড়দর্শন সমুচ্চয় - হরিভদ্রসুরী।
মাধবাচার্য (১২৩৮-১৩১৭) দ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০) অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের স্রষ্টা। হরিভদ্রসুরীর জন্ম-মৃত্যু সাল সম্পর্কে বিতর্ক আছে। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত।
লোকায়ত দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ বলেছেন যে, বিরোধী দর্শনের গ্রন্থাদিতে শুধু যে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আলোচনা আছে তাই নয়, সে আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই ‘‘অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরোধী। কোথাও কোথাও উপসংহার ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। যেমন রাধাকৃষ্ণান বলেছেন যে, ৬০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শ্রুতি শাসনের কঠোরতা ভেঙে চিন্তার মুক্তি ঘটে - মহাকাব্য রচিত হয়। তখনই লোকায়ত সম্প্রদায় নামের চরম নাস্তিক সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। অন্যদিকে স্কটিশ ভারততত্ত্ববিদ জনমুয়ার রাধাকৃষ্ণানের অনেক আগে ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত, ভারতে বহুকাল থেকেই চিন্তার স্বাধীনতা ছিল। পরে লোকায়তিক ও বৌদ্ধরা এমনভাবে নাস্তিকতার কথা বলতে থাকে যে আস্তিকেরা শঙ্কিত হয়ে কঠোর শ্রুতি শাসন প্রবর্তন করেন।’’
মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহে চার্বাক বা লোকায়ত মতের কথা আছে। তাঁর মতে লোকায়তিকেরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জড় জগৎ ভিন্ন অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করত না এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুখ ভিন্ন অন্য সুখের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত না। সুতরাং মাধবাচার্য লোকায়ত দর্শনকে অত্যন্ত খাটো করে দেখিয়েছেন। ‘জনসাধারণের দর্শন’ এবং ‘বস্তুবাদী দর্শন’ - এই দুটি কথা বোঝাবার জন্য একটি নাম ব্যবহার করা হয়েছে - ‘লোকায়ত’। লোকায়ত মানে জনসাধারণের দর্শন। জনসাধারণের দর্শন কথাটির মধ্য দিয়ে লোকায়ত দর্শনকে খাটো করে দেখাবার একটা মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে, জনসাধারণের মধ্যে এই দর্শনের ব্যাপক প্রভাব ছিল তাই এই লোকায়ত দর্শন জনসাধারণের দর্শন। শঙ্করাচার্যও একথা মেনেছেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে, এই দর্শন জ্ঞানী পণ্ডিতদের চর্চার বিষয় না হয়ে, জনসাধারণের বিষয় ছিল, তাই এর প্রতি কোনো সম্ভ্রম দেখাতে রাজি ছিলেন না তিনি। অথচ মহাভারতে দেখা যায় যে, দ্রৌপদীকে লোকায়তবিদ্যা শেখাবার জন্য তাঁর পিতা জনৈক বিদ্বান আচার্যকে নিয়োগ করেছিলেন। বৌদ্ধ ভারতে যেসব ব্রাহ্মণ লোকায়ত দর্শন চর্চা করতেন তাঁরা জ্ঞানী ও বিদ্বান বলেই গণ্য হতেন। সপ্তম শতাব্দীতে সম্রাট হর্ষের সভাকবি বাণভট্ট রচনা করেছিলেন ‘হর্ষচরিত’ নামে সংস্কৃতে লেখা ইতিহাস বিষয়ক কাব্যগ্রন্থ। সেখানে তিনি জ্ঞানী ও তপস্বীদের একটি দীর্ঘ তালিকা যুক্ত করেন। সেই তালিকায় বৌদ্ধ, শ্বেতাম্বর জৈন, কপিল শিষ্য, কণাদ শিষ্য প্রমুখের সাথে লোকায়তিকদের নামও আছে। সুতরাং ভাবাই যায় যে, লোকায়ত মতের বিশাল ও সশ্রদ্ধ সামাজিক প্রভাব ছিল। কিন্তু মাধব ও শঙ্করের মতো বৈদান্তিকেরা একথা মানতেন না।
মহাভারতে চার্বাক নামে এক ব্যক্তিকে ‘রাক্ষস’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। দুর্যোধন সখা এই চার্বাককে ‘দুরাত্মা’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। এইভাবে চার্বাক দর্শনকে হেয় করে দেখাবার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। লোকায়ত দর্শনের সাথে জড়িত ছিল লোকসংস্কৃতি বা গণসংস্কৃতির ধারণা, মনু লোকায়তিকদের শায়েস্তা করার যে বিধান দিয়েছেন, তা শুধু দর্শন ভাবনা খণ্ডন নয়, সেখানে লোকসংস্কৃতি ধ্বংস করে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাও সক্রিয় ছিল। বিষ্ণপুরাণ ও মৈত্রী উপনিষদে লোকায়তিকদের ‘সস্থর’ এবং ‘রাক্ষস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে দুটি পৃথক ধারা দেখা যায় - বৈদিক ও তান্ত্রিক। ‘‘তন্ত্র অতি প্রাচীন - বৌদ্ধ ধর্মের থেকেও প্রাচীন এবং আদিতে তা ব্রাহ্মণ্য বিরোধী তথাকথিত ইতর জাতিদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল।’’ লোকায়ত দর্শনের একটি শাখার বিষয় দেহাত্মবাদ। আবার তন্ত্রতত্ত্বের অপর নাম দেহতত্ত্ব। বিপক্ষ দার্শনিকেরা এমন মিল খুঁজে পেলে তন্ত্রকে লোকায়ত মত বলে চিহ্নিত করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
হরিভদ্রের ‘ষড়দর্শন সমুচ্চয়’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে, ‘লোকায়তিকেরা ইন্দ্রিয়গোচর জগতের বাইরে আর কোনো অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।
অনুমান করা হয়েছে যে, এর পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, স্বর্গপ্রাপ্তির মোহ দেখিয়ে, ধর্ম সাধারণ মানুষকে প্রবঞ্চিত করে - তার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে শুধু ইন্দ্রিয়গোচর জগতের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় কারণটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। অপ্রত্যক্ষকে যদি সত্যের মর্যাদা দেওয়া যায়, তাহলে দরিদ্রর পক্ষে তার দারিদ্র্যের কথা ভুলে থাকার সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যায়। ‘দাস’-কে ভুলিয়ে রাখা যায় যে, সে দাস নয় - সে পরকালে পরমান্ত্র পাবার অধিকারী। ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দু’টি সমান্তরাল ধারার কথা দেবীপ্রসাদ উল্লেখ করেছেন। বৈদিক/অবৈদিক, আর্য/অনার্য, আর্য/দ্রাবিড় এভাবে তাদের চিহ্নিত করা হয়। এই ভেদ তৈরি হয়েছে উৎপাদন পদ্ধতির প্রভেদ থেকে। পশুপালন-প্রধান অর্থনীতিতে গড়ে উঠেছে বৈদিক পুরুষ প্রধান দর্শন। কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে গড়ে উঠেছে অবৈদিক মাতৃপ্রধান দর্শন। ‘সাংখ্য’ যে বেদবিরোধী ছিল নানা উদাহরণ দিয়ে দেবীপ্রসাদ তার বিশ্লেষণ করেছেন। গোড়ায় ‘সাংখ্য’ ছিল নিরীশ্বরবাদী। পরে তার মধ্যে ঈশ্বরতত্ত্ব চাপানো হয়েছে। আদি সাংখ্য শুধু নিরীশ্বরবাদী নয়, একে জড়বাদ বা বস্তুবাদও বলা যায়। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মহাশয় দেখিয়েছেন যে, জৈন লেখকরা লোকায়ত ও সাংখ্যের মধ্যে কোনো ফারাক করেননি। তন্ত্র, যোগ, লোকায়ত, সাংখ্য দেখা যায় পরস্পর জড়িত। ভাববাদের মূলভিত্তি চেতনকারণবাদ। কেন প্রাক্-বিভক্ত সমাজে তার বিকাশ সম্ভব হয়নি, দেবীপ্রসাদ আলোচনা করেছেন। ঋগ্বেদ সংহিতা থেকে দেবীপ্রসাদ প্রচুর শ্লোক সংকলিত করেছেন। সেখানে দেখা যায়, পার্থিব সম্পদ লাভের বাসনাই প্রধান। মোক্ষলাভের কোনো আকাঙ্ক্ষা তাতে নেই। ঋগ্বেদ প্রাক্-অধ্যাত্ববাদী চেতনার পরিচায়ক। দৃষ্টান্ত দিয়ে দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে, সেখানে কামনা বাসনার কথা যা বলা হয়েছে তা ব্যক্তির জন্য নয়, সমষ্টির জন্য।
একটা কথা প্রায়শ বলা হয় যে, সব ভারতীয় দর্শনে রয়েছে ত্যাগের আদর্শ আর পশ্চিমী দর্শনে আছে ভোগের আদর্শ। বস্তুবাদী দর্শনটা বিদেশি। দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে, এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। অধ্যাত্ম দর্শন আমাদের দেশে অবশ্যই ছিল। তবে সেটা মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে ছিল। এটি ছিল শাসকশ্রেণির দর্শন। ছান্দোগ্য উপনিষদে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ভারতীয় দর্শনের যে কোনো পাঠ্যপুস্তক পড়লে মনে হয়, লোকায়তিকেরা ভোগবিলাস ছাড়া কিছু জানত না। ‘ঘি খাবার তালেই ঘুরত - তা সে ধার করেই হোক আর যে করেই হোক’। সুতরাং লোকায়ত দর্শন মানুষের অধঃপাতে যাবার দর্শন। উপনিষদ ও পৌরাণিক সাহিত্যে সব জায়গায় লোকায়ত দর্শনের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপপ্রচার করা হয়েছে।
বার্হস্পত্যসূত্রম, প্রবোধচন্দ্রোদয় প্রভৃতি একাধিক গ্রন্থে লেখা আছে যে, লোকায়ত মতে ‘বার্ত্তা’ই হলো একমাত্র বিদ্যা। ‘বার্ত্তা’ মানে হলো কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য। শ্রমে শাসকশ্রেণির অনীহা। তাই মনু বলেছেন, ব্রাহ্মণের পক্ষে কৃষিকাজ নিষিদ্ধ। শাসকশ্রেণি ভারতবর্ষে দৈহিক শ্রম ও মানসিক শ্রমের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। তাদের কাছে ‘কর্ম’ এক, ‘জ্ঞান’ অন্য। কর্মকে, বিশেষকরে দৈহিক শ্রমনির্ভর, কর্মকে নীচবৃত্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারলে মানুষের ভাববাদের সপক্ষে কথা বলতে অসুবিধা হয়। তাছাড়া বলা হলো, সকল মানুষের উন্নত চেতনা থাকে না।
দেবীপ্রসাদ লিখেছেন, প্রাচীন ভারতের পুঁথিপত্র অনুসন্ধানে আধুনিক বহু গবেষকের অনীহা দেখা যায়। তার কারণ কি এই যে, প্রাচীন ভারতের বহু বৈশিষ্ট্যের কথা এঁরা মানুষের কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়? কী বৈশিষ্ট্য? দেবীপ্রসাদের ভাষাতেই বলা যায়, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে হিংসা ও বিদ্বেষের তাণ্ডব যতো প্রচণ্ড হয়েই উঠুক না কেন, এককালে এই সমাজে সবাই স্বাধীন ছিল। সমান ছিল। কায়িক শ্রম এবং বৌদ্ধিক শ্রমের মধ্যে ফারাক ছিল না। তখন মানুষ শোষণ করতে শেখেনি, তাই শেখেনি অধ্যাত্মবাদের প্রবঞ্চনা, শেখেনি ভাববাদের আলেয়া দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ভুল পথে চালনা করতে।
দেবীপ্রসাদ সংস্কারমুক্ত মনে বেদের চর্চায় দেখেছেন যে, বেদের প্রাথমিক স্তরে এবং অন্তত ঋক্বেদে ধর্মীয় চেতনা পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল। দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে লোকায়ত দর্শনে ব্রহ্মের একমাত্র সত্তা হিসাবে অস্তিত্ব ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করা হয়েছে এবং ‘Pratyaksa’ (perception)-কে জ্ঞান অর্জনের প্রকৃত পন্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিরিখে ভারতের প্রাচীন ‘দেহবাদ’ এবং তার সাথে যুক্ত রীতিনীতিগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বলেছেন যে, “….he became the pioneer, and so far the unrivalled proponent of Marxism in Indian philosophy.”
দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন, লোকায়ত দার্শনিকেরা ‘আত্মা’র অস্তিত্বকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছিলেন। স্বর্গ-নরক, পূর্বজন্ম-পরজন্মের ধারণাকে খারিজ করা হয়েছিল। লোকায়ত দার্শনিকদের মতে জড় ও জীব নিয়ে এই জগৎ গঠিত - বস্তুগত ধারণা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি লোকায়তিক ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এখানে দৃঢ়ভাবে ভাববাদীদের কর্মফল তত্ত্বের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই তত্ত্বের মূলকথা, বর্তমান কালের সুখ বা দুঃখ ভোগ অতীত কর্মের ফল। আবার বর্তমানের কর্মকাণ্ড আগামী ভবিষ্যতের ফলে প্রতিফলিত হবে। এই মতবাদ আসলে আত্মার রূপান্তরের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই মতবাদ ‘‘সুস্পষ্টভাবে এক অন্ধকার অতীতের অপরিবর্তনীয় শক্তির কথা বলে। এই কর্মফলবাদ উপনিষদের সময় থেকে বর্ণব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল।’’
শ্রাদ্ধ ও পারলৌকিক ক্রিয়ায় ব্রাহ্মণ্য প্রথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে লোকায়ত দার্শনিকেরা প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ তাঁদের বক্তব্য এইভাবে তুলে ধরেছেন।
‘‘শ্রাদ্ধ যদি মৃতদের তৃপ্তি দেয় তাহলে ইহজগতে কোনো ভ্রমণকারীকে যাত্রার শুরুর সময় খাদ্য/পাথেয় প্রদান নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। যদি মৃত মানুষ আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়ায় সন্তুষ্টি লাভ করে, তবে উৎসর্গের মাধ্যমে বাড়ির নিচের তলার মানুষ উপরতলায় খাদ্য পরিবেশন করে না কেন?’’ তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, ‘‘একজনের গ্রহণ করা খাদ্য কি অন্যের পুষ্টি দিতে পারে? ব্রাহ্মণকে দান করা খাদ্য কি পিতৃপুরুষের সেবা করতে পারে?’’ এইসব প্রশ্নবাণের মুখে পুরোহিতশ্রেণি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং লোকায়তিক ও লোকায়ত দর্শনকে ধ্বংস করে। মহাভারতের শান্তিপর্বে লোকায়তিকদের প্রতি অভিজাতদের এই ধরনের ঘৃণা ও শত্রুতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
লোকায়ত দর্শনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি মার্কসবাদী মতাদর্শগত সংগ্রামে এবং সমস্ত রকম বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
বস্তুবাদ ছাড়াও লোকায়ত দর্শনের আর একটি মূল্যবান বৈশিষ্ট্য হলো ‘নারীপ্রাধান্য’ ও ‘মাতৃপ্রাধান্য’। বর্তমান সময়কালে নারীর সমানাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তাই লোকায়ত দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
বলাইবাহুল্য বর্তমান সময়ে দেবীপ্রসাদের চর্চা, বিশেষকরে তাঁর ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থের পঠনপাঠনের গুরুত্ব অসীম। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মার্কসবাদী গবেষক ডঃ অরুনাভ মিশ্রের একটি উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দেবীপ্রসাদের জন্মদিনে আমরা সেই উক্তিটি স্মরণ করছি -
“The forces of orthodox Hindutvavaad with fangs of old Varnashrama and Vedanta philosophy are now trying to dominate socio-cultural and political atmosphere of India. Inculcation of findings of Debiprasad may helps us a lot at this critical juncture to uphold idea of united secular and modern forward looking Indian.”