৬১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা / ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ / ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০
নভেম্বর বিপ্লবের আদর্শ আজও অম্লান
ময়ূখ বিশ্বাস
আমরা মানে আমাদের প্রজন্মের যারা সোভিয়েত দেখিনি। স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে এসেছে গোর্কি, টলস্টয়, চেকভ, দস্তয়েভস্কি, গোগোলের অমর সৃষ্টিগুলো। আমাদের কাছে ছুতোরের ছেলে ইউরি গ্যাগরিন বা ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা মহাকাশ ছোঁয়ার কাহিনি থেকে গেছিল কুইজ বইয়ে। আমাদের বোঝানো হয়েছে ইতিহাসটা আসলে অন্যরকম। বার বার দেখানো হয়েছে বার্লিনের ভাঙা দেওয়াল। বলা হয়েছে সমাজবাদ সেকেলে - ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি’। শোনানো হয়েছে পুঁজিবাদের ‘নো অল্টারনেটিভ’ জয়গান। চোখের সামনে দেখছি দুনিয়া জুড়ে সেই সোভিয়েতের নেতা লেনিনের মূর্তি ভাঙার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে মোদির মতো দক্ষিণপন্থী নেতা ও তার ভক্তদের। আমাদের বলা হচ্ছে ছোটোবেলার আধুনিকতা - পেরোনো যুগ পেছনে ফেলে এমন দিনে পা দিয়েছি, যেখানে সত্যের পরেও ‘পোস্ট ট্রুথ’। টিভি, ইন্টারনেটে, সিনেমা বা সিরিয়ালে ১০০ পেরিয়ে দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনকে গাল দেওয়া চলছে। এই অসময়ের একমেরু বিশ্বে মানুষের জন্য কিছু করা বলতে শিখেছি এনজিও-তে বৎসরান্তে চ্যারিটি আর সেলেবদের ‘ফাউন্ডেশন’। যে দুনিয়ায় প্রচণ্ড গণতন্ত্রী হয়ে গাল পাড়া হয় গরিবের মসিহা মোরালেস বা মাদুরোদের। যেখানে লক্ষ ‘গোয়েবলসরা’ আশ্রয় নিতে বাধ্য করে ট্রাম্প আর মোদির মেগ্যালোম্যানিয়ায়। সেই দুনিয়ায় মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মান্যতা দেওয়া হয় ডারউইনের সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট তত্ত্ব দিয়ে। ছোটোবেলা থেকে শেখানো হয়েছে ‘‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’’। সাথে থাকছে সকাল থেকে রাত- দেওয়ালজুড়ে আঁকা ভোগবাদের আকাশকুসুম জলছবি।
●
তবু শোনা যাচ্ছে দুনিয়া জুড়ে, ‘দেয়ার ইজ আ্যন অল্টারনেটিভ’। প্রায় ৩০ বছর হতে পারল না, সোভিয়েত পতনের আনন্দে সারারাত মোচ্ছব করা পুঁজিবাদ ভোরের আলোয় উলঙ্গ। এখন দেশে দেশে বাজার ঠাকুর খদ্দের পাচ্ছে না। জিনিস বিক্রি হচ্ছে না তার। এদিকে বৈষম্য চরমে বড়োলোক আর গরিবের মধ্যে। পুজিবাদের ভক্তকুলও অস্বীকার করতে পারছে না, বৈষম্যটা এবার দৃষ্টিকটু জায়গায় চলে গেছে। মানুষের হাতে পয়সা নেই। ভারতে তো বিস্কুট বিক্রিও কমে গেছে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী সংকটের মুখে আলমারি থেকে ধুলো ঝেড়ে হাতে হাতে ফিরে আসছে দাস ক্যাপিটালের খণ্ডগুলো। সেই ২০০৮ সালেই শোনা গিয়েছিল আর্তনাদ পুঁজিবাদের মুখপত্র টাইমস পত্রিকার প্রথম পাতায়। কবর থেকে উঠে মার্কস ফিরে এসেছেন।
একটা সময় সমাজতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য গতি রুখতে সামাজিক ন্যায় বিচার না হোক, সামাজিক সুরক্ষা বেশ খানিক দিয়েছিল পুঁজিবাদ। এখন সোভিয়েত নেই। আজ নিজেদের দেশে স্কলারশিপ, স্বাস্থ্যবিমা, মাইনে, পেনশনে হাত লাগাতে গিয়ে খোদ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কমিউনিস্টদের থেকে হাজার যোজন দূরে থাকা ওই সব দেশের শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত মানুষ ঠ্যালা বুঝছেন। এরমধ্যে সবে শেষ হলো জেনারেল মোটরসের ৫০টি অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে ৪৯,০০০ শ্রমিকের টানা ৪০ দিনের চোয়ালচাপা লড়াই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বেসরকারি ক্ষেত্রে বৃহত্তম, দীর্ঘতম ধর্মঘট। শ্রমিকদের দাবি ছিনিয়ে এনেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকেই গোটা দুনিয়াকে একমেরু বিশ্ব হিসেবে গড়ে নেওয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘোষিত লক্ষ্য হয়ে গেছে। এদিকে পরিবেশ নিয়ে সমস্যা তুঙ্গে। মার্কিন প্রশাসন হেলায় বলে দিচ্ছে- ‘‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মানবো না!’’ কিংবা ‘‘গোটা দুনিয়ার গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার দায় নেব না!!’’ বা, ‘‘যত দায় সব তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোর’’! প্রয়োজন হলে একদিকে যেমন নিজেদের দেশ থেকে পরিবেশকে ধ্বংস করা কারখানাগুলো সেখানে সরাবে, আবার একইসাথে ওই পরিবেশের দোহাই দিয়ে তৃতীয় দুনিয়ার কারখানা অথবা সেই পণ্য নিজের দেশে ঢোকা বন্ধও করবে! অন্যদিকে এই গ্রহের ফুসফুস আমাজন শেষ করছে মুনাফার লোভে। মুনাফা। আরও-আরও বেশি বেশি মুনাফা করবে এই ব্যবস্থার মাথারা। আর তার বলি হচ্ছে পরিবেশ এবং গরিব মানুষ। ব্রাজিল থেকে বাঁকুড়ার আদিবাসী মানুষরা। মুনাফার লোভ শেষ করে দিচ্ছে বাস্তুতন্ত্রকে। ক্রমাগত নামছে জলস্তর, আর বৃষ্টির জলকে ধরে রেখে তাকে ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ নেই। ক্রমাগত বাড়ছে আমাদের এই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা। গলছে হিমবাহ, ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছে এবং ছোটোও হচ্ছে। শুকোচ্ছে জলের উৎসগুলো, আবার উলটোদিকে বরফ গলা জলে ক্রমে ক্রমে উঁচু হচ্ছে সমুদ্রের জলতল। বিপন্ন হচ্ছেন প্রান্তিক মানুষ। প্রকট হচ্ছে মানব সভ্যতার প্রখরতম অস্তিত্ব সংকট। এই দুনিয়ার নবীনতম বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব। সোভিয়েতবিহীন দুনিয়াতে। তাই মানুষ নামছে প্রতিবাদে বিশ্বের সব জায়গায়। এই শোষণের বিরুদ্ধে।
ওদিকে লেবানন, চিলি, ইকুয়েডর, হাইতি এখন জ্বলছে। পুঁজিবাদ আর নয়া-উদারনীতিকে, ইয়াঙ্কি আধিপত্যবাদকে প্রতিদিন তাড়া করে বেড়াচ্ছে আলেন্দের কথাঃ ‘‘আক্রমণ যত ধারালো হবে, প্রতিরোধ হবে তত বেশি শানিত। কারণ, ভবিষ্যৎ মানুষের।’’ যেখানে নয়া উদারবাদ গণতন্ত্রকে খুন করে, কমিউনিস্টদের নিকেশ করে তার জয় যাত্রা শুরু করেছিল, সেই চিলির সান্তিয়াগোর রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ অর্কেস্ট্রার সুরে প্রতিবাদী গান গাইছেন। তাদের গানে-প্রতিবাদে বেঁচে উঠেছেন শহিদ কমিউনিস্ট গায়ক-গীতিকার ভিক্টর জারা। গোটা চিলি দাবি তুলেছে - ‘শান্তিতে বাঁচার অধিকার’ এর জন্যে শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি - জনবিরোধী নীতি প্রত্যাহার করতেই হবে। তারজন্যে কাঠামোগত পরিবর্তন দ্রুত দরকার। দক্ষিণ আমেরিকার ধনী দেশ চিলিতে বৈষম্য এখন চরমে। পিনোচেতের সেনা-জমানা শেষে গণতন্ত্র ফেরার পর বৃহত্তম সমাবেশ থেকে তাই দাবি উঠছে দারিদ্র্যসীমার উপর ন্যূনতম মজুরি, সপ্তাহে ৪০ঘণ্টা কাজ, ছাত্র ও প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে যাতায়াতের সুযোগ দিতে হবে, পেনশন বৃদ্ধি করতে হবে। এর অনেক দাবিগুলো আমাদের চেনা। কারণ এর সমস্যা সব জায়গায় এক নয়া-উদারবাদ। আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসক্রিপশন যারা অনুসরণ করেছে - সে ভারত থেকে চিলি, টের পাচ্ছে।
●
মানব ইতিহাসে ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লব অনুপ্রেরণা জোগায় গোটা দুনিয়ায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা মানুষদের। তা আরও সঠিক দিশা পায় ১৯১৯ সালে কমরেড লেনিনের প্রদত্ত উপনিবেশ সংক্রান্ত থিসিস ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামে একটা নতুন দিশা ও শক্তি জোগায়। যা পরাধীন দেশগুলির উপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও সেখানকার জনগণের অমানবিক অবস্থার বিষয়গুলি উন্মোচিত করে দিয়ে,সেই সেই দেশের জনগণের নিকট - সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তিকে, শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে, কমিউনিস্ট পার্টিকে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার আহ্বান জানায়। এই উপনিবেশ সংক্রান্ত থিসিস পরাধীন ও আধাপরাধীন দেশগুলির কাছে এক নতুন দাবিসনদ উত্থাপনের সুযোগ করে দিল। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টাকে যুক্ত করে দিল। তাই তো জীবনের শেষ দিনগুলিতেও সোভিয়েত নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিলেন জেলের কুঠুরিতে পড়ে থাকা ভগৎ সিং। এখন আমাদের দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক শতাব্দী হতে চলেছে। দেশ গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন কমিউনিস্টরা। মিরাট-লাহোরের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জালালাবাদের পাহাড়ে-নৌবিদ্রোহের গৌরবে, তেভাগা- তেলেঙ্গানা- পুন্নাপ্রা ভায়লারের পথে বেয়ে, ইমারজেন্সির রক্তচোখ উপেক্ষা করে গোটা দেশের সামনে বিকল্পনীতির দিশা কমিউনিস্টরা। কিন্তু আজ দেশ এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দেশের শাসক এখন কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী দক্ষিণপন্থী তথা ফ্যাসিস্ট আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক মুখ বিজেপি। ভারতে বামপন্থার ১০০ বছরে আক্রমণ সবথেকে তীব্র হয়েছে দেশের কমিউনিস্টদের ওপর। কমেছে সাংসদ। তাঁরা সরকার পরিচালনায় নেই বাংলা- ত্রিপুরাতে। মমতা থেকে মোদি, বাংলা থেকে ত্রিপুরা কমিউনিস্টদের ওপর অত্যাচারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গ, কিয়েভের কায়দায় লেনিনের মূর্তি ভাঙার নেশায় মেতেছে খেজুরি বা বিলোনিয়ায় মোদি-মমতার স্যাঙাতরা। কিন্তু এনিয়ে হা-হুতাসের জায়গা নেই।ফ্যাসিস্টরা মূর্তি ভাঙবেই। এদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না গান্ধী, আম্বেদকর, আজাদ বা পেরিয়ার। আসলে এদের লক্ষ্যই হলো আমাদের দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঐতিহ্য-দেশের সংবিধানকে শেষ করা। মানুষ যাতে এদের বিরুদ্ধে এক না হতে পারে তারজন্য লড়াই লাগাও - হিন্দু বনাম মুসলমান, এদেশি বনাম উদ্বাস্তু, উঁচুজাত বনাম নিচুজাত। হিন্দি বনাম ভারতের বাকি সকল ভাষা। কেউ বলছে শুধু বাংলাস্তান। আমাদের দেশে মূল সমস্যা - বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,বেহাল অর্থনীতি থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে নয়া উদারবাদের দালালরা। এরাই আসলে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’। এরাই মানুষকে ভাগ করে। বাংলায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটেছে, তা অতীতের সব ইতিহাসকে ছাপিয়ে গেছে। এর ফাঁদে পা দেওয়ার মানে আপনি ভুলে থাকবেন অর্থনীতির নিদারুণ দশা। কৃষক আত্মহত্যা। রেল, এয়ার ইন্ডিয়া, বিএসএনএল’র বেসরকারিকরণ। আপনি ভুলে যাবেন নীরব মোদি আমার আপনার ১১,০০০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। আপনি ভুলে থাকবেন যে, আধার কার্ডে সব তথ্য লিংক করার পর আপনার ব্যক্তিগত ডেটাবেস জলের দরে চলে যাচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে। আদানি ৮ থেকে সম্পদের নিরিখে ২ নম্বরে এগিয়ে আসছে, আর খাদ্য সূচকে দেশ ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২নম্বর স্থানে থাকছে। আপনি এটাও ভুলে থাকবেন যে, রান্নার গ্যাসের দাম এই পাঁচ বছরে প্রায় চারগুণ হয়ে গেছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা রেকর্ড ছুয়েছে দেশে। আর ওরা আপনাকে চপ-পকোড়ায় আটকে রাখবে।
এদিকে মহার্ঘ্য নিত্যদিনের জিনিসপত্র। সরকার পারলে পাকস্থলি খুলে দেখছে আমি আপনি কি মাংস খাই। বাতাসে যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। সীমান্তে সেনা মরছে, রেশন পাচ্ছে না। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ফি বাড়ছে। শিক্ষক কমছে। স্কলারশিপ কমছে। কমিউনিস্ট সংখ্যা কমে গেলে দেশের যে বিরাট সর্বনাশ হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে। যাঁরা ছিলেন ইউনিয়নের সবচেয়ে বিরুদ্ধে, আজ তাঁরাই পাগলের মতন ইউনিয়ন চাইছেন। যেমন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। শুধু কগনিজেন্ট ১২হাজার কর্মীকে দ্রুত ছাঁটাইয়ের কাজ শুরু করেছে। আবার মার্কিন কোম্পানি সিটিএস’র সিইও ব্রায়ান হাম্ফেরিসও প্রত্যেক কর্মীদের রীতিমতো নিয়মিত ইমেল করে হুমকি দিচ্ছেন, দ্রুত ছাঁটাই হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে। আতঙ্কে ঘুম হারিয়েছেন কর্মীরা। এদের অনেকরই বেতন ভালো এখন। ফলে জীবনযাত্রার মান উন্নত। প্রত্যেকের বড়ো বড়ো ঋণের ইএমআই ভরতে হয়। ফলে একমাস বেতন না পেলে পথে বসতে হবে। আর এই বয়সে ভাল চাকরি পাওয়াও মুশকিল। প্রায় একই রকম মেইল হুমকি বা ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা শোনা যাচ্ছে টিসিএস, টেক মাহিন্দ্রা, উইপ্রো, আইবিএম-এর মতো নামজাদা কোম্পানিতেও।
পশ্চিমবঙ্গে এক অরাজক অবস্থা চলছে। ‘উন্নয়ন’-এর নামে তোলাবাজি, শিল্প নেই, চাকরি নেই, গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। শুধু আছে প্রলোভন, প্ররোচনা। সমাজবিরোধীদের শিবির ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নেই, নেই, আর নেই, গ্রাম-শহরে এক অরাজক অবস্থা গোটা দেশে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের সামনে।
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাম্প, বোলসোনারোর মতো দুনিয়াজোড়া ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনা ‘এথনিক ক্লিনসিং’-এর স্বপ্নে মশগুল আরএসএস ‘এনআরসি’ করে বাংলায় ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ বানাতে চাইছে। মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ চাইছেন। এর প্রভাব পড়ছে। বাংলায় তৃণমূল পড়তি। দেশে সাম্প্রতিক নির্বাচনে বোঝা গেছে জনবিরোধী নীতির থেকে মানুষ বিকল্প খুঁজছে। শুধু হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে বিজেপি’র ভোট কমেছে ২২ শতাংশ। লোকসভায় মে মাসে ছিল ৫৮ শতাংশ। আর এখন ৩৬ শতাংশ।
●
ডাক পড়েছে লড়াইয়ের। সময় এসেছে রাস্তাঘাট ট্রেনে বাসে সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘‘মুদ্দে কি বাত’’-এর। এ সরকার ভাতের বদলে যুদ্ধ দিচ্ছে থালায়। কিন্তু আমাদের তো লাগাতার বলে যেতে হবে পাকস্থলি বোঝে না ধর্মের নামে ব্যবসা। তাই শাসক যতই আমাদের মগজে কারফিউ জারি করুক না কেন, ১৪৪ ধারা ভেঙে আমরা জড়ো করব প্রতিরোধের শব্দ। ওরা আমাদের একশো’টা পার্টি অফিস ভাঙতে পারে। খুন করতে পারে। কিন্তু যতদিন আম্বানিরা দেশ লুঠ করে মুনাফা লুটবে, যতদিন ক্ষুধা ইনডেক্সে লজ্জার বিনিময়ে জয় শাহ পকেট ভরবে, ততদিন নভেম্বর মাস ঠিক ফিরে ফিরে আসবে এদেশেও। তাই তো অনেক সুদূর চিলিতে যে লড়াই চলছে, অনেক দ্রাঘিমা আর অক্ষরেখা পেরিয়ে এই উপমহাদেশে আরবসাগরের তীরে-উত্তরবঙ্গের চা বাগানে-চিত্তরঞ্জন থেকে কলকাতার পথে তা মিশে যায়। নভেম্বরই শিক্ষা দেয়। এই শোষকরাজ উৎখাত করার শপথ নেয়।
তুলা-বাকু-মস্কোর শ্রমিক কলোনির ব্যারিকেড দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় শতাব্দী পেরিয়ে, মানচিত্রের সীমানা ছাড়িয়ে, গোপনে বিদ্রোহের আর ভাঙনের ইশতেহার পাচার করে দিয়ে।
●
নভেম্বর বিপ্লব চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে বিশ্বের দেশে দেশে মেহনতি মানুষকে। তার গঠন ও অবিশ্বাস্য গতিতে তার অপরাজেয় হওয়ার আখ্যান আজও শিক্ষা দেয়। বিকল্পের সন্ধান দেয়। যখন ১৯৩০-এর মন্দায় ধুকছে ইয়োরোপ-আমেরিকা, তখন সোভিয়েত ঘোষণা করার হিম্মত রাখতে পেরেছিল যে, তাদের দেশে বেকার নেই। শুধু কাজ, দুবেলা খাওয়াই নয়।স্বাস্থ্য পরিষেবা বিনামূল্যে। সোভিয়েত শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যেসব প্রান্তিক পরিবার কখনও উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতেও পারত না, তাদের জন্যে ভেবেছিল কমিউনিস্টরা। শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা, বয়স্কদের মধ্যে যাঁরা নিরক্ষর, তাঁদের জন্য নাইটস্কুল (বাধ্যতামূলক) খোলা হয়েছিল। বিনা পয়সায়। মাত্র আঠারো বছরের মধ্যে, ১৯৩৭ সালে দেশের সাক্ষরতার হার দাঁড়িয়েছিল ৭৫ শতাংশ। ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে বারবার বিশ্বকবি এর প্রশংসা করেছেন। তাই তো গরিব পরিবারে জন্ম হওয়া জরিপবিদ্যায় পারদর্শী, ধাতুবিদ্যায় ইঞ্জিনিয়ার ব্রেজনেভরা তৈরি হোন। দেশের প্রধানও হোন। ইউরি গ্যাগরিনের মতো গরিব ঘরের সন্তানরা স্বপ্ন পাখা মেলেন। সেদেশ ছিল অলিম্পিকে সেরা। এদেশে শোষণ ছিল না। মালিক ছিল না। গরিব ছিল না। বেকার ছিল না। ওরা আজও তাই স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করে। সেই স্বপ্ন দেখার সাহসই হিটলারের থার্ড রাইখের স্বপ্ন দেখা স্বৈরতন্ত্রর মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে পারে। অবিশ্বাস্য দম্ভে রাইখস্ট্যাগের মাথায় উড়িয়ে দেওয়া কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকায়। কারণ এই গ্রহের আবর্তন সেদিনও জানত, দ্ব্যর্থহীন বিশ্বাসে জানত; মায়োকভস্কির কবিতা-গোর্কির গল্প-বলশয়ের ব্যালে-আইজেনস্টাইনের সিনেমা জানে থার্ড রাইখের স্বপ্ন শেষ কথা বলতে পারেনা কখনোই। না পারে তাদের ভক্ত সাভারকর বা মোদি। তাই তো সোভিয়েত ভাঙন ইতিহাসের শেষ হতে পারেনা।